'দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস' নাটকের ‘শাইলক' চরিত্রটি সম্বন্ধে আলোচনা করো।

শেক্সপিয়র রচিত কমেডি নাটক 'দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস' (The Merchant of Venice)। রচনাকাল সম্ভবত ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ। এই নাটকের নায়ক বন্ধুবৎসল, মহাশয়, ধনী ব্যবসায়ী অ্যান্টোনিও। অ্যান্টোনিও যদি নায়ক হন, তবে নিশ্চিতরূপেই প্রতিনায়ক সুদখোর ইহুদি ব্যবসায়ী শাইলক। চরিত্রটি শেক্সপিয়রের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। অনেকে একেই বলেছেন নায়ক। চরিত্রটি বুদ্ধি, প্রতিহিংসা, ধূর্ততা, অপমানবোধ প্রভৃতি নিয়ে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।


নাটকে দুটি কাহিনী রয়েছে, একটি চুক্তি-কাহিনী (Bond story), অপরটি পেটিকা-কাহিনী (Casket-story) কাহিনী দুটি দ্বিবেণীতে গ্রন্থিত হয়ে বিচারপ্রার্থী শাইলকের বিচারসভায় এসে মিলেছে। আর একটি ছোট্ট কাহিনী গড়ে উঠেছে শাইলক কন্যা জেসিকা ও খ্রিস্টান যুবক লরেঞ্জোকে কেন্দ্র করে।


ইহুদী শাইলক একজন সুদখোর মহাজন এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে বাস করেও সে নিঃসঙ্গ। আর এই মহাজনী কারবারের জন্য সে খ্রিস্টানদের কাছে পরিত্যক্ত। তার সঙ্গে কেউ সামাজিক মেলামেশাও করত না। অ্যান্টোনিও না। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে বন্ধুকে বিপদ থেকে ত্রাণ করতে সাময়িকভাবে সে শাইলকের শরণাপন্ন হল। বন্ধুর জন্য অ্যান্টোনিওর প্রয়োজন তিন হাজার ডাক্যাট। শাইলকের শত্রুপক্ষ অ্যান্টোনিও। সেই অ্যান্টোনিও আজ তারই শরণাপন্ন এবং তারই খপ্পরে পড়েছে। শাইলক উল্লসিত। এই সুযোগে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করতেও সে ছাড়ে না। বলে প্রয়োজনে ধার দেওয়া টাকার জন্য সে সুদ (interest) নেয়, আর অ্যান্টোনিও টাকা বিনিয়োগে ব্যবসা করে লাভ (profit) নেয়। সুদ ও লাভ নামকরণে এই পার্থক্য থাকলেও ব্যাপারটা একই। কাজেই যদিও অ্যান্টোনিও তাকে ঘৃণা করে, কিন্তু দু'জনে একই নৌকার যাত্রী। অ্যান্টোনিও তার গায়ে থুতু ছিটোলেও, তাকে 'অবিশ্বাসী’, ‘গলাকাটা কুত্তা’ এসব বললেও এসব কথা এখন সে মনে রাখছে না। বন্ধুত্বের হাত সে প্রসারিত করেছে এবং অ্যান্টোনিওর প্রয়োজন মেটাতে বিনা সুদেই তিন হাজার ডাক্যাট ঋণ দিতে সে আগ্রহী। তারপর যেন মজা করার জন্য একটা শর্তের প্রস্তাব যোগ করল। যদি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করা না হয় তাহলে এক পাউণ্ড মাংস বুক থেকে কেটে দিতে হবে। এটাকে সবাই মজা বলেই ভেবেছে। এর কোনো গুরুত্ব কেউ দেয়নি।


