"ধ্বনিরাত্মা কাব্যসা" | “শ্রেষ্ঠ কাব্য নিজের বাচ্যার্থে পরিসমাপ্ত না হয়ে বিষয়ান্তরের ব্যঞ্জনা করে। আলংকারিকরা কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধর্মান্তরের অভিব্যঞ্ঝনার নাম দিয়েছেন 'ধ্বনি'।”

"যা শ্রেষ্ঠ কাব্য তার প্রকৃতিই হচ্ছে বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া।”


“কাব্যের যা সার অর্থ, কেবল শব্দার্থের জ্ঞানে তার জ্ঞান হয় না, একমাত্র কাব্যার্থতত্ত্বজ্ঞেরাই সে অর্থ জানতে পারেন।"


প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকগণ কাব্যের আত্মার সন্ধান করতে গিয়ে বহু মতবাদ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কালের কষ্টিপাথরে যাচাই-এর ফলে এ-জাতীয় বহু মতবাদই কাব্যের পরিপোষক বলে স্বীকৃত হলেও প্রায় কোনোটাই শেষ পর্যন্ত কাব্যাত্মার মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারেনি। আলঙ্কারিকদের মধ্যে যারা দেহাত্মবাদী অর্থাৎ কাব্যদেহের বহিরঙ্গে তথা শব্দ ও অর্থের মধ্যেই আত্মার সন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ বলেছেন—'শব্দার্থে সহিতৌ কাবাম্', কেউ বলেছেন, 'কাবাং গ্রাহামলঙ্কারাৎ', আবার কেউ বা বলেছেন ‘রীতিরাত্মা কাব্যসা। কারো মতে শুধু শব্দ আর তার অর্থ থাকাই যথেষ্ট, কেউ বা অধিকন্তু তার উপর সাজ-সজ্জা অর্থাৎ অলঙ্কার আরোপ করতে চান, কেউ বা রীতি বা স্টাইলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রীতিবাদীরা অবয়ব-সংস্থানকেই রীতি বলে গ্রহণ করে অলঙ্কারকে তার পরিপোষক বলে মেনে নিয়েছেন, এবং রীতিকেই কাব্যের আত্মা বলে গ্রহণ করেছেন। রীতিবাদীদের এই দাবির প্রতি সংশয় জ্ঞাপন করে 'ধ্বন্যালোক' নামক প্রখ্যাত অলঙ্কারশাস্ত্রে বলা হয়েছে

“প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব বস্তুস্তি বাণীষু মহাকবীনাম্। 

যত্তৎ প্রসিদ্ধাবয়বাতিরিক্তং বিভাতি লাবণ্যমিব্যঙ্গনাসু।”


অর্থাৎ "রমণীদেহের লাবণ্য যেমন অবয়ব-সংস্থানের অতিরিক্ত অন্য জিনিস, তেমনি মহাকবিদের বাণীতে এমন বস্তু আছে যা শব্দ, অর্থ, রচনাভঙ্গি, এ সবার অতিরিক্ত আরও কিছু।” ধ্বনিবাদীরা মনে করেন যে, এই যে অতিরিক্ত বস্তু এটিই 'ধ্বনি' যা বাচ্যকে অতিক্রম করে বাচ্যান্তরের ব্যঞ্ছনা দান করে এবং এই ‘ধ্বনি'ই হলো কাব্যের আত্মা।


ধ্বনিবাদ-বিষয়ে আকর গ্রন্থ 'ধ্বন্যালোক'। এক্ষণে 'ধ্বন্যালোক' বলতে বোঝায় এর কয়েকটি 'কারিকা', এর ‘বৃত্তি' এবং 'লোচন' নামক টীকা। 'কারিকা' তথা মূলগ্রন্থের রচয়িতা কে, তা জানা যায়। না, তবে এর ‘বৃত্তি'র রচয়িতা আচার্য আনন্দবর্ধন এবং ‘কারিকা’ ও ‘বৃত্তি'র টীকা-রচয়িতা আচার্য অভিনব গুপ্ত। অনেকে অনুমান করেন, ‘কারিকা’র রচয়িতাও আনন্দবর্ধন, কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কাব্য-তত্ত্ব-বিষয়ে শেষ কথা সম্ভবতঃ ধ্বনিবাদীরাই বলে গেছেন। কাব্য-দেহের অতিরিক্ত বা ক্লান্তি বা লাবণ্য, তাঁকেই 'ধ্বনি' নামে অভিহিত করেছেন। কোনো অলঙ্কার, গুণ বা রীতি নয়, ধ্বনিই কাব্যের আত্মা যা শব্দ ও অর্থকে অতিক্রম করে বাচ্যাতিরিক্ত এক প্রতীয়মান অর্থের দ্যোতনা করে। 'ধ্বন্যালোকে বলা হয়েছে

