আধুনিক হিন্দী কাব্যসাহিত্যে মহাদেবী বর্মার ভূমিকাটি বিবৃত করো | হিন্দী কাব্যধারায় মহাদেবী বর্মার কবিকৃতিত্বের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করো।

হিন্দী সাহিত্যের আলোচকগণ মহাদেবী বর্মাকে 'আধুনিক কালের মীরা' বলে অভিহিত করেছেন। মহাদেবী বর্মার কাব্যপরিচয় প্রদান করে উক্ত অভিধা কতদূর সঙ্গত বিশ্লেষণ করো।


আধুনিক হিন্দী সাহিত্যে 'ছায়াবাদী' যুগপূর্বের এক অন্যতমা প্রধান কবি মহাদেবী বর্মা। মহাকবি নিরালার স্নেহধন্যা ও ভগ্নীতুল্যা মহাদেবী আশৈশব লালন করেছেন এক ভক্তিনম্র আত্মনিবেদিত অধ্যাত্মবোধ। তাঁর সমগ্র জীবন ও কাব্যের মধ্যেই যেন বিচ্ছুরিত হয়েছে সেই আত্মনিবেদিত ভক্তির আকৃতি এবং করুণার অনাবিল সৌন্দর্য।


মহাদেবী বর্মার কাব্যপ্রতিভা ও কবিমানসের পরিচয় গ্রহণ করতে গেলে তাঁর ব্যক্তিজীবনেরও সংক্ষিপ্ত পরিচয় গ্রহণ আবশ্যিক। কেননা যথার্থ কবিজীবন ও ব্যক্তিজীবন পরস্পরের পরিপূরক। যথার্থ কবি একই মানস-বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র-প্রবণতা থেকেই একযোগে রচনা করেন তাঁর জীবন এবং কাব্য।


উত্তরপ্রদেশের এক সুশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত কুলীন পরিবারে মহাদেবীর জন্ম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। দেবী মহামায়ার কাছে বহু প্রার্থনায় কন্যা সন্তানের জন্ম হলে নবজাতিকার নামকরণ করা হয় 'মহাদেবী'। মহাদেবী বর্মার মাতা হেমরানী দেবী ছিলেন সুশিক্ষিতা ও ভক্তিমতী। পূজার্চনার সময়ে হেমরানী প্রায়শই কবীর-সুরদাস-মীরার গানগুলি গাইতেন। শিশু মহাদেবী মায়ের পাশে বসে তন্ময় হয়ে সেই গানগুলি শুনতেন। অর্থাৎ শৈশব থেকে আত্মনিবেদিতপ্রাণ ভক্তির একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত উজ্জ্বল প্রভা মহাদেবী বর্মার ওপর পড়েছিল।


এ ছাড়াও শৈশব থেকেই পিতার হাত খরচের টাকা মহাদেবী নির্দ্বিধায় দরিদ্র-অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কোনো মানুষের, এমনকি পশুপাখিরও কোনো কষ্ট তাঁর প্রাণে করুণার প্লাবন ডেকে আনত। শৈশবাবধি ক্রমে ক্রমে বিকশিত এবং সযত্ন লালিত সুকুমার ভক্তিপ্রাণতা, আস্তিক্যচেতনা এবং করুণাই পরে এক দার্শনিক মাত্রা এবং কাব্যিক প্রকাশ লাভ করে।


মহাদেবীর কাব্যালোচনা প্রসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের অপর একটি দিকও উল্লেখযোগ্য। মহাদেবী শৈশব থেকে সংগীত ও চিত্রকলাতেও আগ্রহী ছিলেন। এই সংগীতিকতা ও চিত্রময়তাও তাঁর কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহ নেই।


মহাদেবীর বিবাহ হয়েছিল অতি শৈশবেই। কিন্তু এই বিবাহিত জীবন সুখকর হয়নি। তুচ্ছ প্রাত্যহিক সাংসারিকতার বন্ধন মহাদেবীর উদার ব্যাপ্ত মানসিকতার পক্ষে অনুকুল ছিল না। আত্মকেন্দ্রিকতা বা বস্তুগত স্থূলতার মধ্যে মহাদেবী তৃপ্তি পেতে পারেননি। তাই অচিরেই এই বিবাহ বন্ধনের সমাপ্তি ঘটে। এরপর মহাদেবী গভীর আগ্রহে পুনর্বার আত্মনিয়োগ করেন তাঁর অর্ধসমাপ্ত শিক্ষাকে সমাপ্ত করতে। প্রয়াগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। প্রয়াগের মহিলা বিদ্যাপীঠের প্রধান অধ্যাপিকা হিসাবে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। এখানেও অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার পাশাপাশি দরিদ্র আর্তের সেবায় তিনি আত্মোৎসর্গ করেন। উপনিষদ ও ভারতীয় দর্শনের গভীর পাঠের পাশাপাশি বৌদ্ধ সাহিত্যের নিবিড় অধ্যয়নও তাঁর ভাবজীবন ও জীবনদর্শন গঠনে সহায়তা করেছিল, যার ছায়াপাত ঘটেছে মহাদেবীর সাহিত্যে।


