ইংরেজী রোমান্টিক সাহিত্যপর্বের সঙ্গে পরবর্তী ভিক্টোরীয় সাহিত্য পর্বের সাদৃশ্য ও পার্থক্য নির্ধারণ করো | আধুনিক বাংলা রোমান্টিক পর্বের প্রারম্ভ কোন সময় থেকে ধরবে?

ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাসের রোমান্টিক যুগ হচ্ছে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সাধারণভাবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধকে রোমান্টিক যুগ বলা হলেও বিশেষভাবে ১৭৯৮ থেকে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালসীমা যথার্থ রোমান্টিক ভাবনার সমুন্নতির যুগ। এর পর থেকেই রোমান্টিক ভাবনায় ভাটার টান লক্ষ্য করা যায়। রোমান্টিক সাধনার পাশাপাশি নতুন ভাবের উন্মেষ ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজী সাহিত্যকে বলা হয় নিও ক্লাসিক (Neo-classic)। ভাব ও রীতির দিক দিয়ে রোমান্টিক সাহিত্যের সঙ্গে তার পার্থক্য বিরাট। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কতকগুলি ঘটনা ঘটায় এই অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য এক বিশেষ খাতে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয়েছিল। এই যুগ মূলত গদ্যের যুগ। যুক্তি ও বিচারের মাপকাঠি দিয়ে সবকিছুর মূল্যায়ন করা হত। অষ্টাদশ শতক ছিল পরিচিত জগৎ। এই পরিচিত বা চেনা জগতের মধ্যে অপরিচিতের বা অচেনা জগতের সুর এই শতকের শেষদিকে ক্রমশঃই উচ্চকিত হয়ে উঠতে আরম্ভ করল।


ইংরেজী সাহিত্যে এই নতুন ধারার মন্ত্র উচ্চারণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল উনিশ শতকের মুখে। এই নতুন ধারা হচ্ছে রোমান্টিসিজিমের ধারা। সজিম হচ্ছে পরিচিতের মধ্যে অপরিচিতের সৌন্দর্য ও রহস্য খুঁজে পাওয়া। রোমান্টিকভাবে উদ্বুদ্ধ সাহিত্যিক যুক্তির ক্ষুদ্র জগৎ ছেড়ে কল্পনার বিরাট জগতে প্রবেশ করলেন। রোমান্টিসিজিম নিয়ম ও অনুশাসনের অচলায়তন থেকে মানুষের কাছে নিয়ে এল এক উদাত্ত আকাশের মুক্তির বার্তা। মুক্ত আত্মা মেঘের সঙ্গী হয়ে চলল 'দিক হতে দিগন্তের পানে'। রোমান্টিক কবি দেখলেন যে সাহিত্যের উপকরণ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। সমাজে যারা সাধারণ, যারা এতদিন কোনো বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয় নি, যারা ছিল দীনের হতে দীন’ তারাও নতুন যুগের দৃষ্টিপ্রদীপে অসাধারণ হয়ে উঠল। মানুষের প্রতি অত্যাচার ও উৎপীড়নে কবি-হৃদয় বেদনা কাতর হয়ে পড়ল। সে বেদনার প্রকাশ ঘটল রোমান্টিক যুগের সাহিত্যে।


অন্যদিকে একদিন যা ছিল অস্পষ্ট, যা ছিল অজানা তার মধ্যেও এ যুগের কবিরা আবিষ্কার করলেন এক অজানা সৌন্দর্যকে; এক অপূর্ব সৌন্দর্য নিকেতন তৈরি হল তাঁদের সাহিত্যে। রহস্যময়তা সাহিত্যের ভূষণ হয়ে উঠল। পাঠককে এঁরা নিয়ে গেলেন জানা-অজানার রহস্যময় কুহেলিকাগুণ্ঠনে ঢাকা এক নতুন জগতে। রোমান্টিসিজিম হচ্ছে বিস্ময়বোধের পুনর্জাগরণ। অষ্টাদশ শতকে মানুষ ছিল বুদ্ধির দাস, যুক্তির আলোক স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট। কিন্তু রোমান্টিক কবি নিয়ে এলেন বিস্ময়বোধ। শিশু যেমন সবকিছু দেখে কৌতুহল ও বিস্ময়ের দৃষ্টি দিয়ে, তেমনি মনের আয়নায় কবি দেখলেন ও দেখালেন এই প্রকৃতিতে—তার পর্বত, অরণ্যানী, সমুদ্র দিয়ে ঘেরা জগতকে, দেখলেন উৎপীড়িত, অবহেলিত, অবজ্ঞাত, দরিদ্র মনুষ্যসমাজকে, দেখলেন মধ্যযুগের ভাঙা দেউল আর প্রাসাদ, রহস্যময় প্রাচ্য গ্রিসের হৃতগৌরব। রোমান্টিক যুগে বন্দী মানবের মুক্তি হল। নতুন করে উন্মেষ হল ঐতিহাসিক চেতনার।


