'গীতগোবিন্দ' অবলম্বনে জয়দেবের কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়ে বাংলা কাব্যে তাঁর প্রভাব | গীতগোবিন্দ অবলম্বনে জয়দেবের কবিত্বের পরিচয় দিয়ে বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কেন তিনি স্মরণীয় হয়ে রইলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করো।

জয়দেবের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে আলোচনা কর। তাঁর রচিত কাব্যটির সৌন্দর্য বিশ্লেষণ-প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব


জয়দেব একদিকে সংস্কৃত ভাষার শেষ অবিস্মরণীয় কবি এবং বাংলা কাব্যেরও প্রথম স্মরণীয় কবি— তাঁর 'গীতগোবিন্দ' অবলম্বনে এমন ধারণার সার্থকতা বিচার করো।

জয়দেব সংস্কৃত ভাষার শেষ বড় কবি এবং প্রকারান্তরে বাংলা ভাষার আদিকবি; বাংলা সাহিত্যে জয়দেবের প্রভাব আলোচনা করো।


জীবৎকাল : জয়দেবের জন্মকাল সম্বন্ধে কিছুই জানা সম্ভবপর না হলেও তাঁর জীবৎকাল-বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা করা চলে। জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ' কাব্যে উমাপতিধর, শরণ, গোবর্ধন এবং ধোয়ীর নাম তাঁর নিজের নামের সহযোগে উচ্চারণ করেছেন। ঐতিহ্যানুসারে এই পঞ্চজন সেনবংশীয় সম্রাট লক্ষ্মণসেনের রাজসভার ‘পঞ্চরত্ন’ ছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। মেবারের রাণা কুম্ভ, প্রখ্যাত বৈষ্ণবসন্দর্ভকার সনাতন গোস্বামী এবং ‘শেকশুভোদয়া' গ্রন্থেও লক্ষ্মণসেনের সভায়ই যে জয়দেব উপস্থিত ছিলেন, তার উল্লেখ রয়েছে। অতএব, জয়দেব লক্ষ্মণসেনের সমকালীন ছিলেন—এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো বাধা নেই। লক্ষ্মণসেন দীর্ঘজীবী পুরুষ ছিলেন এবং তিনি শেষ জীবনেই রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন, সম্ভবত ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লক্ষ্মণসেন রাজত্ব করেছিলেন। অতএব দ্বাদশ শতকের শেষদিকে যে জয়দেব গোস্বামী বর্তমান ছিলেন, এ বিষয়ে সংশয়ের কোন কারণ নেই।


সংস্কৃত সাহিত্যধারায় শেষ কবি :

