“সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং মঙ্গলমূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বরূপ” | রবীন্দ্রনাথের ‘সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধের অনুসরণে সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলের সম্পর্ক বিচার।

“সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের সেই পূর্ণ সামঞ্জস্য দেখিতে পাইলেই তাহার সৌন্দর্য আর আমাদের অগোচর থাকে না।”


কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সৌন্দর্য যখন আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপভোগ করি, তখন শুধু তার বাইরের রূপটাই চোখে পড়ে। কিন্তু যখন তাকে মন দ্বারা দেখি তখন তার সঙ্গে বুদ্ধি-বিচার, হৃদয়-ভাব, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি যুক্ত হবার ফলে দৃষ্টিসীমা অনেকখানি প্রসারিত হয়। ফলত সৌন্দর্য থেকে তখন ধর্মনীতি, ভালোমন্দের বিচারও এসে যায়। অতএব কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলকে বিজড়িত করবার সার্থকতা কোথায়? এই দুয়ের আকর্ষণ প্রণালীতে পার্থক্য আছে বলেই এদের ভিন্ন নাম, ভিন্ন পরিচয়। ভালোর প্রয়োজনীয়তা আমাদের মুগ্ধ করে, সেটা আমরা জানি, কিন্তু সুন্দর যে কেন আমাদের মুগ্ধ করে তা আমাদের জানা নেই।


রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, মঙ্গল আমাদের প্রয়োজন সাধন করে বলেই যে সুন্দর তা নয়। প্রয়োজন সাধনের ঊর্ধ্বেও তার একটা অহেতুক আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু যা কিছু প্রয়োজন সাধন করে, যেমন ভাত-কাপড়, ছাতা-জুতো প্রভৃতি—তাদের আমাদের প্রয়োজন সাধনোপায় বা মঙ্গল-বস্তু বলেই গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু এগুলি আমাদের হৃদয়ে সৌন্দর্যের পুলকসঞ্চার করে না। কিন্তু জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামচন্দ্রের সঙ্গে কনিষ্ঠ লক্ষ্মণও বনে গেলেন এই সংবাদটি আমাদের হৃদয়কে ঝঙ্কৃত করে তোলে। এতে যে সমাজের হিত হয়, অর্থাৎ এটি মঙ্গলজনক—এই ভাবনা থেকেই যে আমরা পুলকিত হই তা নয়, জগতের সঙ্গে যে মঙ্গলের একটা গভীরতম সামস্য আছে, সমস্ত মানুষের মনের সঙ্গেই যে তার নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে, তারও কারণে এটি সুন্দর। বস্তুত সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের পূর্ণ সামঞ্জস্য দেখতে পেলেই সৌন্দর্যের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। শতদল পদ্ম, পূর্ণিমার চন্দ্র প্রভৃতি যেমন নিজের মধ্যে এবং চতুষ্পার্শ্বস্থ জগতের মধ্যে একটি পরিপূর্ণ সুষমা নিয়ে বিরাজ করে বলে সুন্দর, তেমনি করুণা, ক্ষমা, প্রেমও সুন্দর। সমুদ্রমন্থনে শুধু যে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়েই লক্ষ্মী আবির্ভূতা হয়েছিলেন, তা নয়, তিনি মঙ্গলমূর্তিও ধারণ করেছিলেন। অতএব দেখা যায়, সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েই যেমন মঙ্গলের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে, তেমনি মঙ্গলের মধ্যেই সন্ধান পাওয়া যায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের—মঙ্গলমূর্তি ও সৌন্দর্যমূর্তি একাত্মতা লাভ করে।


প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলেই সৌন্দর্যকে ঐশ্বর্য বলা চলে। ঠিক তেমনিভাবে মঙ্গলের মধ্যেও আমরা ঐশ্বর্যকে দেখতে পাই। নিজের সুখদুঃখ বা ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে কোনো বীরপুরুষ যখন সর্বদুঃখ বরণ করেন, তখন তার সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে কারণ এর মধ্যে মঙ্গল নিহিত রয়েছে। সৌন্দর্য যেমন জগদ্ব্যাপারের মধ্যে ঈশ্বরের ঐশ্বর্য প্রকাশ করে মানুষের জীবন মঙ্গলও তাই করে থাকে। বস্তুত মঙ্গল আমাদের সর্বাধিক সন্নিকটস্থ অন্তরতম সৌন্দর্য বলেই অনেক সময় তাকে সহজে সুন্দর বলে বুঝতে পারিনি।