শাইলক ধনী মহাজন হলেও সে ছিল খুব কিপটে। এই অতিরিক্ত কিপটেপনার জন্য তার বাড়ির চাকর-বাকরেরাও তার বাড়িতে বেশিদিন কাজ করতে চাইত না। তার একমাত্র মেয়ে জেসিক (Jessica) কাছে বাড়ির পরিবেশ ছিল। নিরানন্দময়, একঘেয়ে, নরকতুল্য। জেসিকাও ছিল লঘুচিত্ত। একদিন সে বাবার টাকা-পয়সা যতখানি পারে চুরি করে এক ক্রিশ্চিয়ান বন্ধুর হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। মেয়ের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহারে সে অনভ্যস্ত হলেও, মেয়েকে অন্তর দিয়েই সে ভালবাসতো। এই চুরি করা জিনিসের মধ্যে একটা আংটিও ছিল। এই আংটি জেসিকার মা দিয়েছিল তার বাবাকে। একদিন মেয়ের শোক, টাকা-পয়সা এমনকি স্মারকচিহ্ন, আংটিটা হারানোর শোক তাকে পাগল করে তুলল। শুধু তাই নয় তার স্ত্রীর দেওয়া এই স্মারক আংটিটা বিক্রি করে সেই টাকায় জেসিকা কিনল বাঁদর। জেসিকার এই ঘর থেকে পালানোর সঙ্গে এক ক্রিশ্চিয়ান যুবক জড়িত থাকায়, সে সমস্ত ক্রিশ্চান জাতটার উপরই নিদারুণ চটে গেল। তার কষ্টার্জিত টাকা, মেয়ে, সব কিছু হারানোর ফলে প্রায় অর্ধ-উন্মাদ হয়ে রাস্তায় যখন শাইলক এদের খোঁজাখুজি করছে, তখন তাকে দেখে ক্রিশ্চিয়ানরা তাকে ব্যঙ্গ করতে থাকল, রাস্তার ছেলেরা তাকে ইহুদী কুকুর বলে পিছনে পিছনে চিৎকার করতে থাকল। এই রকম এক দুঃসময়ে খবর এল অ্যান্টোনিওর বাণিজ্যতরীগুলো সমুদ্রের বুকে হারিয়ে গেছে। সময়মতো ঋণের টাকা পরিশোধ করা অ্যান্টোনিওর পক্ষেও দুষ্কর হয়ে উঠল। চারদিকের বিরূপ ঘটনায় উন্মাদ প্রায় শাইলক ক্রিশ্চান ব্যবসায়ী অ্যান্টোনিওকেই নিমিত্ত ধরে তার উপরেই প্রতিশোধের সব কিছু উশুল করতে চাইল। ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ না করে তার সুদ এক পাউন্ড মাংস। আর্থিক দিক দিয়ে এক পাউণ্ড মাংসের দাম কিছুই নয়, কিন্তু অ্যান্টোনিওকে ঘিরে সমস্ত ক্রিশ্চানদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার পক্ষে, প্রতিহিংসার পক্ষে চমৎকার। তার প্রতি অ্যান্টোনিওর পূর্বেকার বিদ্রূপ বাণীও তার নতুন করে মনে পড়তে লাগল। প্রতিহিংসায় পাগল শাইলক তার শর্তানুযায়ী অ্যান্টোনিওর বুক থেকে এক পাউণ্ড মাংস আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হল। অ্যান্টোনিওর জন্য একবিন্দু সহানুভূতিও তার নেই। শর্তানুযায়ী আইন তার পক্ষে জেনে সে তার ছুরি শানাতে লাগল। উকিলের ছদ্মবেশ পরিহিতা পোর্সিয়া আদালতে অ্যান্টোনিওর পক্ষে মানবিকতার কারণে শাইলকের ক্ষমা প্রার্থনা করল। কিন্তু শাইলক রাজী নয়। মাংস তার চাই। আদালতও নিরুপায়, শর্তানুযায়ী এ দাবী মঞ্জুর হল। শাইলকের ছুরি শানানোর কাজও সম্পূর্ণ। সে এগিয়ে এল অ্যান্টোনিওর দিকে।


এই সঙ্কটকালে রুদ্ধশ্বাস আদালতের সামনে পোর্শিয়া শাইলককে থামতে বলল। আদালতকে সম্বোধন করে বলল, অ্যান্টোনিওর বুক থেকে এক পাউণ্ড মাংস সে নিতে পারে, আদালতও তা অনুমোদন করেছে, কিন্তু মাংসের সঙ্গে রক্ত অনুমোদন করেনি। এই মাংস কাটতে গিয়ে এক ফোঁটা ক্রিশ্চিয়ান রক্ত পড়লে চলবে না। তা শর্তের বাইরে। কোনো জীবন্ত শরীরে রক্তপাত বাদ দিয়ে মাংস কেটে নেওয়া অসাধ্য। বাধ্য হয়ে বিরত হল শাইলক ক্রিশ্চিয়ান হত্যার এই ষড়যন্ত্রের জন্য শাইলকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল, তার কন্যা তো আগেই তাকে পরিত্যাগ করেছিল, তাকে ধর্মচ্যুত বলেও ঘোষণা করা হল।


সবদিক দিয়েই হতাশ হয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ, সহানুভূতিশীল অপমানিত, সর্বস্বহারা এই বেদনাঘন ট্র্যাজিক চরিত্রটি পাপের চেয়েও বেশি শান্তির বোঝা মাথায় নিয়ে সমাজের মঞ্চ থেকে বিদায় নিল।


মার্চেন্ট অব ভেনিস—কমেডি নাটকের সুনীল আকাশের বুকে শাইলক চরিত্রটি একখণ্ড বেদনার কালো মেঘ। ফলে নাটকটি কমেডি হয়েও এই শাইলকের কারণেই হয়ে উঠেছে ট্রাজি-কমেডি।