টীকা লেখো : চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রণয়

শূদ্রক-রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ একটি ‘প্রকরণ’-জাতীয় রূপক তথা নাটক। প্রকরণের বিধি অনুযায়ী এর নায়িকা নটী বসন্তসেনা। কুলগত কারণে বসন্তসেনা গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করলেও সে ছিল মহীয়সী রমণী। তাই যখন রাজশ্যালক শকার তাকে প্রলুব্ধ করবার জন্য বলে ‘আমি দেবকল্প পুরুষ আমি নবরূপী কৃষ্ণ; আমাকে ভজনা করতে হবে, তখন বসন্তসেনা রেগে গিয়ে তাকে বলে ‘শান্ত হোন, যথেষ্ট হয়েছে, অসভ্যের মতো কথা বলবেন না এবং বিট যখন বেশ্যাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বসন্তসেনাকে বলে—'অতএব তুমি দীঘি, লতা অথবা নৌকার মতো সকলেরই সেবা কর' তখন নির্দ্বিধায় বসন্তসেনা উত্তর দিয়েছিল—কিন্তু গুণই অনুরাগের কারণ, শক্তি প্রয়োগে অনুরাগ জন্মায় না।' এ থেকেই বসন্তসেনার প্রকৃত চরিত্র বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটিত হয় যে সে বহুবল্লভা নয়, সাধ্বী রমণীর মতোই সেও অনন্যাসভা।


এক বসন্তোৎসবের দিন উজ্জয়িনীতে কামদেবের মন্দিরে পূজা দিতে গিয়ে এরা নটী বসন্তসেনা ব্রাহ্মণসত্তান চারুদত্তের দর্শন পেয়ে পঞ্চশরে বিদ্ধ হলেন। সেই মন্দির থেকে যখন ফিরে আসেন তখন পথে রাজশ্যালক লম্পট শকার ও তার অনুচরদের তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে যে গৃহস্থগৃহে প্রবেশ করে; সেটি ছিল চারুদত্তের গৃহ। সেখানে চারুদত্তের ভদ্র ও বিনীত ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার অলঙ্কারগুলি এক পুটুলি করে পথে দস্যুভীতির আশঙ্কায় চারুদত্তের গৃহে রেখে এল।


এদিকে বসন্তসেনার পরিচারিকা মদনিকার প্রেমমুগ্ধ শর্বিলক নামে এক শিক্ষিত অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ তার মুক্তিপণ জোগাড় করবার জন্য সেই রাত্রে চারুদত্তের গৃহে সিঁধ কেটে অলঙ্কারগুলি চুরি করে নিয়ে এসে মদনিকাকে উপহার দিল। মদনিকা সেই অলঙ্কার বসপ্তসেনার বলে সনাক্ত করে পরে তা শর্বিলকের হাত দিয়েই চারুদত্তের প্রত্যর্পণ রূপে বসন্তসেনার নিকট পৌঁছে দিল। বসন্তসেনা সব বুঝতে পেরে মদনিকাকে শর্বিলকের হাতে তুলে দিল।


ওদিকে চারুদত্তের গৃহে বসন্তসেনার গচ্ছিত অলঙ্কার চুরি হয়ে যাওয়াতে তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ চারুদত্ত-পত্নী ধৃতা বিদূষক মৈত্রেয়ের হাত দিয়ে তার বহুমূল্য রত্নমালা বসন্তসেনার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। বসন্তসেনা তা গ্রহণ করলেন। আবার তা ফিরিয়ে দেবার জন্য চারুদত্তের গৃহে গেলে ধৃতা তা নিতে অস্বীকার করেন। সেখানে চারুদত্ত পুত্র রোহসেন তার এক বালকবন্ধুর স্বর্ণশকট নিয়ে খেলা করছিল। সেই শকট ফিরিয়ে নিয়ে গেলে চারুদত্ত-দাসী মদনিকা তাকে একটি মাটির গাড়ি (মৃৎ + শকটিক = মৃচ্ছকটিক) এনে দিলে বালক স্বর্ণশকটের জন্য বায়না ধরে কাঁদতে থাকে। বসন্তসেনা তখন তার দেহের সকল অলঙ্কার খুলে দিয়ে ঐ মৃৎশকট বোঝাই করে দেয় এবং বলে ঐ দিয়ে যেন স্বর্ণশকট করা হয়।


