"সত্যের এই আনন্দরূপ অমৃতরূপ দেখিয়া সেই আনন্দকে ব্যক্ত করাই কাব্য সাহিত্যের লক্ষ্য” | রবীন্দ্রনাথের 'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধ অনুসরণে সৌন্দর্যের সঙ্গে সত্য ও আনন্দের সম্পর্ক বিচার করো।

'সত্যের যথার্থ উপলব্ধি মাত্রই আনন্দ, তাহাই চরম সৌন্দর্য।”

“এইরূপে বুঝিলে সত্যের অনুভূতি ও সৌন্দর্যের অনুভূতি এক হইয়া যায়।”


ভারতীয় বিচারে সৌন্দর্যের সঙ্গে সত্য ও শিবের সহাবস্থান স্বীকার করা হয় বলেই ‘সত্যং শিবং সুন্দরম' এই আপ্তবাক্যটি বহুল প্রচলন লাভ করেছে। একসূত্রে এই ত্রয়ীর বিন্যাস না ঘটলে সাহিত্য-আদি বিবিধ শিল্পকলা পূর্ণতার স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না। উপনিষদেও মোটামুটি এর মাহাত্ম্য এবং যাথার্থ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে বলে ঋষি বলেন 'আনন্দরূপমমৃতং ষদ্বিভাতি— যা কিছু প্রকাশমান অর্থাৎ বর্তমান আছে, তাই আনন্দরূপ অমৃত অর্থাৎ সত্য এই ধারণার সমর্থন পাই আমরা আধুনিক য়ুরোপীয় সাহিত্যেও। রোম্যান্টিক কবি কীটস একটি প্রাচীন গ্রীক ভস্মাধারে উৎকীর্ণ চিত্রসমূহ দেখে লিখেছেন সেই অনবদ্য কবিতাংশ—

"Beauty is truth. truth beauty, that is all

Ye know on earth and all ye need to know."


অর্থাৎ সত্য ও সৌন্দর্যের অভিন্নতাই একমাত্র জাগতিক সত্য, আর অতিরিক্ত আর কিছু জানবার নেই কলারসিক মানুষের চিন্তাধারা যুগে যুগে একই খাতে প্রবাহিত হয় বলেই সৌন্দর্যের বিচারে উপনিষদের ঋষি থেকে আধুনিক যুগের রোম্যান্টিক কবি কীটস যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, আমাদের রবীন্দ্রনাথও তার বাইরে। যাননি। তিনিও ‘সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধে সৌন্দর্যের সঙ্গে শিবের অর্থাৎ মঙ্গলের, আনন্দের এবং সত্যের অভিন্ন সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।


যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও প্রত্যক্ষগোচর, তাই বাস্তব, তাই সত্য। এই যে সত্যদর্শন, যা শুধু ইন্দ্রিয়লোকেই সীমাবদ্ধ, তা সত্যের অংশমাত্র। সত্যকে পূর্ণরূপে দেখতে গেলে তাকে দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে বিচারবুদ্ধি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। সত্য যখন সর্বাংশে ধরা পড়ে, যখন তা পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হয়, তখনই যথার্থভাবে সত্যকে উপলব্ধি করা যায় : আর সত্যের যথার্থ উপলব্ধিমাত্রই আনন্দ এবং তাকেই বলা হয় চরম সৌন্দর্য।


এই চলমান পৃথিবীতে যেখানে বা যাকে আশ্রয় করে আমাদের মন বসে, সেখানেই আমরা প্রকৃত সত্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারি। বন্ধু আমাদের মনের আশ্রয় বলেই বন্ধু সত্য, তার সান্নিধ্য আনন্দময় হয়ে ওঠে। যারা দেশকে সত্য বলে জানে, তারা দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারে। বিদ্বান ব্যক্তি বিদ্যা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু মূর্খের তাতেই বিভীষিকা। অতএব যার মন যেখানে আশ্রয় পায়, তাতেই তার আনন্দ, তাই সুন্দর, তাই সত্য। যেখানে সত্যের মধ্যে আনন্দের সন্ধান পাইনে, সেখানেই বলতে হবে, সত্যকে আমরা জেনেছি মাত্র. তাকে আপন করে পাইনি। যখন একান্ত করে পাওয়া যাবে সত্যকে তখন তাতেই থাকে প্রেম ও আনন্দ। এইভাবেই সত্যের অনুভূতি ও সৌন্দর্যের অনুভূতি এক হয়ে যায়।