কবির চেতনার রঙে রাঙান, আপন মনের মাধুরী মেশান গীতিকবিতা নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করল। কল্পনার পাথেয় ভর করে কবিদল ছুটে চললেন সৌন্দর্যলোকের উদ্দেশ্যে, উপহার দিলেন আপন অনুভূতিপ্রধান এক বিশিষ্ট কাব্যজগতকে।


এই রোমান্টিক যুগের ক্রান্তিক্ষণেই এল পরবর্তী ভিক্টোরীয় যুগ। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই এই যুগলক্ষণ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার আইনের (Reforms Acts) জোরে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তখন সাহিত্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে নিগ্রো ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়া হল। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হল চার্টিষ্ট আন্দোলন। সাহিত্যে স্বভাবতঃই এর প্রতিফলন দেখা দিল। বিজ্ঞানের জগতে এলেন ডারউইন (Charles Darwin), স্পেন্সার (Herbert Spencer), রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, দর্শনে অবদান রাখলেন মিল (John Stuart Mill), রাস্কিন (John Ruskin)।


বিজ্ঞানের অগ্রদূত ও শিল্পের প্রসারের মধ্য দিয়ে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও এলো বৈচিত্র্য। বড়ো বড়ো কলকারখানা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এর একটা অন্ধকার দিকও চোখে পড়ে, স্লাম বা বস্তি এলাকা গড়ে উঠল, কচি বালকদের নিয়োগ করা হতে থাকল প্রায় বিনা বেতনে অথবা স্বল্প বেতনে, নানা কাজ-কর্ম সস্তা দামে মজুরদের বিভিন্ন শিল্পে লাগান হল। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ছাপ পড়ল সাহিত্যে। ডিকেন্সের উপন্যাসে আমরা এই হতভাগ্য মানুষদের পরিচয় পাই।


এ যুগে আসেন নি কোনো শেক্সপীয়র, মিল্টন বা কীটস: ব্লেক বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো কোনো প্রতিভাও এ যুগে দেখা যায় নি, একথা সত্য। কিন্তু কাব্য, উপন্যাস, মননশীল প্রবন্ধ বা বিজ্ঞান, দর্শন এবং শিল্প-চেতনার দিক দিয়ে এই যুগের সার্বিক অবদান ইংরেজী সাহিত্যে পূর্ববর্তী অপর কোনো যুগ থেকেই কম নয়।


এই যুগের সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এই সাহিত্যে সমসাময়িক যুগের বিভিন্ন দিককে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে। মানুষের জীবনের সঙ্গে এই সাহিত্যের যোগ এতটাই নিবিড় ছিল যে আর্নল্ড এই যুগের সাহিত্যের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন জীবনেরই সমালোচনা (criticism of the life)। রোমান্টিক যুগের কল্পনার উচ্চ মিনার থেকে সাহিত্য সাধারণ মানুষের জীবনের সমভূমিতে নেমে এল। গণতান্ত্রিক নেতা ও বৈজ্ঞানিক ভাবনার অজস্র প্রভাব দেশের সামাজিক ইতিহাসকে বিবর্তিত করেছিল আর সেই সমাজের প্রতিফলনই পড়ল সাহিত্যে। অবশ্য ভিক্টোরীয় যুগের প্রথমদিকে পুরোনো, চলিত মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিক মূল্যবোধের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখা গেছে। ফলে সমৃদ্ধির সঙ্গে শান্তি ও তৃপ্তিবোধও ভিক্টোরীয় যুগের প্রথম দিকে সাহিত্যে দেখা যায়।


