"সুদূর অথচ ব্যর্থ এক দেবদূত, শূন্যে ঝাপটাচ্ছেন তাঁর উজ্জ্বল ডানা”—কবি শেলী সম্বন্ধে উক্তিটি কতখানি প্রযোজ্য শেলীর দুটি কবিতা অবলম্বনে এই প্রশ্নের উত্তর দাও।

সুতীব্র আবেগ, সূক্ষ্ম ভাবুকতা আর ভাষার তীব্রতা শেলীকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিৰূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। শেলী-রচিত দুটি বিখ্যাত কবিতা অবলম্বনে এই বক্তব্যের সার্থকতা বিচার করো।

কী কী গুণে শেলী ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিরূপে স্বীকৃত? তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত কবিতায় ওই গুণগুলির প্রতিভা বিষয়ে আলোচনা করো।


কবি শেলী (Percy Bysshe Shelley ১৭৯২-১৮২২ খ্রিঃ) যদিও এক অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবু তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত বেদনাময়। দেবদুতের মতো ছিল তাঁর আকৃতি। কিন্তু প্রকৃতি দেবদূতের মতো শান্ত ছিল না। পৃথিবীর বুকে যে অবিচার, অত্যাচার, যে অনাদর, অবজ্ঞা, উপেক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, তা তাঁকে নিয়ত পীড়িত করত, তিনি দুঃখকাতর হয়ে পড়তেন। হৃদয় হত ক্ষতবিক্ষত। ছাত্রাবস্থাতেই এ-সবের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই শুরু করেন। এক্ষেত্রে তাঁর মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কবি শেলী ছিলেন মানবদরদী। তাঁর এই মানবপ্রীতি ছিল ধর্ম, বর্ণ ও দেশ-নিরপেক্ষ। তিনি চেয়েছিলেন যে প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক মানুষ সুখী হোক, স্বাধীন জীবনযাপন করুক। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে আজ মানবকণ্ঠ রুদ্ধ, বাঁশী সঙ্গীতহারা, সে কণ্ঠরোধ করেছে সমাজ, ধর্ম আর মানুষের গড়া সহস্র প্রতিষ্ঠান। কবি চেয়েছেন মানুষকে পুঞ্জীভূত আবর্জনার স্তূপের থেকে বাইরে নিয়ে আসতে। মুক্তির খোলা হাওয়ায় ও অবারিত আলোকে মানুষের স্বচ্ছন্দ বিচরণই তাঁর একমাত্র কাম্য ছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ছিল তাঁর অসীম শ্রদ্ধাবোধ। যেখানে তিনি স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দেখেছেন সেখানেই তিনি প্রাণ খুলে আনন্দের গান গেয়েছেন। দূর শূন্যে ছিল তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ। তিনি ঘোষণা করেছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। কবি শেলী ছিলেন প্রবল আশাবাদী এবং আজীবন তিনি এই আশাই পোষণ করেছেন যে বর্তমান যুগের অনাচার, অত্যাচার একদিন নিশ্চয়ই দূরীভূত হবে। অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্যের শীত আজ রয়েছে, কিন্তু 'বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'। 'If Winter comes, can Spring be far ‘behind ?' শীতের অস্তে বসস্ত তার প্রাচুর্যের ভরা ডালি নিয়ে এসে হাজির হবে। বিশ্বে আবার স্বর্গরাজ্য নেমে আসবে। শেলীর এই প্রবল আশাবাদী কল্পনাপ্রবণতার জন্য ম্যাথু আর্নলড তাঁকে বলেছেন নিষ্ফল দেবদূত – beautiful and ineffectual angel, beating in the void his luminous wings in vain.' কিন্তু ম্যাথু আর্নল্ড-এর এই শেলী সমীক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হওয়া যায় না। কবি শেলী স্বপ্নদর্শী হলেও তাঁর কবিতা, নাটক ও গদ্যে আপন বক্তব্য সতেজ কণ্ঠেই প্রকাশ করে গেছেন। এবং তাঁর আপন ব্যক্তি-জীবন ও কাব্য জীবন ভাবনার মধ্যে ফারাক ছিল না। মাটির পৃথিবীতে তিনি স্বর্গ রচনা করতে পারেননি। কিন্তু স্বর্গ রচনার জন্য সংগ্রামে তিনি ছিলেন অবিচল। তবু না পারার জন্য যদি তাঁকে ব্যর্থ বলতে হয়, তাহলে মানব-সভ্যতার ইতিহাসে বহু স্মরণীয় ব্যক্তিত্বই ব্যর্থ। কাজেই জাতির ইতিহাসে এই ব্যর্থতা নিন্দিত নয়, নন্দিত।