সাহিত্য-আদি যাবতীয় কলাকৃতিই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সত্যের পথে, আনন্দের পথে ধাবিত। যা পূর্বে আমাদের দৃষ্টিসীমা ও জ্ঞানের বাইরে ছিল, সাহিত্য তাকে আমাদের সামনে উপস্থিত করে সত্যের ও আনন্দরাজ্যের সীমা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাহিত্যের স্পর্শলাভে তুচ্ছ। বস্তুও কলাসৌন্দর্যে মণ্ডিত হচ্ছে। যা কিছু প্রকাশিত হচ্ছে তাই আনন্দস্বরূপ অমৃতস্বরূপ — সত্যই সুন্দর, দুই-ই অভিন্ন, তাই দেবী সরস্বতীও সত্য ও সুন্দরের প্রতিমূর্তি। সত্য ও সুন্দরের এই আনন্দরূপ অমৃতরূপকে আনন্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করাই সাহিত্য-আদি যাবতীয় শিল্পকর্মের প্রধান লক্ষ্য এবং তা করতে গেলে এই জীবনকে জগৎকে শুধু চোখ দিয়ে বা বুদ্ধি দিয়ে নয়, তাকে অনুভব করতে হবে হৃদয় দিয়ে। অবশ্য তাই বলে সাহিত্য শুধু হৃদয়ের আবিষ্কারই নয়, তার সঙ্গে সৃজনশীলতা তথা কলাকৌশলেরও একটা সম্পর্ক রাখতে হয় একে যথার্থভাবে রূপায়িত করবার জন্য। সেই আবিষ্কারের আনন্দকে হৃদয় প্রকাশ করে আপন ঐশ্বর্যের সাহায্যে যার মধ্যে রয়েছে ভাষা ধ্বনি বর্ণ আদি। এই সৃষ্টিনৈপুণ্য দ্বারাই জগতের যাবতীয় শিল্পকলার উদ্ভব ঘটেছে—তা’ সে সাহিত্য সঙ্গীত, চিত্র যাই হোক না কেন।


মানুষ তার বিস্ময়কে রূপদান করেছে, মরুভূমির বুকে পিরামিড নির্মাণের মধ্যে, নির্জন দ্বীপের সমুদ্রতটকে অঙ্কিত করেছে হস্তিগুহায়, সমুদ্রের মধ্যে সূর্যোদয়ের মহিমাকে করজোড়ে প্রণতি জানিয়েছে কোনারকে মন্দির স্থাপন করে। জগতের যত মন্দির, তীর্থ, রাজধানী বা মূর্তিস্থাপনের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যের উপলব্ধি আনন্দকে অমৃতস্বরূপে চিহ্নিত করে রেখেছে। দেশে দেশে, কালে কালে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্য-আদি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সত্যের সুন্দর মূর্তির প্রতি মানুষ অপর মানুষের হৃদয়কে আহ্বান জানিয়ে আসছে। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রকৃতিজগৎ যে বহুল পরিমাণে আমাদের হৃদয়েরও জগৎ হয়ে উঠতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ, আমাদের সাহিত্য হৃদয়ের আবিষ্কারচিহ্নে জগৎকেই খণ্ডিত করে তুলতে পেরেছে।


বিভিন্ন শাস্ত্রে, দর্শনে সত্যের বিভিন্ন দিক প্রকাশিত হলেও সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি যে সত্যই আনন্দ, সত্যই অমৃত। সাহিত্যই উপনিষদের এই রস-তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করে চলেছে—‘রসো বৈ সঃ। রসং হেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি'—অর্থাৎ তিনিই রস, এই রসকে লাভ করেই মানুষ আনন্দিত হয়।