“সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়” | “জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করিতে হয়, আর ভাবের কথাকে সঞ্চার করিয়া দিতে হয়।”

মানুষের হৃদয় অপর মানুষের হৃদয়ে অমরতা প্রার্থনা করে এবং সেই কারণেই নিজের মনের ভাবটিকে পরিস্ফুট করবার জন্য মানুষ সাহিত্য সৃষ্টি করে। এই কারণেই 'নীরব কবিত্ব' ও 'আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস কথাগুলিকে অর্থহীন বাক্‌চাতুরী বলে মনে করা হয়। আসলে প্রকাশই কবিত্ব। নিজেকে প্রকাশ করা, নিজের মনোভাবকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং তাকে স্থায়ী করে তোলার জন্যই জীবজন্তু, গাছপালা এবং মানুষও বংশ বিস্তার করে। মহামতি অশোক তাঁর বক্তব্যকে, তাঁর মনোভাবকে সর্বকালের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যই দেশে দেশে গিরিগাত্রে ও প্রস্তরস্তম্ভে তাঁর অনুশাসন-লিপি-খোদাই করে রেখেছিলেন। প্রত্যেক শিল্পী—তিনি চিত্রকর, স্থাপত্যশিল্পী, ভাস্কর কিংবা সাহিত্যিক যা-ই হোন না কেন, চিরকাল ধরে তাঁদের অবিরাম চেষ্টার পিছনে রয়ে গেছে তাঁদের হৃদয়-ভাবকে অপরের হৃদয়ে পৌঁছে দেবার তাগিদ।


নিজের মনের ভাবকে অপরের মনে সঞ্চারিত করবার দ্বিবিধ প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। একটা প্রয়োজন হতে পারে ক্ষণকালীন, অপরটি চিরকালীন এবং এই দুই প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য উপায়ের মধ্যেও যে পার্থক্য থাকবে তা একান্ত স্বাভাবিক। আমরা আমাদের সাম্বৎসরিক প্রয়োজনের জন্য, উদরান্নের সংস্থানের জন্য জমিতে বুনি ধান, গম বা যব। কিন্তু বৃহত্তর প্রয়োজন-সিদ্ধির জন্য চিরকালীন অরণ্যসৃষ্টির প্রয়োজনে সন্ধান করি বনস্পতির বীজ। প্রথমটির প্রয়োজন তাৎক্ষণিক–তা আমাদের দেহের ক্ষুধা মেটায়, পক্ষান্তরে অরণ্যের প্রয়োজন চিরকালীন—তা একদিকে যেমন পুরুষানুক্রমে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের আশ্রয় দান করে, তেমনি আমাদের মানসিক ক্ষুধানিবৃত্তিরও সহায়ক।


আমাদের সাহিত্যেও রয়েছে তেমনি দুটি ধারা—একটিতে আছে ক্ষণকালের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ‘জ্ঞানের কথা’ বা মননশীল সাহিত্য (literature of knowledge) এবং অপর ধারায় রয়েছে শাশ্বত আনন্দের উৎস 'রস সাহিত্য' (literature of power) বা 'ভাবের কথা'। চিরকাল মানুষ চেষ্টা করে আসছে প্রকৃত রসসাহিত্য সৃষ্টি করতে, কারণ এরই রয়েছে চিরকালীন স্থায়িত্ব। আমাদের দেশেও তাই লেখকরা জ্ঞানের সাহিত্য বা সারবান সাহিত্য রচনা অপেক্ষা কবিতা-গল্প-উপন্যাস-আদি সৃজনধর্মী ভাবের সাহিত্য রচনাতেই সমধিক আগ্রহী। এ নিয়ে অর্থাৎ সারবান সাহিত্যের অভাব নিয়ে হিতৈষী সমালোচকদের মনে দুশ্চিন্তা জাগতে পারে, কিন্তু লেখকরা যে স্থায়িভাবেই কিছু রচনা করতে চান।


