বাংলা কাব্যে কালিদাসের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভাষার ক্ষেত্রে প্রাকৃত, অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলেও, বাংলা সাহিত্য সর্বাধিক ঋণী সংস্কৃত সাহিত্যের কাছে। আর এই সংস্কৃত সাহিত্যের দিকপাল সাহিত্যিকগণের তুলনায় কালিদাসের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে অপরিসীম। (বৈষ্ণব সাহিত্যে এই প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম হলেও বিরহিনী রাধার মানস বিশ্লেষণে বৈষ্ণবপদে কালিদাসের কাব্য-ধ্বনির রেশ খুঁজে পাওয়া যায়।) কৃত্তিবাসের রামায়ণেও কালিদাসের প্রভাব বিশেষ করে লক্ষ্য করা যায়। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কালিদাস প্রদত্ত রঘুবংশের বংশলতিকাই গৃহীত হয়েছে। বাংলা মঙ্গলকাব্যে বিবাহ বর্ণনা প্রসঙ্গে বর দেখবার জন্য পুরঙ্গণাদের উগ্র ঔৎসুক্য বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনায় রয়েছে কালিদাসেরই সাক্ষাৎ প্রভাব। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যাদিতে পার্বতীর জন্ম, শিবের তপস্যা, মদনভস্ম, রতিবিলাপ প্রভৃতি বর্ণনায় কালিদাসের ‘কুমারসম্ভবে'র প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কবি কঙ্কনে ও অন্যান্য বাংলা কাব্যের ঋতু বর্ণনায় কালিদাস-বর্ণিত ঋতুচিহ্নের প্রভাব স্পষ্ট। কালিদাসের ‘ঋতুসংহার' কাব্যে আছে ছয় ঋতুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে 'বারমাস্যা' বর্ণনায় এই ঋতু বর্ণনার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রাচীন বাংলা কাব্যে প্রকৃতির বহিরঙ্গ চিত্রাঙ্কনে কালিদাসের সঙ্গে এই যে সাদৃশ্য, তা বস্তুগত সাদৃশ্য। কালিদাসের অতি সূক্ষ্ম প্রকৃতিদৃষ্টি প্রাচীন বাংলা কাব্যে নেই।


আধুনিক যুগে কালিদাস নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন। এই আবিষ্কারের মূলে পাশ্চাত্তা পণ্ডিতদের চেষ্টা ও শ্রমের কৃতিত্ব অনেকখানি। কালিদাসের কাব্যের অনুবাদের মধ্য দিয়েই এর প্রথম প্রকাশ ঘটেছে। বাঙালীর রস চেতনায় এর অমোঘ প্রভাব পড়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য বিদ্যাসাগরের শকুত্তলা। মধুসূদনের নাটক—‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী' তে পাত্র-পাত্রীর সংলাপে অনেক জায়গাতেই কালিদাসের সংলাপের অনুবাদ সাদৃশ্য চোখে পড়বে। এ ভিন্ন 'শর্মিষ্ঠা' নাটকে ঘটনা সংস্থানে, প্রণয়লীলা সংগঠনে কালিদাসের অনুকরণ লক্ষিত হয়। পদ্মাবতী নাটকেও নায়িকার পূর্বরাগ, গৌতমী নাম এবং শাঙ্গরবের অনুকরণে শাধের নামকরণে কালিদাসের অনুকরণ রয়েছে। তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের মর্মে রয়েছেন কালিদাস, কালিদাসের কাব্য নিয়ে তিনি নতুন রস সৃষ্টি করেছেন। 'মায়াকানন' নাটকে 'ইন্দুমতী', 'সুনন্দা' নামগুলি রঘুবংশের ইন্দুমতী-সুনন্দার কথাই স্মরণ করায়। মধুসূদনের কাব্য কবিতাতেও কালিদাসের প্রভাব সুস্পষ্ট। তাঁর 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য 'কুমারসম্ভবের' আদর্শেই রচিত। ‘ব্রজাঙ্গনা' প্রভৃতি কাব্যের কতকগুলি কবিতায় কালিদাসের ‘মেঘদূত' কাব্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। 'বীরাঙ্গনা' কাব্যের দুটি কবিতা—‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা' এবং ‘পুরুরবার প্রতি ঊর্বশী’ কালিদাসের নাটকের বিষয় নিয়ে রচিত। 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'তে কালিদাস, মেঘদূত, ঊর্বশী, পুরুরাজ, শকুন্তলা প্রভৃতি কবিতাতে কালিদাসের অন্তরঙ্গ প্রভাবের পরিচয় রয়েছে। 'মেঘনাদবধ' কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে মদন সহায়ে ভবানীর হর-ধ্যানভঙ্গের কল্পনায় কালিদাসের কল্পনার প্রভাব সুস্পষ্ট। মধুসূদনের ওপর কালিদাসের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে উপমা সৃষ্টিতে। বিশেষ করে প্রণয়োপমা সৃষ্টিতে মধুসূদনের মেজাজ কালিদাসের অনুসারী।