মাত্র ১৩-১৪ বৎসর বয়স থেকেই কবিতা রচনা শুরু করে মহাদেবী। সহজ মানবীয় বেদনা, আর্তের প্রতি করুণা, তুচ্ছ স্থূল বন্ধনের অবসান ঘটিয়ে বৃহৎ অনুভবের ক্ষেত্রে মুক্তির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি তাঁর কাব্যের প্রধান সুর।


মহাদেবীর কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—'নীহার', 'রশ্মি', 'নীরজা’, ‘সান্ধ্যগীত', 'দীপশিখা'। এ ছাড়া আছে ‘য়ামা’, ‘সন্ধিনী' এবং 'সপ্তপর্ণী' নামক একটি অনুবাদ কবিতার সংকলন। 'হিমালয়' হল তাঁর সম্পাদিত কাব্য সংকলন।


ছায়াবাদী কাব্যসাহিত্যের লক্ষণগুলি মহাদেবীর কবিতায় স্পষ্ট। প্রকৃতিচিত্রণ, প্রকৃতিসৌন্দর্যের মধ্যে অপার্থিব মহিমার উপলব্ধি, প্রকৃতির চিৎ-সত্তায় বিশ্বাস মহাদেবীর কবিতার এক বিশেষ লক্ষণ।


তাঁর কাব্যের দ্বিতীয় লক্ষণ হল প্রেমের জন্য তীব্র আকৃতি। প্রেমের মধ্যে যে সুকুমার হৃদয়বৃত্তি, সুকোমল অনুভবময়তা, সৌন্দর্যের পিপাসা ও আত্মত্যাগের উদার মহিমা আভাসিত হয়, তা পূর্ণভাবে প্রতিফলিত মহাদেবীর কবিতায়। তবে অবশ্যই এই প্রেম দেহগত প্রেমের স্থূল সীমায় আবদ্ধ নয়। মহাদেবীর কবিতায় প্রেম বিরহানুভূতি-প্রধান। এবং এই প্রেম রাধার প্রেমের মতোই যেন এক পরমাত্মার চরণে আত্মনিবেদনের অলৌকিক মহিমায় উত্তরণ লাভ করেছে।


মহাদেবীর কাব্যের অপর লক্ষণ আধ্যাত্মিক অভিব্যঞ্জনা বা রহস্যানুভূতি। জগৎ ও জীবনের নশ্বরতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও তাঁর কবিতায় জীবনপ্রীতি স্পষ্ট। জীবনের আনন্দ-দুঃখ, সুধা ও গরল একযোগে পান করেই তিনি এই স্থূল জগতের অতীত পরমসত্তার মহিমা উপলব্ধি করেন। জীবনের যন্ত্রণা অনুভবের মধ্যে পরমেশ্বরের উপলব্ধি তাঁর জীবন ও কাব্যের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আর এই রহস্য-ব্যঞ্জনা প্রকাশের কারণেই তাঁর কবিতায় সঞ্চারিত হয়েছে প্রতীকাত্মতা।


নিরালার মতোই মহাদেবী বর্মাও প্রধানত করি। তবু কাব্যচর্চার সমান্তরালে গদ্যসাহিত্যের চর্চাও করেছেন মহাদেবী। তাঁর গদ্যসাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'অতীত কে চলচ্চিত্র’, ‘স্মতি কী রেখাত্র’, ‘শৃঙ্খলা কী কড়িয়াঁ', ‘পথকে সাথী', 'ক্ষণদা’, ‘পরিক্রমা' ইত্যাদি। প্রথম গ্রন্থদুটিতে নানা খণ্ড স্মৃতি, আপাততুচ্ছ বহু প্রসঙ্গ, অপরিচিত-স্বল্পপরিচিত বা পরিচিত বহু মানুষের সান্নিধ্যজনিত অভিজ্ঞতা, টুকরো টুকরো অনুভব ইত্যাদি ধরা পড়েছে। সহজ সরল ভাষাবয়নে এই সমস্ত প্রসঙ্গগুলি কখনও মহাদেবীর উদার মহৎ উন্নত মানবিকতাটি চিনিয়ে দেয়, কখনও ধরিয়ে দেয় তাঁর আত্মনিবেদিত আধ্যাত্মিক সত্তাটিকে, কখনও তিনি নেমে আসেন সাধারণের সমতলে আবার কখনও তিনি সহজ বর্ণনার মধ্য দিয়েই পৌঁছে যান জগৎ-জীবন বা পরমাত্মা-জীবাত্মার লোকোত্তর প্রসঙ্গে। 'শৃঙ্খলা কী কড়িয়া’ গ্রন্থে আধুনিক ভারতীয় নারীর বিবিধ সমস্যাগুলির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।


