“এ ভ্রম সহজেই হয় যে, কবির হৃদয়ের ভাবকে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই বুঝি কাব্যের লক্ষ্য” | “লিরিক যত ভাব-ঘেঁষা হয় ততই যে শ্রেষ্ঠ হয় না, তা যে কোনো শ্রেষ্ঠ কাব্যের উদাহরণ নিলেই দেখা যায়।”

কাব্য-বিচারে রসজ্ঞ সমালোচকগণ সর্বদেশে সর্বকালে তার আত্মার সন্ধানে ব্যাপৃত থেকে 'রস'কেই সেই মহৎ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ নানাবিধ বিচার-বিতর্ক শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, লৌকিক 'ভাব'ই কবি-প্রতিভার অঘটন ঘটন-পটীয়সী ক্ষমতার স্পর্শে রূপান্তরিত হয়ে তাঁর কাব্যে অলৌকিক ‘রস’-রূপ লাভ করে। এখানে লক্ষণীয় যে লৌকিক ভাব থেকেই অলৌকিক রসের উদ্ভব ঘটলেও ভাব রস নয়। প্রাচীন আলঙ্কারিকদের অনুসরণে প্রবন্ধকারও এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, কাব্যজগতের ঐ বাহ্যিক উপাদানের ক্রিয়ায় মনের 'ভাব' রূপান্তরিত হয়ে রসে পরিণত হয়।...কিন্তু এই 'ভাব' ‘ইমোশন' বা কদাপি 'রস' নয়, এবং মানুষের মনে যা এই 'ভাব' জাগিয়ে তোলে তাও কাব্য নয়। এ বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য আলঙ্কারিকগণও একই মত পোষণ করেন।


কিন্তু আধুনিককালে, তখন লিরিক কবিতা তথা গীতিকবিতার যথেষ্ট প্রাধান্য বর্তমান, তখন কাব্যে ভাবের অতিশয়তা লক্ষ্য করে সাধারণ পাঠক সমাজ বিচার-বিভ্রমে পতিত হয়ে থাকেন। তারা মনে করেন যে, কবির হৃদয়-ভাবকে পাঠক হৃদয়ে সঞ্চারিত করে নেওয়াই বুঝি কাব্যের লক্ষ্য এবং কাব্যে যত বেশি ভাবের প্রবলতা থাকবে, কাব্য বুঝি ততই উৎকৃষ্ট হবে। কিন্তু এই দুটি ধারণাই যে ভিত্তিহীন, তা যে কোনো উৎকৃষ্ট কাব্য-বিশ্লেষণেই ধরা পড়বে। আসলে, কাব্যের আত্মা যে ভাব নয়, রস এবং ভাব ও রস যে এক বস্তু নয়— সাধারণ পাঠক এ বিষয়ে অবহিত নন বলেই এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। পূর্বোক্ত আলোচনায় প্রতিপন্ন হয়েছে যে ভাব রূপান্তরিত হয়ে রসে পরিণত হয়। কবির হৃদয়ভাব পাঠক হৃদয়ে সঞ্চারিত হলে রূপান্তরের কাজটি ঘটে না, ফলে ভাবও রস-রূপ লাভ করে না বলেই তা যথার্থ কাব্য হয়ে উঠতে পারে না। কবির ভাব তো লৌকিক, এটি কবির নিজস্ব অন্তর্জগতের বস্তু, অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত হলেও তা লৌকিকই থেকে যাবে; কিন্তু কাব্যের জগৎ তো লৌকিক জগৎ নয়, তা অলৌকিক মায়ার জগৎ, তা রসের জগৎ। কাজেই যে-কাব্যে 'ভাবই শেষ কথা, তা সে যতই লিরিক-প্রধান হোক্ তা কখনো উৎকৃষ্ট কিংবা যথার্থ কাব্য-রূপে স্বীকৃত হয় না। ভাব রসমূর্তিতে রূপান্তরিত হলেই তা কাব্য।


এই রূপান্তরটিই এখানে বড় কথা। প্রখ্যাত নন্দনতাত্ত্বিক দার্শনিক ক্লোচে poetic idealization'-সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন- “passage from troublous emotion to the serenity of contemplation" এখানেও বস্তুতঃ প্রাচীন আলঙ্কারিকদের লৌকিক ভাবকে আস্বাদ্যমান অলৌকিক রসে রূপান্তর-এর সঙ্গে পরিপূর্ণ ঐক্যবোধ রয়েছে। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের 'emotion recollected in tranquillity'-তেই এই রূপান্তরেরই পরিচয় পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ভাবকেই কেউ কাব্যের প্রাণ বলে স্বীকার করেন নি, যদিও ভাবই কাব্যের উপাদান। কিন্তু যদি শুধু ভাব উদ্বুদ্ধ হলেই কাব্য হতো, তবে, এখানে প্রাবন্ধিক রসিকতা করে বলেছেন যে খবরের কাগজে তৎকালে হিন্দু মুসলমানের বিরোধকে অবলম্বন করে এককে অপরের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে তোলা হতো, তাকে অবলম্বন করে বহু উৎকৃষ্ট কাব্য রচিত হতো পারতো। কিন্তু তা হয় নি। বস্তুতঃ কবির আবেগময় ভাবকে এখন বিভাব-অনুভাবে প্রকাশ করতে হবে তা তার মনে রসের মূর্তি পরিগ্রহ করবে। নতুবা, শুধু ভাবে কাব্য হবে না, তাই সেকালের এক প্রধান কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে’র কিংবা সুকবি নবীনচন্দ্র সেনের 'কেন দেখিলাম' আদি রচনায় ভাবের উচ্ছ্বাস একেবারে কূলপ্লাবী হওয়া সত্ত্বেও তা কাব্যরসিক পাঠকের মনে তৃপ্তি জাগাতে পারে না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের—

‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি

যুগল প্রেমের স্রোতে,

অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।'

—ইত্যাদি কবিতার কাব্যরস পাঠক-মনকে তৃপ্তিতে টই-টম্বুর করে রাখে।