ভোজের আয়োজনে যদি প্রাচুর্য থাকে, এবং সাজ-সজ্জায় যদি আড়ম্বর থাকে, তবে তা অবশ্যই উপভোগ্য হতে পারে; কিন্তু এর সঙ্গে যদি যজ্ঞকর্তার হৃদ্যতা যুক্ত না হয়, তবেই সমস্ত বিস্বাদ হয়ে যায়, কারণ হৃদ্যতার মধ্য দিয়েই অন্তরের ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য প্রকাশিত হয়। ভোজ্যদ্রব্যের প্রাচুর্য এবং সাজসজ্জার আড়ম্বরের চেয়ে অন্তরের গভীরতার মঙ্গলসৌন্দর্যই ভোজের প্রধান অঙ্গ। এটিকে উপভোগ করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, গাম্ভীর্য, অন্তরের শিক্ষা।


আমাদের দেশের প্রাচীন কবিগণ মঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত পরিপূর্ণতার ছবি এঁকেছেন, তাই গর্ভিণী নারীর চিত্রাঙ্কনে তাঁদের সংকোচ ছিল না, কারণ সেই নারীমূর্তির মধ্যেই নারীর চরম সার্থকতা লাভের আসন্ন চিত্র অর্থাৎ মাতৃত্বের রূপ ফুটে ওঠে। কালিদাস তাঁর 'মেঘদূত' কাব্যে শরতের লঘুপক্ষ মেঘ কিংবা বসন্তের মলয় বাতাসকে বার্তা বহনের কার্যে নিযুক্ত না করে বজ্রবিদ্যুৎগর্ভ মন্থরগতি গুরুভার আষাঢ়ের মেঘকেই গ্রহণ করেছিলেন, কারণ এই মেঘ যে অঞ্চলের উপর দিয়ে যাবে সেখানে কদম্ব ফুটবে, জম্বুকুগ্ধ ভরে উঠবে, বলাকা উড়ে চলবে, প্রভৃতি। এতে শুধু কবির সৌন্দর্যরসপিপাসু চিত্তই তৃপ্তি লাভ করেনি, এ যে পৃথিবীর মঙ্গলসাধনেও ব্যাপৃত। কালিদাস ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে অকাল বসন্তের আকস্মিক উৎসবে হর-পার্বতীর মিলন না ঘটিয়ে পার্বতীকে কঠোর তপস্যার মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধা করে নিয়েছেন, 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌' নাটকেও প্রেয়সী যখন জননী হয়েছেন, অনুতাপের সঙ্গে যখন ক্ষমা মিলিত হয়েছে, তখনই কবি রাজদম্পতির মিলন ঘটিয়েছেন। দুই কাব্যের কবি শান্তির মধ্যে, মঙ্গলের মধ্যে সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা সাধন করেছেন। সর্বত্রই সৌন্দর্যপুষ্প পরিণতিতে মঙ্গলমধুর গাঢ়ৱস-সমৃদ্ধ ফলে রূপান্তরিত হয়েছে।


সৌন্দর্য ও মঙ্গলের সম্মিলিন যিনি দেখতে পেয়েছেন, তিনি কখনও ভোগবিলাসের সঙ্গে সৌন্দর্যকে জড়িয়ে রাখেননি। তাই মহামতি অশোকের বৈভবের পরিচয় তার কোনো প্রমোদ-উদ্যান কিংবা রাজপ্রাসাদে খুঁজে পাওয়া যায় না—দুর্গম গিরিশিখর কিংবা নির্জন সমুদ্রতটে তাঁর অসংখ্য সৌন্দর্যসৃষ্টির চিহ্ন রেখে গেছেন। মানুষ-রচিত এই সৌন্দর্য বৃহত্তর প্রাকৃত সৌন্দর্যকে যেন অভিবাদন জ্ঞাপন করছে। প্রাচীন হিন্দু রাজারাও বিলাস-বৈভবের কোনো চিহ্ন রেখে যাননি, কিন্তু তারা মানুষের শক্তিকে ভক্তিকে ভগবানের মঙ্গলরূপের পার্শ্বে বসিয়ে ধন্য হয়েছেন। বিষ্ণুর সঙ্গে লক্ষ্মীর মিলনের মতোই মঙ্গালের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলন সাধনা পূর্ণতা লাভ করেছে।