বসন্তসেনা এবার বাড়ি ফেরবার জন্য চারুদত্তের বাড়ির সামনে এসেই একটা শকট দেখতে পেয়ে এটাকে চারুদত্তের শকট ভেবে উঠে বসলো। কিন্তু এটা ছিল শকারের শকট। পরে শকার শকটে উঠে বসন্তসেনাকে আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন তার গলা টিপে ধরলো। বসন্তসেনা মূর্ছিতা হয়ে পড়লে তাকে মৃত্য মনে করে পুষ্পরম্ভাকে পাতা চাপা দিয়ে পালালো। এরপর শকার রাজদ্বারে অলঙ্কারের প্রলোভনে বসন্তসেনাকে হত্যার অভিযোগ আনলো চারুদত্তের বিরুদ্ধে।


বিচারক চারুদত্ত-সম্বন্ধে কিছু নমনীয়তা প্রকাশ করলেও দুষ্কর্মান্বিত রাজা পালক চারুদত্তের মৃত্যুর আদেশ দিলেন। সেই আদেশ পালনার্থে চারুদত্তকে বধ্যভূমে নিয়ে যাওয়া হল। ইতোমধ্যে আর্যকের অধিনায়কত্বে অকস্মাৎ যে রাজবিদ্রোহ দেখা দেয়, তাতে রাজা পালক পরাজিত ও নিহত হলেন। আর্যক রাজ্যভার গ্রহণ করলেন।


এদিকে বধ্যভূমিতে চারুদত্তের প্রাণদণ্ডের মুহূর্তে স্বয়ং গুপ্তসেনা এসে উপস্থিত হয়ে সমস্ত তথ্য জ্ঞাপন করলে ঘাতকের উদ্যত খড়্গ নিরস্ত হল। এমন সময় নতুন রাজা আর্যকের আদেশ নিয়ে প্রবেশ করলো শর্বিলক। সে জানালো, রাজার আদেশে তাঁর প্রিয় বন্ধু চারুদত্ত শুধু মুক্তই নন, রাজা তাঁকে বেণানদীর তীরবর্তী কুশাবর্তী রাজত্ব দান করেছেন। শকারকে বন্ধন করে আনা হলে সে চারুদত্তের কৃপা ভিক্ষা চাইল, উদার ব্রাহ্মণ তাকে মার্জনা করে দিলেন। স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শোনবার আশঙ্কায় বধূ ধৃতাও আগুনে আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সংবাদ পেয়ে সকলে সেখানে উপস্থিত হলে ধৃতা সকলকে জীবিত দেখে আশ্বস্ত হলেন। প্রীতমনে তিনি বসন্তসেনাকেও ‘ভগিনী’ বলে আলিঙ্গন করলেন। এমন সময় শর্বিলক ঘোষণা করলো যে রাজা স্বয়ং পরিতুষ্ট হয়ে আর্যক বসন্তসেনাকে ‘বধূ' শব্দ দ্বারা অনুগৃহীত করেছেন।


‘মৃচ্ছকটিক’ প্রকরণটির নায়ক বণিক-পল্লীনিবাসী ব্রাহ্মণ যুবক চারুদত্ত, যিনি প্রভৃত বিত্তশালী হলেও দানধ্যানের ফলে এক্ষণ নিঃস্ব, এবং নায়িকা নটী বসন্তসেনা। শাস্ত্রমতে কেউ আদর্শ নায়ক-নায়িকা না হলেও মানবিক আদর্শে উভয়েই অতিশয় উদার-হৃদয় মহৎ চরিত্রবিশিষ্ট। প্রথম দর্শনেই তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেও বসন্তসেনার মধ্যে যে পরিমাণ সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়, চারুদত্ত সেই তুলনায় অনেক নিষ্ক্রিয়। উভয়ই প্রেমাসক্ত কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো বিশ্রস্তালাপ কিংবা অশালীনতা দেখা যায় না। পরোপকারের জন্য উভয়কেই অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে এবং আকস্মিকভাবেই তাদের মধ্যে মিলন সাধিত হয়েছে। এটা যেন অচেষ্টাকৃত, অনেকটা আরোপিত। উভয়েই তাতে সুখী হয়েছে। কিন্তু চারুদত্ত তার সতীসাধ্বী স্ত্রী ধৃতার প্রতি যেন কিছুটা পরাঙ্মুখ, এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।