উনিশ শতকের প্রথমদিকের রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী ও কীটসের ওপর ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব আলোচনা করো।

ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ এমন মন্তব্য করে থাকেন যে ওয়ার্ডওয়ার্থ ও শেলীর কবিতায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবের ঝড় বয়ে গেছে।- সেই ঝড়ের স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।


দেশের বাইরের যেসব আন্দোলন উনিশ শতকের প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের মাটিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল, ফরাসী বিপ্লব তার মধ্যে অন্যতম। ফরাসী বিপ্লবের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত শুধু ফ্রান্স নয়, অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে সমস্ত পশ্চিম ইউরোপেরই মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল। এই ফরাসী বিপ্লবের মূল কারণ ছিল একদিকে বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক রুশো (Rousseau), ভলটেয়ার (Voltaire) প্রমুখ বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিকগণের শিক্ষা এবং অপরদিকে যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত অবর্ণনীয় অত্যাচার ও শোষণ। এই প্রখ্যাত দার্শনিক তাদের সমকালীন মানুষের মধ্যে সুন্দর পৃথিবী, অত্যাচার ও শোষণহীন সমাজের ছবি ফুটিয়ে তুললেন। সুস্থ জীবনযাপনে যুক্তি ও প্রেম-প্রীতির কথা বললেন। আর বললেন চলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির অকর্মণ্যতার কথা। তাঁদের মতে এই প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও কুসংস্কারের ধ্বংসাবশেষ। এবং সমাজ ও দেশের প্রচলিত প্রথা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান করলেন এবং এই প্রচলিত প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসস্তূপের ওপর ন্যায়সম্মত আচরণ ও ভালবাসাকে ভিত্তি করে নতুন জগৎ (New World) গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এইভাবেই এই দার্শনিকবৃন্দ শুধু তাঁদের নিজেদের দেশেই নয়, সমগ্র ইউরোপের তৎকালীন যুব-মানসের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এইভাবেই জমি তৈরি হল এবং এই তৈরি জমির ওপরই ঘনিয়ে এল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসী বিপ্লব। ফ্রান্সে বাস্তিল দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জাতির জীবনে নতুন প্রভাতের প্রত্যাশাও জাগিয়ে তুলল। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল বিপ্লবী ফরাসী মন।


এই সময়ের ইংরেজ রোমান্টিক কবিরাও ইতিহাসের এই বিপ্লবীক্ষণে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণীতে, নতুন সমাজ সৃষ্টির কল্পনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে এই বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত উক্তি-

Bliss was it in that down to be alive,

But to be young was very Heaven !