বস্তুত মহাদেবী বর্মা প্রেম-বিরহ এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতির গীতিকার ও গায়িকা। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে এই প্রেমের আর্তি স্পষ্ট। সেই প্রেম আবার অনায়াসে মিলে গেছে অধ্যাত্ম-অনুভূতির সঙ্গে। পরমেশ্বর যেন তাঁর কবিতায় দয়িতরূপে ধরা দিয়েছেন। এইজন্যই তাকে হিন্দী সাহিত্যের আলোচকেরা বলে থাকেন ‘আধুনিক মীরা'। কেননা মীরাবাঈয়ের গীতগুলির মধ্যে পরমপুরুষ শ্রীকৃয়ে নিঃশেষ আত্মনিবেদনের যে আৰ্তি প্রকাশিত, তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় আধুনিক যুগের কবি মহাদেবীর কবিতায়।


তাঁর কবিতার সূচনা ঘটেছিল জীবনকে প্রেমের ও সৌন্দর্যের আলোয় উজ্জ্বল উপভোগের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু জীবনের নানা অভিঘাত, দাম্পত্যজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা, জীবনে বাস্তব প্রেমের অনুপস্থিতি, জীবনদর্শনের গভীরে নিহিত প্রেমের ব্যাকুল আকৃতি তাঁকে ক্রমশই ঠেলে দিয়েছে বিরহানুভূতির দিকে। পরবর্তীকালে তাই তাঁর কাব্যে প্রধান হয়ে উঠেছে বেদনার সুর।


জীবনের এই ক্ষণভঙ্গুরতা বা নশ্বরতার কথা বারংবার উচ্চারিত হয়েছে মহাদেবীর কবিতায়। সম্ভবত এর পিছনে বৌদ্ধ দর্শন অধ্যয়নের কিছু প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে—

“সিকতা মেঁ অঙ্কিত রেখা-সা, 

বাত-বিকম্পিত দীপ শিখা-সা.

কাল-কপোলোঁ পর আঁসু-সা 

ঢুল জাতা হো স্নান।"


জীবন যেহেতু নশ্বর, সেহেতু স্থূল পার্থিব ভোগ-সুখের মোহময় বন্দীদশা থেকে মুক্তির মন্ত্রই মহাদেবীর কাঙ্ক্ষিত। এটিও সম্ভবত বৌদ্ধ দর্শনের ছায়া। কবি মহাদেবীর কাছে নির্বাণই একমাত্র পথ—

“পথ কো নির্বাণ মানা।

শূল কো বরদান মানা।"


মোক্ষ বা নির্বাণই ইহবন্ধন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। কিন্তু সেই পথের পথিক হয়ে মহাদেবী ‘শূল' তথা বেদনাকে আশীর্বাদ ('বরদান') বলে বরণ করে নেন কেন? কেননা পার্থিব জীবনের আঘাত, বেদনা, প্রতিকূলতাই জীবনকে নির্বাণের পথ বলে দেয়। দুঃখ তাই অভিশাপ নয়; আধ্যাত্মিক মার্গে দুঃখ আশীর্বাদ হিসাবেই গ্রাহ্য।


মহাদেবী বর্মার কাব্যে নির্বাণের সাধনা তাই দুঃখবরণেরই সাধনা। পরম প্রিয়র সঙ্গে মিলনের প্রত্যাশায় তিনি মীরাবাঈয়ের মতোই প্রতীক্ষার দীপ জ্বালিয়ে রাখেন। এই বেদনার পথেই প্রিয়তমের সঙ্গে মিলন ত্বরান্বিত হয় বলে তাঁর বিশ্বাস–

“তু জল জল জিতনা হোতা ক্ষয়,

উয়হ সমীপ আতা ছলনাময়।”


এই বৌদ্ধ-দর্শনের সঙ্গে মহাদেবীর জীবন ও কাব্যে সমন্বিত হয়েছে অদ্বৈতবাদী দর্শনের ধারা। জীবন ও জীব, পরমাত্মা ও জীবাত্মা, দেহাতীত অখণ্ড সত্তা ও দেহসীমায় বন্দী এই খণ্ডজীবন তাঁর ভাবনায় অনায়াসে প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়—

“ম্যায় তুম সে হুঁ এক, এক হ্যায় জ্যায়সে রশ্মি প্রকাশ

ম্যায় তুম সে হুঁ ভিন্ন, ভিন্ন জ্যেওঁ ঘন সে তড়িৎ বিলাস।”


জীবনের দীপকে নিঃশেষে দুঃখের তথা বিরহের শিখায় জ্বালিয়ে মহাদেবী তাই সেই পরম সিদ্ধি বা মিলনের পথে অগ্রসর হতে চান। এই প্রিয়মিলনের পথ কণ্টকিত প্রতিকূলতাময়। তবু মহাদেবী অনায়াসে বলেন— 

“পথ হোনে দে অপরিচিত, প্রাণ রহনে দো অকেলে।"