কিন্তু ভিক্টোরীয় যুগের মধ্যভাগে চলিত সুস্থিতির বিরুদ্ধে আবার প্রতিবাদের ঝড় ঘনিয়ে এল। ডারউইন, হাক্সলি প্রমুখের নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এই সামাজিক তৃপ্তিবোধকে দিল সজোরে ধাক্কা। সাহিত্যে ও বিজ্ঞানেও বস্তুবাদ (materialism) প্রাধান্য বিস্তার করল। প্রচলিত আধ্যাত্মিক ভাবনার জগত হয়ে উঠল নড়বড়ে। যুক্তির আলোকে ঈশ্বর বিশ্বাসেরও চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হল। এই সময়ের আর্নল্ড, ফিটজারেন্ট প্রমুখ কবিদের কাব্যে এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যাবে।


এ তো গেল ভাব ভাবনার ক্ষেত্রে রোমান্টিক যুগের সঙ্গে ভিক্টোরীয় যুগের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কথা। কিন্তু পার্থক্যেই কী সব? সাদৃশ্য কী একেবারেই অনুপস্থিত। রোমান্টিক যুগের যে ভাব-কল্পনা তা ভিক্টোরীয় যুগেও একেবারে বিরল নয়।


এই যুগের টেনিসন, ব্রাউনিং, থ্যাকারে, আর্নল্ড প্রমুখের ভাবনা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে রোমান্টিক কল্পনাবিলাস প্রথম থেকেই মেদুর ছায়া বিস্তার করেছে এবং ভিক্টোরীয় যুগের মধ্যপর্ব পেরিয়ে ১৮৭৫-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমান্টিকতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। এই সময়ে শিল্পে ও সাহিত্যে যে আবার নতুন আদর্শবাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাকেই বলা হয় নব-রোমান্টিকতাবাদ (Neo-romanticism)। ভিক্টোরীয় যুগের প্রথম ও মধ্যপর্বে সাহিত্যসৃষ্টিতে দর্শন ও বিজ্ঞানের উপর বেশীমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার অনেকটা প্রতিক্রিয়ারূপেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠল প্রি-র‍্যাফেলাইট আন্দোলন (Pre-Raphaelite Movement)। মধ্যযুগীয় সরল বলিষ্ঠ রীতিনীতি, ইন্দ্রিয়-মোহ রচনা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্যজগৎ সৃষ্টি, আদর্শবাদ এবং সৌন্দর্যপ্রেম—এই কবিগোষ্ঠীর সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্য এবং এই বৈশিষ্ট্য এঁদের পূর্বসূরীরূপে রোমান্টিক কবি কীট্স ও শেলির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এমন কি নিউম্যানের (Cardinal Newman) 'অক্সফোর্ড মুভমেন্ট'-এও মধ্যযুগীয় রীতিনীতির প্রতি যে ঝোঁক দেখা যায় তা এই রোমান্টিক প্রবণতারই ফলশ্রুতি।


বাংলা সাহিত্যেও ইংরেজী রোমান্টিক সাহিত্যের ঢেউ লেগেছে। ভিক্টোরীয় যুগে—উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, মহাকবি মধুসুদন কাব্যের বহিরঙ্গে মিল্টনীয় ক্লাসিক ভঙ্গিকে অনুসরণ করলেও অন্তরে অন্তরে তিনি ছিলেন রোমান্টিক। তাঁর চোখে ছিল সমুদ্রের স্বপ্ন, কিন্তু অন্তর্জগতের ঘাটে 'খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনি'। হেমচন্দ্র ক্লাসিক ভঙ্গির অনুসারী কিন্তু তাঁর রচিত বঙ্গ গীতিকবিতা তাঁর রোমান্টিক অনুরক্তিরই পরিচয়বাহী। নবীনচন্দ্র স্পষ্টতঃ বায়রনী কল্পনার ভক্ত।


বঙ্কিমচন্দ্র এবং বঙ্কিম-অনুসারী ঔপন্যাসিকগণ স্কটের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। বঙ্কিমের ‘কমলাকান্ত ডি-উইন্সিকে স্মরণ করায়। শেলির ইনটেলেকচুয়্যাল বিউটি'র সঙ্গে বিহারীলালের ‘সারদা' কল্পনার সাদৃশ্য রয়েছে, আরও বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের 'মানসী' ও 'মানসসুন্দরী’র সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের উপর ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কীটসের প্রভাবও লক্ষণীয়। এ ছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল প্রমুখ কবিরাও ইংরেজী রোমান্টিক কবিদের দ্বারা প্রভাবিত।


বস্তুত উনিশ শতকের এই দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ইংরেজী রোমান্টিক কবিদের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছিল, ব্যাপ্ত করে ফেলেছিল বাংলা সাহিত্যের আকাশ, আর এই রোমান্টিক আকাশেরই উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।