ঘটমান ফরাসী বিপ্লবের মহাসংঘটনের দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে ওয়ার্ডওয়ার্থ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে তিনি ফ্রান্সে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যোগ দিলেন সংগ্রামী গিরণ্ডিস্ট (Girondists)-দের দলে। অবশ্য এই সময়ে তাঁর অভিভাবকেরা ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাসোহারা বন্ধ করে দেবার ফলে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বাধ্য হন। নইলে গিরভিস্টদের দলপতিদের ভাগ্যের সঙ্গে তাঁর ভাগ্যও যুক্ত হত। কবির যৌবনের কল্পনারঙিন দিনগুলিতে লন্ডন থেকে প্যারিসের আকর্ষণই ছিল দুর্নিবার। কিন্তু সেই বিপ্লব যখন সীমাতিক্রমী হানাহানি রক্তপাতে পর্যবসিত হতে চলল, প্যারিসের রাস্তাঘাট অকারণ রক্তপ হয়ে উঠল পিচ্ছিল, রাজা ও রাজপরিবারের প্রাণদণ্ডের পর, নেপোলিয়নের মধ্যে নতুন রাজা হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দিল, তখন ওয়ার্ডওয়ার্থের উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করল এবং হয়ে পড়লেন হতাশাগ্রস্ত। কবির মানসিকতার এই সঙ্কটময় কালে কবি-ভগিনী ডরোথির সাহচর্য কবিকে অনেকটা প্রবোধিত করল, ডরোথি কবিকে আবার প্রকৃতিমুখী করে তুলল। এইভাবেই কবি হয়ে উঠলেন প্রকৃতিপ্রেমী। ইংরেজি সাহিত্যেও এক নতুন যুগ সম্ভাবিত হয়ে উঠল। নেপোলিয়নের সুইজারল্যান্ড অভিযানের সংবাদ কবির মনে আবার আঘাত হানল। প্রজাতন্ত্রী বা গণরাজ্যবাদী ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের মৃত্যু হল। তার ওপর জেগে উঠল প্রকৃতিপ্রেমী ওয়ার্ডসওয়ার্থ। অত্যাচারী নেপোলিয়নকে তিনি ধিক্কার জানিয়ে স্বাধীনতার মহিমা বিঘোষক কয়েকটি কবিতা এই সময়ে তিনি লিখেছিলেন। প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কবির ভেঙে গেলেও তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন রুশোর শিষ্য এবং গণতন্ত্রী। তিনি ভাবলেন রাষ্ট্রবিপ্লবের দ্বারা সমাজের পরিবর্তন তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু কবিতার মাধ্যমে মানুষের চিত্তের পরিবর্তন ঘটাতে এবং মানুষের জন্য মানুষের হৃদয়কে প্রশস্ত করতে তিনি চেষ্টা করতে পারেন। এইভাবেই বিপ্লবের তত্ত্বগত দিক এবং রুশোর শিক্ষা তাঁকে প্রবুদ্ধ করল। রুশোর মধ্য দিয়ে তিনি খুঁজে পেলেন বিপ্লবের অভ্যর্থক দিক—‘প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন জীবনের মৌলিক, আদিম জীবনাচরণ। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার ওপর মানব-সমাজের পুনঃস্থাপন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সরল সম্পর্কের পুনর্গঠন।' এরপরই অকৃত্রিম সাধারণ জীবন ও সাধারণ প্রকৃতি এবং মানুষের ওপর প্রকৃতির প্রভাবই হয়ে উঠল তাঁর কবিতার বিষয়। এইভাবেই ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবনে ও কাব্যে দার্শনিক রুশোর বিশেষ প্রভাব আমরা দেখতে পাই এবং এইভাবেই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ আগুন এবং ঝড় তাঁর কাব্যে বড় হয়ে না উঠলেও সেই মহাবিপ্লবের মহাআন্দোলনের মধ্যেকার স্থির বিন্দু মানবতার উন্নতি ও প্রশান্তির জন্য তিনি আজীবনই কলম চালিয়েছেন। তিনি অসির চেয়ে মসীকেই বড় করে দেখেছেন।