ঐতিহ্যানুসারে এবং প্রাপ্ত তথ্যাদির সদ্ব্যবহার করে আজ প্রায় নিশ্চিতভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে যে কবিকুলপতি জয়দেব গোস্বামী অপর কয়জন প্রতিষ্ঠিত কবি-সহ দ্বাদশ শতকের শেষ পাদে গৌড়াধিপতি রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজসভাকে অলঙ্কৃত করেছিলেন। অতএব কালের বিচারে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয় যুগের কবি। বস্তুত দেশব্যাপী সাহিত্য-সাধনায় তখন প্রাকৃত-অবহট্‌ঠের স্রোতও মন্দীভূত হয়ে এসেছিল, প্রতিটি রাজ্যেই তখন সর্বভারতীয় আর্যভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ আত্মপ্রতিষ্ঠায় সমুদ্যত। জয়দেব যখন সংস্কৃত ভাষায় তাঁর অনুপম ‘গীতগোবিন্দ' কাব্য রচনা করেন, সম্ভবতঃ তার সমকালেই এই গৌড় বাংলাতেই একদিকে যেমন সরহপাদ প্রভৃতি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য অবহট্ঠ ভাষায় দোহা রচনা করছিলেন, তেমনি তিনি এবং আরো অনেক সহজিয়া সাধক সদ্য উদ্ভুত প্রাচীন বাংলা ভাষার চর্যাপদও রচনা করে চলছিলেন। কাজেই জয়দেবের আবির্ভাব কালটা ছিল সাহিত্যের বিচারে 'যুগসন্ধি'কাল – প্রাচীন রীতির সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা তখন ক্রমক্ষীয়মাণ এবং নবোদ্ভূত বাংলা ও অপরাপর নব্যভারতীয় আর্য সাহিত্যে শুভারম্ভ। এই যুগসন্ধিক্ষণের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন কবিরাজ জয়দেব গোস্বামী — যাঁর রচিত, 'গীতগোবিন্দ' কাব্যকে বলা চলে সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ সক্ষম রচনা এবং এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও যে এই 'গীতগোবিন্দ’ থেকেই বাংলা সাহিত্যের আরম্ভ, সশ্রদ্ধভাবে এই স্বীকৃতিটুকুও কাব্যটির প্রাপ্য। এ বিষয়ে একালের পণ্ডিতাগ্রগণ্য আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অভিমতটুকু শিরোধার্য। তিনি বলেন, ‘Jayadeva sang not only the swan song of the age which was passing away, but he also sang in the advent of a new age in Indian literature the 'Vernacular' age. He thus sands at the jugasandhi, a confluence of two epochs, with a guiding hand for the new epoch that was coming. Jayadeva can fully be called 'the last of the ancients and the first of the modern in Indian Poetry'"। এই একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় অপর এক আচার্য সুকুমার সেনের কণ্ঠেও। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ'-বিষয়ে তিনিও অভিন্নমত। তিনি বলেন, “জয়দেবের হাতে, এই গানগুলিতে, সংস্কৃত ভাষার শেষবারের মতো নূতন শক্তি দেখান হইল এবং সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ বিকাশ ঘটিল। অতঃপর সংস্কৃতে আর সত্যকার নূতন বলিয়া কিছু সৃষ্ট হয় নাই। ..... গীতগোবিন্দ যেমন সংস্কৃত সাহিত্যের শেষ কাব্য এবং ইহার গানগুলি সংস্কৃত সাহিত্যে প্রথম গান, তেমনি বাংলায় তথা অপর সব আধুনিক ভারতীয় ভাষায় সভাসাহিত্যের উদ্বোধক। বাংলা, গুজরাটি প্রভৃতি আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষায় সাহিত্যের আলোচনা জয়দেবের গীতগোবিন্দ লইয়াই শুরু করিতে হয়।"


সংস্কৃত সাহিত্যে কৃতিত্ব : জয়দেব যে সংস্কৃত ভাষায় বড় কবি ছিলেন, বস্তুতঃ জনপ্রিয়তায় কালিদাসের পরই তাঁর আসন নির্দিষ্ট হয়েছিল, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বহু মনস্বী সমালোচক। বাণভট্টাদির রচনায় সংস্কৃত ভাষার যেমন ঐরাবত গতি লক্ষ্য করা যায়, জয়দেবের কাব্যে রয়েছে তার বিপরীত শক্তির পরিচয়— লঘুগতি পতঙ্গের মতো যেন উড়ে চলেছে সংস্কৃত ভাষা – এই স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় অপর কোন কবির কাব্যে নেই। পণ্ডিতপ্রবর Winternitz বলেন, “It is however astonishing that he was able to combine so much passion and sentiment of love, so much alliteration in language, that after resound as pure music in our ears, with such an ornate and yet artificial a form. It is no wonder that in India the poem enjoys unusual popularity and has always found admirers even outside India." I আমাদের দেশে পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা জার্মান মনীষী মহামতি গায়টেও 'গীতগোবিন্দ' কাব্যটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।


গীতগোবিন্দের ভাষা ও ছন্দে আধুনিকতা :