কবি শেলী বাল্যকাল থেকেই প্লেটোর দর্শনের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। প্লেটোর মতো শেলী বিশ্বাস করতেন যে এই সৃষ্টির পিছনে এক মহান শক্তি বিরাজ করছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সারা বিশ্বে মহাজীবনের ধারা ছুটে চলেছে। ব্যক্তি-জীবন বিচিত্ররুপে প্রকাশিত, কিন্তু এক মহাজীবন এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমগ্র বিশ্বে এক প্রীতির অমৃতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। ঈশ্বর শুধু প্রেমময় নন, তিনি সৌন্দর্যের প্রতীক। তাই রূপজগতের বিচিত্র সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে শেলী সেই অরুপ রতনকে খুঁজতে চেয়েছিলেন।


কবি শেলী ছিলেন প্রকৃতির উপাসক। প্রকৃতির ফুল ফল আকাশ আর মাটির সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক বন্ধন। প্রকৃতিকে তিনি চিন্ময়রূপে দেখেছেন। প্রকৃতিকে তিনি জীবন্ত বলে মনে করতেন। শেলী যখন প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন, তখন প্রতিটি বর্ণনা এক অপরূপ চিত্রে বর্ণিত হয়েছে। শেলীর ফুলকে নিয়ে লেখা কবিতায় ফুলের বহিঃ-সৌন্দর্যের বর্ণনা ও রসোপলব্ধি আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আছে শিশিরাশ্রুসিক্ত, ক্ষণস্থায়ী জীবনের করুণ আবেদন। শেলীর নিকট ফুল একদিকে মানুষের মতো জীবন্ত ও সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যমালার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। শেলী শুধু আশাবাদী ছিলেন না, আদর্শবাদীও ছিলেন। তাঁর উপমা বা চিত্রকল্পে জীবনের কোনো অশুচি স্পর্শ নেই। আলো বাতাস মেঘ জল ফুল সমুদ্র ইত্যাদি উজ্জ্বল চিত্রগুলিই তাঁর কাব্যে বহুল ব্যবহৃত। মাঝে মাঝে তিনি এমন দৃশ্যপট অঙ্কন করেছেন যা একান্তভাবে ভাবমূর্তি। প্রকৃতির বাস্তব সত্তার সঙ্গে তা সম্পর্করহিত। শেলীর চিত্রকল্পগুলি অনেক সময় উদ্দাম ও বৃহৎ পটভূমিকায় পরিবেশিত।


শেলীর অধিকাংশ কবিতা অনুপ্রেরণায় আবেগময় মুহূর্তে রচিত। অনুপ্রেরণার মুহূর্তে তিনি যেসব ভাবাবেগ দ্বারা বিচলিত, তাদের সবগুলিই বিনা বিচারে সংগ্রথিত করার দিকে তাঁর ঝোঁক। অবশ্য যখন তিনি পরিণত ও সচেতন তখন রূপাঙ্গিকের এই দোষ থেকে তিনি মুক্ত। ভাবুকতা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। প্রত্যক্ষ জগৎকে তাঁর মনে হয়েছে এক মহাভাবের অভিব্যক্তি। প্রেমময় এক অদৃশ্য সত্তার অভিব্যক্তি। এই ভাবুকতা ও আবেগের তীব্রতা তার কথার সঙ্গে তার শরীরকে তীব্র, তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। আমরা টু এ স্কাইলার্ক’ ও ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড' কবিতায় এর স্বাক্ষর পাব।


