মৃচ্ছকটিকের অভিনবত্ব কী | ‘মৃচ্ছকটিক’ নামকরণটি অভিনব বলে মনে করার কারণ কী?

শূদ্রক কোন কালের নাট্যকার?

‘মৃচ্ছকটিক’ রচয়িতা শূদ্রকের কাল সম্বন্ধে নানা সংশয় বর্তমান। শূদ্রক নামটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে অষ্টম শতকের পূর্ববর্তী পর্যন্ত কালসীমায় পাওয়া যায়। ফলে যথার্থ কাল নির্ণয়ে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্কন্দপুরাণ, কথাসরিৎসাগর প্রভৃতির মধ্যে রাজা শূদ্রকের নামোল্লেখ দৃষ্ট হয়।


Sten Konow শূদ্রকের কাল আভীর-নরপতি শিবদত্তের কাল অর্থাৎ আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টাব্দকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন শিবদত্ত এবং শূদ্রক অভিন্ন। কিন্তু এটি সত্য হলে শূদ্রককে কালিদাসের পূর্ববর্তী কবির মর্যাদা দিতে হয়। কিন্তু কালিদাস তাঁর পূর্ববর্তী নাট্যকার ভাস— সৌমিল্ল কবিপুত্রের নাম উল্লেখ যেখানে করেছেন, সেখানে শুদ্রকের মতো এক শক্তিমান কবির কথা বলেন নি কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। কাজেই অনুমান, শূদ্রক কালিদাস পরবর্তী কবি। আবার অন্যদিকে, মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে যে সকল আইন কানুনের কথার বিবরণ পাওয়া যায় তা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। এই সূত্র ধরে Jolly অনুমান করেছেন শুদ্রক ষষ্ঠ/সপ্তম খ্রিস্টাব্দের কবি। নাটকে বর্ণিত বিবরণ থেকে Jacobi সিদ্ধান্ত করেছেন নাটকটি চতুর্থ শতকের পূর্বে কিছুতেই রচিত হয়নি। Pischel-এর মতে দন্ডীই মৃচ্ছকটিক রচনা করেন। দন্ডীর কাল ষষ্ঠ শতক। ফলত শূদ্রকের কালের সুনিশ্চিত মীমাংসা সম্ভব হয়নি।



মৃচ্ছকটিকের অভিনবত্ব কী?

শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকটিকে ‘মহাবিস্ময়' বলে চিহ্নিত করেছেন অনেক পণ্ডিত সাহিত্য সমালোচক। বস্তুত অভিজাত শ্রেণীর সাহিত্য সৃষ্টির কালে সাধারণ লোকের লৌকিক জীবনযাত্রা নির্ভর এরূপ কাল্পনিক অথচ বাস্তব ঘেঁষা নাটক সে যুগে আর দেখা যায়নি। এর পাত্রপাত্রী প্রায় ত্রিশজনই ভিন্ন সামাজিক স্তরের থেকে সংকলিত। কেউ ভাল, কেউ মন্দ চরিত্র বিশিষ্ট। নায়িকা একজন কুলবধূ, অপরজন গণিকা। প্রধান রস শৃঙ্গার। নায়ক ধীর, প্রশান্ত, ব্রাহ্মণ। এছাড়া দাস, বেশ্যা, চেট, বীট, জুয়াড়ী সকলেরই সমাবেশ ঘটেছে এখানে। বস্তুত সমাজের এক বৃহৎ অংশ এখানে প্রতিফলিত। অন্যতম মূল ঘটনা হল গণ-অভ্যুত্থান। ঘোষপল্লীর আর্যক এখানে রাজা, বৌদ্ধভিক্ষুসংঘের কুলপতি একজন জুয়াড়ী, মন্ত্রী একজন চৌর্যবিদ্যাবিশারদ ব্রাহ্মণ, কুলবধূর মর্যাদা লাভ করেছেন একজন গণিকা। এই ধরনের রাষ্ট্রবিপ্লব সচরাচর সংস্কৃত সাহিত্যে দেখা যায় না। অতি সাধারণের ভিড়ে মৃচ্ছকটিকের এই অভিনবত্ব নিতান্তই বিস্ময়কর এবং প্রশংসনীয়।



‘মৃচ্ছকটিক’ নামকরণটি অভিনব বলে মনে করার কারণ কী?

সংস্কৃত সাহিত্যে সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা কাব্যের প্রধান চরিত্র তার নাম অনুসারে কিংবা মূল ঘটনার পরিণতির ইঙ্গিতবাহী নামকরণ হয়ে থাকে। কিন্তু মৃচ্ছকটিক নাটকের নামকরণ করা হয়েছে গল্পের নায়ক চারুদত্তের বালকপুত্র রোহসেনের খেলনা একটি মাটির ছোট ছ্যাকড়া গাড়িকে ভিত্তি করে। মৃচ্ছকটিক বলতে মৃৎ শকটিক বা মাটির গাড়ি বোঝায়। রোহসেন একটি সোনার গাড়ি নিয়ে খেলছিল, সেই গাড়ির বদলে পরিচারিকা তাকে একটি মাটির ছোট গাড়ি (মৃচ্ছকটিক) দিলে, বালক সোনার গাড়ির জন্যে কান্নাকাটি করতে থাকে। সেই গৃহে তখন নাটকের নায়িকা তথা উজ্জয়িনীর শ্রেষ্ঠ নটী বসন্তসেনা উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর দেহের সমস্ত গহনা বালকের মাটির গাড়িতে বোঝাই করে দিলেন। এই ঘটনার পর থেকেই নাটকে জটিলতা এবং সংঘাতের আবর্ত সৃষ্টি হতে হতে নাটক ক্রমশ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলতে থাকে। নাটকের মোড় ঘোরার কারণ যে বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে মাটির গাড়ি। সেই সূত্র ধরেই এর নামকরণ ‘মৃচ্ছকটিক’ করা হয়েছে।


সংস্কৃত সাহিত্যে এমন তুচ্ছ বিষয় কোনো নাটকের নামকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। হয়তো নাট্যকার এই নামের মধ্যে দিয়ে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন যে, মাটির গাড়ি যেমন স্বর্ণালঙ্কারে পূর্ণ হলে তাকে সোনার গাড়ি বলা যায় তেমনি প্রতিটি সাধারণ লোক বহিরাঙ্গে নয় অন্তর সম্পদে ঐশ্বর্যবান হলেই তাকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর বহিরাঙ্গে ঐশ্বর্যবান অথচ অন্তর সম্পদে রিক্ত ব্যক্তিদের নিকৃষ্ট বুদ্ধি পরিচারিকারাই কদর করে।


প্রকৃত প্রস্তাবে, সংস্কৃত সাহিত্যে এ হেন তুচ্ছ বস্তুকে কেন্দ্র করে কাহিনীর নামকরণ ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এই অভিনবত্ব যেমন বিস্ময়কর তেমনি অভিনন্দনযোগ্য।