সংস্কৃত ভাষায় রচিত শেষ বড়ো কাব্য-রূপে 'গীতগোবিন্দ সহজে স্বীকৃতি পেলেও বাংলা তথা দেশীয় কাব্যের আদি নিদর্শন-রূপে তাকে গ্রহণ করার বিষয়ে দ্বিধা থাকা একান্ত স্বাভাবিক, এর প্রধান কারণ—ভাষাগত ভিন্নতা। কিন্তু জয়দেব সংস্কৃত ভাষার দুরূহ জটিল সমাসবদ্ধ পদকে কেমন অনায়াসে নমনীয়, তরল, কোমল দেশীয় ভাষার সমীপবর্তী করে তুলেছিলেন, তা' কি কারো দৃষ্টি এড়াতে পারে? ‘ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী' কিংবা 'বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে' অথবা 'ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মমজীবনং ত্বমতি মম ভবজলধিরত্নম্'— জাতীয় সংস্কৃত পদগুলি কি একেবারেই বাংলার কাছাকাছি চলে আসেনি? এ ছাড়া ছন্দের দিক থেকেও জয়দেব যে সংস্কৃত রীতি ত্যাগ করে তৎকাল-প্রচলিত অপভ্রংশ অবহট্ঠ ছন্দ গ্রহণ করেছিলেন, সেখানেও কি তিনি সচেতনভাবেই দেশীয় ভাষারীতি স্বীকৃতি দান করেন নি। চরণাস্তিক মিল স্থাপনের মধ্যেও তিনি সংস্কৃত রীতি পরিত্যাগ করে দেশীয় রীতি গ্রহণ করেন – যা বাংলা ভাষার আদিযুগ থেকেই স্বীকৃতি লাভ করে আসছে। নিম্নে বাংলা সাহিত্যে জয়দেবের কাব্যের প্রভাব-বিষয়ে যে আলোচনাটি উদ্ধৃত হল সেখানেও আমরা জয়দেবকে বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূতরূপে গ্রহণ করবার সার্থকতা খুঁজে পাবো।


বাংলা সাহিত্যে জয়দেবের প্রভাব :

“সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যেই জয়দেবোত্তর যুগে 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের যে অসাধারণ প্রভাব পড়েছিল, সেই কারণেই আচার্য সুনীতিকুমার জয়দেবকে ‘আধুনিক যুগের উদ্‌গাতা' ('The first of the Moderns') বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর প্রভাব বাংলা সাহিত্যেও এত গভীর এবং ব্যাপক ছিল যে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অন্তর্ভুক্তি আবশ্যিক বিবেচিত হয়। জয়দেবের রূঢ় সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্রও কিন্তু তাঁকে ‘বাঙালী কবি' এবং 'বাংলার প্রাচীন কবি’-রূপে অভিহিত করেছেন। একান্তভাবে বৌদ্ধধর্মীয় সাহিত্য চর্যাপদকে বাদ দিলে বড়ুচণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'কে নিয়েই বাংলা সাহিত্যের আরম্ভ বলে মেনে নিতে পারি। গ্রন্থটি একেবারে গীতগোবিন্দের আদলে তৈরি। 'গীতগোবিন্দে’র মতোই এখানে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধিকা এবং বড়াই বুড়ী – এই তিন পাত্র পাত্রীর উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে এই নাট্যগীতটি রচিত হয়েছে। 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের বহু পদের আক্ষরিক অনুবাদও এই গ্রন্থেও রয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দুটি প্রধান ধারা – গীতিকাব্য ও মঙ্গলকাব্য। গীতিকাব্যের ধারা বলতে প্রধানতঃ বৈষ্ণবপদসাহিত্যকেই বোঝানো হয় এবং নিঃসন্দেহে বলা চলে এই ধারাটির সৃষ্টি ‘গীতগোবিন্দ’কে অনুসরণ করেই। কাব্যের গঠন এবং বিষয়—উভয়দিক থেকে বৈষ্ণব পদে জয়দেবেরই অনুসৃতি লক্ষ্য করা যায়। যতখানি সম্ভব যুক্তাক্ষর-বর্জিত সরল ধ্বনিযুক্ত শব্দের ব্যবহার এবং ছন্দের সঙ্গে ভাবের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করে যে অমৃতমধুর বৈষ্ণব পদাবলী দীর্ঘকাল বাংলা ভাষায় রচিত হয়ে আসছে, তারও আদর্শ জয়দেব। প্রথম বৈষ্ণবপদকর্তা বিদ্যাপতি ঠাকুর যে 'অভিনবজয়দেব' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, তা'—থেকেই তাঁর উপর জয়দেবের প্রভাব অনুসৃত হয়। শুধু এ জাতীয় গীতিকাব্যেই নয়, কাহিনী-কাব্যধারায়ও যে জয়দেবের প্রভাব বর্তমান ছিল, তার প্রমাণ মঙ্গলকাব্যগুলি। জয়দেব তাঁর কাব্যকে বলেছেন 'মঙ্গলমুজ্জ্বলগীতি’ – পরবর্তী মঙ্গলকাব্যে যে দল বেঁধে পালা গান গাওয়া হত, এই রীতিটিও গীতগোবিন্দ থেকেই গৃহীত হয়। ... অনেকেই মনে করেন, বাংলার কীর্তন গানের সূচনাও জয়দেবকে অবলম্বন করেই। নৃত্য এবং নৃত্যনাট্যে ‘গীতগোবিন্দ' গানের প্রয়োগও বহুস্থলেই লক্ষ্য করা যায়। ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিভিন্ন মন্দিরের ভাস্কর্যে এবং চিত্রশিল্পেও গীতগোবিন্দের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবেই অনুভব করা যায়। .... ফলতঃ জয়দেব গোস্বামীর সর্বভারতীয় প্রভাবের স্বীকৃতিরূপেই ড. সুকুমার সেন বলেন, 'ইনি এক হিসাবে বাঙ্গালা প্রভৃতি আধুনিক আর্যভাষার আদি কবিও বটেন। ইঁহারই গীতিকবিতার আদর্শে বাঙ্গালাদেশে, মিথিলায় ও অন্যত্র রাধাকৃষ্ণ পদাবলী ও অনুরূপ গীতিকবিতার ধারাস্রোত নামিয়াছিল'।” (শ্রীপরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস')।


এই প্রসঙ্গে পণ্ডিত প্রবর অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর অভিমতটি সশ্রদ্ধায় স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, “সংস্কৃত দেবায়ত প্রেম কবিতার অব্যবহিত সার্থক উত্তরাধিকারী বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী। প্রেমের কবিতা লৌকিক ভাবের অধিবাসনে জয়দেব আসিয়া রাধাকৃষ্ণের লীলা-বর্ণনায় যে রূপে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, সেই রূপেরই যথাযথ প্রকাশ ও বিকাশ দেখা যায় বাংলা বৈষ্ণব কবিতায়। বাংলার বৈষ্ণবপদের গঙ্গোত্রী জয়দেব। আকারে প্রকারে, হাবে-ভাবে, ঝঙ্কারে অলঙ্কারে, রসের প্রকাশে ও আস্বাদনের লক্ষ্যে বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী জয়দেব গোস্বামীর ‘মধুরকোমলকান্তপদাবলী'র প্রতিরূপ। এমন কি জয়দেব ব্যবহৃত ‘পদাবলী' শব্দটির রূঢ়ার্থও ইহাতে পরিগৃহীত। .... এই জয়দেব সংস্কৃত প্রেমকবিদেরও অন্যতম উত্তরসূরী। .... তাঁহার রাধাপ্রেম যুগ-যুগান্তবাহিত প্রেম প্রবাহের এক তুষশীর্ষ চলোমি। বাংলায় বৈষ্ণব কবিতা এই রাধা ও রাধাপ্রেমের নিকট ঋণী।"