‘যথার্থঃ শব্দো বা তমর্থমুপসর্জনী কৃতস্বার্থোঁ। 

ব্যঙ্গাঃ, কাব্যবিশেষঃ স ধ্বনিরীতি সুরিভিঃ কথিতঃ।।'


অর্থাৎ যেখানে কাব্যের অর্থ ও শব্দ স্বীয় স্বার্থ তথা প্রাধান্যকে বিসর্জন দিয়ে ব্যঞ্জিত অর্থকে প্রকাশ করে, পণ্ডিতজন তাকেই ‘ধ্বনি' নামে অভিহিত করেন। এই 'ধ্বনি' তথা এর পারিভাষিক রূপ ‘ব্যঙ্গ' বা 'ব্যাঙ্গ্যার্থকেই ধ্বনিবাদিগণ কাব্যের আত্মারূপে গ্রহণ করেছেন। ধ্বনি বাচ্যকে অবলম্বন করেও তাকে অতিক্রম করে যায়। তবে ধ্বনিবাদীরা কাব্যনির্মাণে গুণ-অলঙ্কারের ভূমিকাকে একেবারে অস্বীকার করেন নি। তাঁরা বলেন

‘রসাক্ষিপ্ততয়া যস্য বন্ধঃ শাক্যক্তিয়ো ভবেৎ। 

অপৃথগ্যত্ননির্বর্ত্যঃ সোহলঙ্কারো ধ্বনৌ মতঃ।।


অর্থাৎ পৃথক্ চেষ্টা ব্যতিরেকেই স্বাভাবিকভাবে কাব্যদেহে যে অলঙ্কারের (যেন সহজাত কবচ-কুণ্ডল) সৃষ্টি হয়, ধ্বনিবাদীরা তাকেই অলঙ্কারের স্বীকৃতি দান করেছেন। অন্যত্র এ কথাও স্বীকার করা হয়েছে যে রসাদির সঙ্গে বাচ্যের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে এবং উৎকৃষ্ট বাচ্য রূপকাদি অলঙ্কার-নির্মিত বলেই রস থেকে অলঙ্কারকে পৃথক্ করা যায় না। আর ধ্বনিবাদীরাও রসকেই কাব্যের আত্মা বলে স্বীকার করেছেন, ধ্বনি তারই প্রকাশ। আচার্য অভিনব গুপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে 'ধ্বনি'ই রস এবং শ্রেষ্ঠ ধ্বনিকে তিনি বলেছেন 'রসধ্বনি'।


কোনো কোনো অলঙ্কারে একটা আপাত-ব্যঞ্ছনার পরিচয় পাওয়া যায় যেমন সমাসোক্তি কিংবা সঙ্কর অলঙ্কারে। সমাসোপ্তিতে এক বস্তুর দ্বারা অপর বস্তুর ব্যানা এবং সঙ্কর অলঙ্কারে এক অলঙ্কার দ্বারা অপর অলঙ্কারের ব্যঞ্জনা হয়। এখানে অলঙ্কার প্রয়োগে তার কৌশল-মাধুর্যাদির ব্যঞ্জনাকে 'ধ্বনি' বলে ভ্রম হতে পারে; কিন্তু শব্দার্থ যেখানে কেবলমাত্র বস্তু বা অলঙ্কারের ব্যঞ্ছনা করে, তা কখনো শ্রেষ্ঠ কাব্যের ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা হতে পারে না।