শেলীর 'টু এ স্কাইলার্ক' (To A Skylark) একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ কবিতা। কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের টু দ্য স্কাইলার্ক’ কবিতায় বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কবির নীতি প্রতিপাদনের অভ্যস্ত প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। শেলীর স্কাইলার্ক (ভরতপক্ষী) মাটির সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ অস্বীকার করেছে। সে আকাশের পথে অবিরাম উড়ে চলেছে। বিদায়ী সূর্যের আলোকধারায় স্নাত, অস্তসূর্যের রঙে রঞ্জিত মেঘপুঞ্জে বিলীন পাখির যেন মাটির সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই। তার গান জ্যোৎস্নাধারার মতো শুভ্র-উজ্জ্বল ও সর্বব্যাপী। কবি ভেবে নিয়েছেন জীবন মৃত্যুর যে চিরন্তন রহস্য মাটির মানুষের চিন্তাধারাকে ব্যাহত করে, এই পাখি অলৌকিক উপায়ে যেন সেই রহস্যের চাবিকাঠির খোঁজ পেয়েছে। সেইজন্যেই তার গান এত স্বতঃস্ফূর্ত বাধাবন্ধনহীন এবং দিব্যভাবপূর্ণ। এই পাখির গানকে উপলক্ষ্য করে ব্যাকুল আত্মজিজ্ঞাসা ও অশান্ত চিত্তবিক্ষোভ মুক্তিলাভ করে। ছন্দের হ্রস্ব প্রসার ও ক্ষিপ্রগতিতে, উপমার মুহুর্মুহু পরিবর্তনে এবং সুরের তীক্ষ্ণ মর্মভেদী মূর্ছনায় পাখির আকাশ বিহার আকাঙ্ক্ষা ও তার ডানার দ্রুত অশান্ত ঝাপ্‌টান আশ্চর্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে।


শেলী ছিলেন বিপ্লবপন্থী। সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ছিল তাঁর কাম্য। এই হিংসা-জর্জর অত্যাচারপূর্ণ মানবসমাজকে তিনি নতুনভাবে গড়তে প্রয়াসী ছিলেন। সমাজের প্রভুশ্রেণি কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধের পরিবর্তে অবাধ, অক্ষুণ্ণ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাবৃত আত্মনিয়ন্ত্রণই ছিল শেলীর নবগঠিত সমাজের নিয়ামক শক্তি। আদর্শবাদের স্বপ্ন জীবনবৃত্তে ফুটে উঠুক, আশ আনন্দে জীবন ভরে উঠুক—এই ছিল শেলীর কাম্য।


শেলীর 'ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড' (Ode to the West Wind) আরও একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। ঋতুর শেষে ঝঞ্ঝাবাত্যার মধ্যে শেলী বিশ্বশক্তির সৃষ্টি ও ধ্বংসকে এক করে দেখেছেন। দেখেছেন ফোটা ফুলের মেলার সঙ্গে ঝরা ফুলের খেলা। পশ্চিমা ঝড় যেমন জীর্ণ শীর্ণ পুরাতনের ধ্বংসকারী, অন্যদিকে তেমনি তরুণ, নতুন সমাজের অগ্রদূত। এই ঝড়, জল, স্থল, আকাশ কবির মনে অপ্রতিহত প্রভাবে আবর্তিত হয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির সর্বত্র এর অমোঘ শক্তির রুদ্রলীলা প্রকটিত। বহির্জগৎ থেকে কবির অন্তর্জগতে এই ভাবনার সংক্রমণও আশ্চর্য কলাকুশলতার সঙ্গে কবিতাটিতে চিত্রিত হয়েছে। কবির জীর্ণ চিন্তা, তাঁর অবসাদ ও অক্ষমতার খেদ, পুরাতনের সমস্ত ক্লেদ এই ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। নতুন উৎসাহ, উদ্দীপনা, প্রবল আশাবাদ কবির মনকে ভরিয়ে তুলেছে। এই নবদীপ্ত আলোকে তিনি অনাগত কালের গুহাহিত অধ্যায়গুলির রহস্য উদ্ঘাটন করে মানুষকে চিরন্তন আশার বাণী শুনিয়েছেন। শীত বসন্তের অগ্রদূত, শীত এলে বসন্তের আগমন কি বিলম্বিত হতে পারে। বহিঃপ্রকৃতি ও মানবমন প্রত্যক্ষ অনুভূতির নিবিড়তম একাত্মতায় অদ্বয় বন্ধনে ধরা পড়েছে। কবিতাটির বিষয়বস্তু গুরুগম্ভীর, এর গতি উদ্দাম। কিন্তু এর মধ্যে আছে কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি। তীব্র আবেগ ও স্পষ্ট আত্ম প্রতিবিম্বন ঘটেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড উদ্দামতার সঙ্গে কবি নিজেকেও একীভূত করে দেখেছেন। আবেগের তীব্রতার সঙ্গে ভাষার তীব্রতা যুক্ত হয়ে কবিতাটি অনবদ্য হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন কবির মানস যন্ত্রণা উদ্ঘাটিত—