একই রোমান্টিক আন্দোলনের পথিক হয়েও কবি শেলী ওয়ার্ডসওয়ার্থের পরবর্তী পর্যায়ের কবি, প্রথমদিকে ফরাসী বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে বিপ্লবের পরোক্ষ প্রভাবেই ওয়ার্ডওয়ার্থের কাব্য দীপ্যমান। কিন্তু শেলীর জন্ম ফরাসী বিপ্লবের সূতিকাগারে (Child of the French Revolution)। শেলী (সমকালীন কবি বায়রনও) ছিলেন সর্বপ্রকার বন্ধনমুক্তির নিষ্ঠ উপাসক এবং কর্মেও মননের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠার অন্ধ সমর্থক। ইনি ছিলেন আমূল সংস্কারপন্থী, নিজস্ব প্রেরণা ছাড়া আর কোনো নিয়মকেই মানতে চাননি। প্রচলিত নিয়মকানুনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এই মানুষটির অনুরাগ ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি, প্রচণ্ড আবেগ এবং অদম্য স্বাধীনতাস্পৃহা। প্রবীণ কবিদের তুলনায় ঐতিহাসিক ফরাসী বিপ্লবের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অবশ্য এই নবীন কবির ছিল না, আর সম্ভবত এই কারণেই ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ কবির উৎসাহে অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। তাই শেলী, এই ফরাসী বিপ্লবের সন্তান শেলী হয়ে উঠেছিলেন সেই বিপ্লবের চারণ-কবি। শেলীর কাব্যকল্পনায় বাস্তবতার চাইতে অবাস্তব বা বিমূর্ত ভাবনা এবং প্রবল আশাবাদই প্রাধান্য বিস্তার করেছে। তথ্যনিষ্ঠতা ও ব্যক্তিনিষ্ঠতার পরিবর্তে এই কল্পনাই তাঁকে বেশ সম্মোহিত করেছে। তাঁর শ্বশুর উইলিয়ম গডউইন কর্তৃক প্রচারিত বিপ্লব-সম্পর্কীয় মতবাদ তাঁকে সম্পূর্ণরূপে আবিষ্ট করেছিল এবং ফরাসী বিপ্লবের ঘটনার বীভৎসতা ও জটিলতা তিনি উপেক্ষাই করেছিলেন। পরবর্তীকালে ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ধরতা-কথা (catch-word) শেলীর চেয়ে বেশি আর কোনো রোমান্টিক কবিকেই প্রভাবিত করেনি। ঘটনার তাৎক্ষণিক বীভৎসতা, ধ্বংস ও দুর্বিপাকের ওপারে মানবসমাজের ভবিষ্যৎ পুনর্নির্মাণকে তিনি দেখতে পেতেন। বর্তমানের ধ্বংসস্তূপের ওপর নবজন্ম লাভ করে এক নতুন পৃথিবীর পরম সুন্দর উজ্জ্বল চিত্র তিনি দেখতেন এবং তাতে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। রাজনীতির দায়িত্ব তিনি তাঁর কবিতা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বরণ করে নিয়েছিলেন, আর এই দায়িত্ববোধই তাঁকে এই সৃজনীমূলক সাহিত্য রচনায় প্রেরণা জুগিয়েছে। মানবসমাজ পুনর্গঠনের এই আবেগ এবং প্রত্যাশিত আগামী স্বর্ণযুগ (millenium) সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীই হচ্ছে তাঁর চমৎকার গীতিকবিতাসমূহ এবং 'দ্য কুঈন ম্যাব' (The Queen Mab), 'দ্য রিভোল্ট অব ইসলাম' (The Revolt of Islam), 'প্রমিথিউস আনবাউন্ড্' (Prometheus Unbound) প্রভৃতি কাব্য-কবিতাগুলির মূল বিষয়বস্তু। মুক্তির জন্য তাঁর কামনা ছিল আন্তরিক এবং তাঁর মতে এই স্বাধীনতা বা মুক্তি সংযম থেকে মুক্তি নয়। তাঁর মতে মুক্তি মানে স্বেচ্ছাচার বা ব্যভিচার নয়, তা নৈতিক শক্তিকে বিধৃত—আপন বিবেকের দ্বারা শীলিত। তাঁর পরিকল্পিত এই নতুন সাম্রাজ্যে প্রেমের শাসনই বড় শাসন এবং কবি বিশ্বাস করতেন এই প্রেমই সমস্ত মৃন্ময় পদার্থকে চিন্ময় ও সুন্দর করে তুলবে। এইভাবেই বিপ্লবের চারণ-কবি শেলী হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবের দার্শনিক (metaphysical) কবি।


কবি কীটস্‌ও বিদ্রোহী। তবে সে বিদ্রোহ বায়রন বা শেলীর বিদ্রোহ নয়। চলমান রাজনৈতিক ও সমাজব্যবস্থার প্রতি কবির কোনো আস্থা ছিল না এবং তিনিও নতুন মানবসমাজ ও সভ্যতার স্বপ্ন দেখতেন। আর এই স্বপ্ন কবিকে নিয়ে গেছে সৌন্দর্যের স্বপ্নিল জগতে। এই সুন্দরই কবির কাছে সত্য এবং সত্যই সুন্দর। ফরাসী বিপ্লবের অভিঘাত কবি কীটস্‌কে মানবচৈতন্যের বিস্তৃত জগতে মুক্তি দিয়েছে। আর এই অর্থে বায়রন ও শেলীর সমকালীন কবি হয়েও তাঁদের সঙ্গে তিনি এক গোত্রভুক্ত হয়ে ওঠেননি। তিনি হয়েছিলেন একজন পৃথক ও বন্ধনমুক্ত নান্দনিক কবি। তাঁর এ বিদ্রোহ সমকালের প্রেক্ষাপটে নান্দনিক বিদ্রোহ। কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল এবং অকালে ১৮২১-এ মাত্র ছাব্বিশ বৎসর বয়সে যক্ষ্মারোগে তাঁর দেহাবসান হয়।


কিন্তু জীবনের সেই কঠোর সংগ্রামের কথাও কাব্যে কোথাও স্থান জুড়ে বসেনি। হোমাগ্নির আগুনে নিজে দগ্ধ হয়েও গন্ধপুষ্পের সৌগন্ধ তিনি কাব্যে বিতরণ করে গেছেন। কবির এই বিদ্রোহ মানসিক বিদ্রোহ এবং নিশ্চিতরূপেই তা বায়রন এবং শেলী থেকে ভিন্ন গোত্রের। কাব্য-বীণায় তাঁর সুর পৃথক সুর।