'ধ্বন্যালোক' গ্রন্থে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, ব্যঙ্গ্য বা ধ্বনি যেখানে অপ্রধান এবং শুধুমাত্র বাচ্যার্থের অনুগামী—যেমন সমাসোক্তি অলঙ্কারে, সেখানে স্পষ্টতঃই সেটি শুধু বাচ্যালঙ্কার মাত্র, ধ্বনি নয়। ব্যঙ্গ যদি আভাসমাত্রে থাকে এবং বাচ্যার্থের অনুগামী হয়, তবে তাকে ধ্বনি বলা হয় না, কারণ ধ্বনির প্রাধান্য সেখানে নয়। যেখানে শব্দ এবং অর্থ শুধুমাত্র ব্যঙ্গতেই প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেটিই হয় ধ্বনির বিষয়। অতএব সংকর অলঙ্কার ও ধ্বনি এক নয়।


কাব্যের ধ্বনি বাচ্যার্থের মতো স্পষ্ট নয়, একমাত্র কাব্যবোধ থাকলেই এই ধ্বনির স্বরূপ উপলব্ধি করা চলে। ধ্বনি যে বাচ্যাতিরিক্ত এক বিশেষ বস্তুর ব্যঞ্জনা এবং ধ্বনিই যে কাব্যের আত্মা, প্রকৃত কাব্যামোদী ব্যক্তি অলঙ্কারবর্জিত সুকাব্য থেকে তার রস উপলব্ধি করতে পারেন। দুটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি স্পষ্ট করা চলে।

‘কৃতে বরকথালাপে কুমাৰ্যঃ পুলকোগমৈঃ।

সূচয়ত্তি স্পৃহামন্তলজ্জায়াবনতাননাঃ।'


অর্থাৎ বিবাহ-প্রসঙ্গে বরের কথায় কুমারীরা লজ্জাবনতাননা হলেও পুলকোগমে তাদের অন্তরের স্পৃহা সূচিত হয়—এখানে বাচ্যার্থের স্পষ্টতায় কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা থাকায় কোনো কাব্যরসিকই এটিকে কাব্যের 'স্বীকৃতি' দেবেন না। পক্ষান্তরে 'কুমারসম্ভব' কাব্যোক্ত সেই চিত্রটি, যেখানে পার্বতীর বিবাহ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন দেবর্ষি এবং তখন পিতার পার্শ্বে উপবিষ্টা পার্বতী—

‘এবং বাদিনী দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।

লীলাকমলপত্রাণি গণয়ামাস পার্বতী।।


অর্থাৎ দেবর্ষি একথা বললে পিতার পার্শ্বোপবিষ্টা পার্বতী নতমুখে লীলাকমলের পত্রগুলি গণনা করতে লাগলেন—বিবাহ-প্রসঙ্গ উত্থাপিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে পার্বতীর ব্যবহারে যে লজ্জারুণ পূর্বরাগের ব্যানা প্রকাশিত হলো, তার জন্য কোনো অলঙ্কারেরও প্রয়োজন হলো না। বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে অর্থাত্তরের ব্যঞ্জনাতেই এর কাব্যত্ব পরিস্ফুট হয়েছে।


ধ্বনিবাদী আলঙ্কারিকগণ ধ্বনির নানাবিধ শ্রেণিবিভাগ করে ‘রসধ্বনি'কেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আচার্য আনন্দবর্ধন এবং আচার্য অভিনব গুপ্ত নানাভাবেই রসের উৎকর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। অভিনব গুপ্ত বলেন, ‘রসধ্বনেঃ এর সর্বত্র মুখ্যভূতমাত্মত্বম্'—বস্তুধ্বনি, অলঙ্কারধ্বনি-আদিরও পর্যাবসান ঘটে রসধ্বনিতে। কাব্যের ধ্বনিও এই রসেরই ধ্বনি। অলঙ্কারশাস্ত্রের শেষ কথা—'বাকাং রসাত্মকং কাব্যম্' অর্থাৎ কাব্য হচ্ছে সেই বাক্য, রস যার আত্মা। অতএব দেখা যাচ্ছে—সেইসব ধ্বনিবাদী, যারা ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য' অর্থাৎ ধ্বনিই কাব্যের আত্মা বলে শুরু করেছিলেন, তাঁরাই 'রস'কে কাব্যের আত্মা বলে সমাপ্তি ঘটালেন।