I fall upon the thorns of life : I bleed


সেই সঙ্গে রয়েছে ভবিষ্যৎ স্বর্ণযুগের ইঙ্গিত— 

'If Winter comes, can Spring be far behind'?


কবিতাটিতে কবির আবেগ, ভাবুকতা ও বলিষ্ঠ ভাষার সঙ্গে বৈপ্লবিক কবিমানস ও আদর্শবাদী জীবন দর্শন পরিস্ফুট হয়েছে।


শেলীর অধ্যাত্মবোধ নানা ভাববৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত। এই অধ্যাত্মবোধ কোথাও সন্দেহে ম্লান, কোথাও অশান্ত আবেগে কম্পিত, কোথাও আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। শেলীর সমস্ত কাব্যজগৎ ওতপ্রোতভাবে এই অধ্যাত্মবোধের বিদ্যুৎদীপ্তিতে ভাস্বর। শেলী অতি সহজেই গ্রীক কবিদের ন্যায় প্রকৃতি সৌন্দর্যের মধ্যে মনুষ্যমূর্তির আভাস প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। এর সঙ্গে দার্শনিক অধ্যাত্মদৃষ্টি সংযুক্ত হয়ে তাঁর পরিকল্পনা অসামান্য সৌকুমার্যে মণ্ডিত হয়েছে। তিনি যেমন স্কুলের মধ্যে সুক্ষ্মকে দেখেছেন, জড়ের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করেছেন তেমনিই প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে শুধু মানুষের রূপ নয়, তার সুখ-দুঃখ ভরা অনুভূতিপ্রবণ অন্তরচেতনাও লক্ষ্য করেছেন। প্রকৃতির মধ্যে প্রাণের এই আরোপ তাঁর কাব্যের এক বিশিষ্টতম বৈশিষ্ট্য। সেইজন্য তাঁর কাব্যের এক অতিপুরাতন, যন্ত্রবদ্ধ, বিশ্বজগৎ ও মানবজীবনের জীর্ণ জরা সঙ্কুচিত ধমনী দিয়ে রূপ ও সৌন্দর্যের ঢেউ বয়ে গিয়েছে। এই সৌন্দর্য প্লাবনের প্রত্যেকটি তরঙ্গ তাঁর কাছে জীবন্ত। জগতের আশা, বেদনা, ভালোবাসা, বিষাদ, আনন্দ প্রভৃতি মানব-হৃদয়ের ভাবরাশি—সবই এক বিরাট আনন্দোৎসবে যোগদান করেছে।


শেলীর বিশ্বাস বর্তমান সমাজের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। তখন মানুষ হবে সুখী, হবে সমৃদ্ধ। অনাগত ভবিষ্যতে যথার্থ প্রেম মানুষকে সুন্দরতর করে তুলবে।