জ্ঞানের কথা একবার প্রচারিত হলে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আবার নিত্য নোতুন আবিষ্কারের ফলে পুরাতন জ্ঞানের কথা মূল্যহীন বিবেচিত হয়। এক সময় যে-জ্ঞানের বিষয় পণ্ডিতের বুদ্ধিগম্য হয় না, কিছুকাল পর তা বালকের নিকটও সহজবোধ্য বিবেচিত হতে পারে। ফলে জ্ঞানের কথার কোনো শাশ্বত চিরন্তন মূল্য নেই। নোতুন চিন্তাধারার প্রবর্তনে সেই জ্ঞানের কথাও আচ্ছন্ন হয়ে যায়, কিন্তু হৃদয়ভাবের কথা, বহু প্রচারেও কখনো পুরাতন হয় না। আবার,–আগুন গরম, জল তরল কিংবা সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়—এইসব জ্ঞানের কথা একবার জানলে আর দ্বিতীয়বার জানবার আবশ্যক হয় না। অথচ পূর্বাকাশে সূর্যোদয়-দর্শনে মনে যে প্রকাশাতীত অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা পুনঃ পুনঃ দর্শনেও পুরাতন হয় না। ভাবের কথা বারবার শ্রবণেও তেমন কোনো ক্লান্তি আসে না। বরং প্রাচীনকাল থেকে লোকপরম্পরায় যে অনুভূতি প্রবাহিত হয়ে আসছে, তাতে তার গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং তা সহজেই আমাদের আবিষ্ট করতে পারে। এই কারণেই মানুষ যদি আপনার কোনো জিনিসকে চিরকালের করে রাখতে চায়, তাহলে তাকে ভাবের কথাই অবলম্বন করতে হয়। এইজন্যই বলা হয় সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়।


ভাবের বিষয় চিরকালীন, জ্ঞানের বিষয়ের মেয়াদ স্বল্পকালীন—উভয়ের পার্থক্য শুধুই এইটুকুই নয়। জ্ঞানের বিষয়ে প্রাধান্য বিষয়টিরই অর্থাৎ আধেয় বস্তুর–আধারটির নয়, তাই পাত্রান্তরেও তার সুবোধ্যতার অভাব ঘটে না। অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়কে ভাষান্তরিত করা যায় এবং তাতে উজ্জ্বলতার বৃদ্ধিও ঘটতে পারে। কিন্তু ভাবের বিষয়ে এ কথা খাটে না। এখানে শুধু বিষয়টির নয়, ভঙ্গিটিও অনুভবযোগ্য। যে ভাষায় লেখক আপনার হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেন, ভাষান্তরিত হলে তা আর বজায় থাকে না। এক্ষেত্রে আধার থেকে আধেয়কে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। জ্ঞানের কথাকে যুক্তি, তর্ক বা দৃষ্টান্ত সহযোগে শুধু প্রমাণ করলেই চলে, কিন্তু ভাবের কথাকে নানাপ্রকার ছলা-কলা, আভাসে ইঙ্গিতে অর্থাৎ ছন্দে অলঙ্কারে নানাভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করতে হয়, যাতে তা সহজেই অপরের হৃদয়েও সঞ্চারিত হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু বোঝানোটাই যথেষ্ট নয়, তাকে নোতুন করে সৃষ্টি করে তুলতে হয়। অপরের হৃদয়ে যদি নিজের ভাবকে সঞ্চার করা না যায়, তবে তা আর সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না। ভাবকে সঞ্চারিত করবার জন্য যে সমস্ত কলা-কৌশলের প্রয়োজন অনুভূত হয়, সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, তা থেকেই এর প্রকৃতি এবং উপযোগিতা অনুভূত হবে। তিনি বলেন, “এই কলা-কৌশলপূর্ণ রচনা ভাবের দেহের মতো। এই দেহের মধ্যে ভাবের প্রতিষ্ঠায় সাহিত্যকারের পরিচয়। এই দেহের প্রকৃতি ও গঠন অনুসারেই তাহার আশ্রিত ভাব মানুষের কাছে আদর পায়, ইহার শক্তি অনুসারেই হৃদয়ে ও কালে ব্যাপ্তি লাভ করিতে পারে।"