বঙ্কিমচন্দ্রের বনদুহিতা কপালকুণ্ডলা কালিদাসের শকুন্তলারই দ্বিতীয় প্রতিরূপ। উনিশ শতকের একাধিক সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, শকুন্তলাকে কেন্দ্র করে রচিত। এর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও চন্দ্রনাথ বসুর 'অভিজ্ঞান শকুন্তলের অর্থ' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


বাংলার কবিতানিকুঞ্জে ‘ভোরের পাখী' বিহারীলাল। তাঁর সমগ্র কাব্য-কবিতাতেই কালিদাসের প্রভাব ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর ‘বন্ধুবিয়োগ,' 'বঙ্গসুন্দরী', 'নিসর্গ সন্দর্শন', 'সারদামঙ্গল' প্রভৃতি কাব্যে ভাবানুষঙ্গে কালিদাসের কতিপয় শ্লোক ও শ্লোকাংশের উদ্ধৃতি দেখা যায়। বিহারীলালের কবিতার প্রধান দুটি দিক—প্রেম ও প্রকৃতি। প্রেম চিন্তায় কবির ওপর রয়েছে কালিদাসের প্রভাব। অবশ্য কালিদাসে বিপ্রলম্ভ থেকে সম্ভোগবাসনাই বেশি, সেখানে বিহারীলাল মূলত বিপ্রলম্ভ বা বিরহের কবি। প্রকৃতি দৃষ্টিতেও বিহারীলাল কালিদাসের সগোত্র। কালিদাসের কাব্যে ও নাটকেপ্রকৃতি যেন মানবজীবনের অন্তরঙ্গ সঙ্গী, সারদামঙ্গল কাব্যের চতুর্থ সর্গের হিমালয়ের বর্ণনায় কালিদাসের প্রভাব সহজেই লক্ষ্য করা যায়। কালিদাসের সঙ্গে বিহারীলালের সাদৃশ্য এই অন্তরঙ্গ আত্মীয়তার যোগে। তবে পার্থক্যও আছে। কালিদাস প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দেখিয়েছেন নিজেকে দূরে রেখে সেখানে বিহারীলাল নিজেকে প্রকৃতির মধ্যে বিলীন করে দিয়ে, তাকে নিজেরই অন্তরে অনুভব করেছেন। কালিদাস নৈর্ব্যক্তিক, বিহারীলাল ব্যক্তিনিষ্ঠ। রমণীরূপে কল্পিত প্রকৃতির সঙ্গেই তাঁর প্রণয়।


কালিদাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগ ছিল নিবিড়। কালিদাসের মানসিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অবশ্য রবীন্দ্রকাব্যে যে কোনো প্রভাব বিচারে আমাদের কাছে যে স্মরণীয় সৃষ্টির প্রেরণা কবির নিজস্ব। তা একান্তই কবির অন্তরের সামগ্রী। কবির সৃষ্টিতে বাইরের রঙের যে প্রতিবিম্ব পড়ে, তাকেও কবি নিজের মনের রঙে রাঙিয়ে নেন। নিজের রুচি ও অনুভব দ্বারা এমনভাবে গ্রহণ করেন যে তা যেন একটা সৃষ্টির পাশে আর একটা নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কালিদাস, রবীন্দ্রমানসধৃত কালিদাস। বাল্য বয়স থেকেই গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে কালিদাসের কাব্যের সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালে 'ছবি ও গান'-এর যুগে কবি কালিদাসকে পেয়েছেন রূপ-পিয়াসীর রূপলোকে, অনুদ্দিষ্ট প্রেম নায়িকার রহস্যময় কল্পনায়। 'কুমারসম্ভব’, ‘শকুন্তলা’ ও ‘মেঘদূত' রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্যচেতনাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে। কবির প্রকৃতি দৃষ্টিতে নতুন অঞ্জন মাখিয়ে দিয়েছে 'মেঘদূত' ও 'ঋতুসংহার'। 'চৈতালি', 'তপোবন' ও 'প্রাচীনভারত' কবিতায় রঘুবংশের দু'একটি চিত্রের আভাস পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রেম-কল্পনায় নতুন রঙ ধরিয়ে দিয়েছে 'কুমারসম্ভব' কাব্য। কালিদাসের প্রেমকল্পনায় রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন একই সঙ্গে মর্ত্যের আবিলতা ও স্বর্গের পবিত্রতা, যৌবনের উন্মাদনা ও বার্ধক্যের প্রশান্তি। কেবল 'কুমারসম্ভব' কাব্যে নয়, 'শকুন্তলা' নাটকে ও ‘মেঘদূত' কাব্য থেকেও রবীন্দ্রনাথ এই প্রেম-নির্যাস বের করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে অন্ধ প্রেমসম্ভোগ আমাদের স্বাধিকার প্রমত্ত করে। তা ভর্তুশাপের দ্বারা খণ্ডিত (কুমারসম্ভব), ঋষিশাপের দ্বারা প্রতিহত (শকুন্তলা) এবং দেবরোষের দ্বারা ভস্মসাৎ (মেঘদূত) হয়ে থাকে। রবীন্দ্র-বীণার তারে কালিদাসের কাব্যঝঙ্কার এমনই নব নব ঝঙ্কার সৃষ্টি করেছে। 'কুমারসম্ভব' কাব্যের ভাব রবীন্দ্রনাথের নন্দন-তত্ত্বকেও প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথের মতে শিল্পসুন্দরেরই প্রতিমূর্তি। কিন্তু এ সৌন্দর্য অসংযত কল্পনাবৃত্তির সৃষ্টি নয়। সৌন্দর্যের আকর্ষণ সংযমের দিক। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিদৃষ্টির সঙ্গেও কালিদাসের গভীর যোগ রয়েছে। কালিদাস প্রকৃতিকে শুধু জীবন্ত কল্পনা করেন নি, মানব হৃদয়ের সঙ্গে তাকে একসূত্রে গেঁথে তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন মানবজীবনে প্রকৃতির লীলা আর প্রকৃতির ভেতর মানবজীবনের জীবন্ত অভিনয়। তাঁর 'ঋতুসংহার' কাব্যে ছয় ঋতুর বহিরঙ্গ রূপের চিত্রের সঙ্গে নর-নারীর প্রণয়লীলা ছবির মতো ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রকাব্যেও প্রকৃতি ও মানুষ একান্ত ও একাকার। তাঁর 'বলাকা' কাব্যে শাজাহান-প্রিয়া মিশে আছেন ‘প্রভাতের অরুণ আভাসে ক্লান্ত সন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে'। প্রকৃতির রাজ্যেও দেখা যায় মানুষি-লীলার অনুকরণ : শুনিয়া তপন অস্তে নামিল শরমে গগন ভরি,/ শুনিয়া চন্দ্র থমকি রহিল বনের আড়াল করি। কালিদাসের শরৎ ও বসন্ত বর্ণনার চিত্রগুলিও রবীন্দ্রনাথে স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের ঋতু বিষয়ক গানে ও কবিতায় কালিদাসের ঋতুচিত্রের রঙ্ ও রেখার সাদৃশ্য অতি স্পষ্ট। অবশ্যই এই সাদৃশ্য বহিরঙ্গের। একে অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথের ঋতু বর্ণনার সুর আরও গভীর এবং নতুন মাত্রাযুক্ত।


আধুনিক কবিদের মধ্যে ও সাম্প্রতিককালের কালিদাস চর্চায়ও কালিদাস নানাভাবে এসে উপস্থিত হয়েছেন। কখনও অনুবাদে, কখনও মরমী ভাবনায়। মনের তারে বাজিয়ে তুলেছে জলতরঙ্গের নানা সুর। এ প্রভাব অনিঃশেষ।