'অবতরণিকা' গল্পের মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে স্বার্থসর্বস্ব বাঙালি মধ্যবিত্তের পারিবারিক ছবি–আলোচনা করো।

‘অবতরণিকা' গল্পের মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীর আত্মস্বাতন্ত্র ও মর্যাদাবোধ কতদূর উপেক্ষিত হয়, সেটিই প্রকাশ করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র।


কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র কল্লোলউত্তর পর্বের লেখক হলেও রাজনীতি ও যৌনতার পরিবর্তে বাঙালি জীবনের সাধারণ পারিবারিক সুখ-দুঃখেরকথাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর গল্পে। গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি তাঁর গল্পে এসেছে নাগরিক জীবনের কথাও। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালির আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের পরিবর্তন, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং পুরোনো মূল্যবোধের সঙ্গে নতুন জীবনচেতনার বিরোধ ও দোলাচল অসাধারণ স্বাভাবিকতায় উন্মোচিত হয়েছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে। 'অবতরণিকা' গল্পেও সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, স্ববিরোধ, দোলাচল, সংঘাত, অস্তিত্বের পুনরাবিষ্কার এই গল্পে এক মন্থর, দীর্ঘ এবং অনাটকীয়ভাবেই ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে।


‘অবতরণিকা’ গল্পের আখ্যানবস্তু সামান্যই। সুব্রত এবং তার স্ত্রী আরতি আছে এই গল্পের কেন্দ্রে। সংসারটি বড়ো। সুব্রত-আরতির দুটি ছেলেমেয়ে—বাবলু আর মন্দিরা। এ ছাড়া আছেন সুবতর মা সরোজিনী ও বাবা প্রিয়গোপাল এবং তাঁদের ছোটো ছোটো তিনটি সন্তান—নীলা, নত্তু ও সত্তু। প্রিয়গোপালবাবু প্রাচীনপন্থী মানুষ। পূর্ববঙ্গে ঢাকা জেলায় জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বংশমর্যাদা সম্পর্কে তিনি অতি মাত্রায় সচেতন। নারী তাঁর কাছে অন্তঃপুরিকা। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে পড়তে শুরু করেছিল আরতি। পুত্রবধূকে এনে আর কলেজে পড়তে দিতে রাজি হননি। আর ঘরের বউয়ের চাকরি করা তো তাঁর কাছে অমর্যাদাকর। তাই সুব্রতর সংসারে এসে আর্থিক অসচ্ছলতা দেখেও তিনি অবুঝের মতোই আরতির চাকরি করার বিরোধিতা করেছেন প্রথম থেকে। সরোজিনীও সংসারের সব দায়িত্ব আরতিকে বুঝিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, সংসারের চেয়ে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় আর নেই।


সুব্রত অফিস আর টিউশনি থেকে যা পায়, তাতে এত বড়ো সংসারের খরচ চলে না। আরতি অনেক চেষ্টা করেছে খরচ কমাবার। কিন্তু সংসারের আর্থিক দুর্দশা ফেরানো তার সাধ্যাতীত। তাই একসময় সুব্রতই গরজ দেখিয়েছিল আরতির চাকরির জন্য। কোন্ কোন্ বন্ধুর বউ স্কুলে পড়ায় বা অন্য চাকরি করে, সেই খবর শুনিয়ে আরতিকে চাকরির ব্যাপারে উৎসাহিত করতে চেয়েছিল। সুব্রতই বিজ্ঞাপন দেখে নিজেই দরখাস্ত লিখে আরতিকে দিয়ে সই করিয়ে নেয়, তারপর সেই দরখাস্ত অফিসে বা ডাকে দিয়ে আসত নিজের হাতেই। বোঝাতে চাইত, আজকালকার দিনে আর পুরুষ হোক বা মেয়ে হোক, কারও বসে খাবার দিন নেই।


অতএব সুব্রতর আগ্রহাতিশয্যেই ক্যানিং স্ট্রিটের মুখার্জী অ্যান্ড মুখার্জী ফার্মে সেলাই মেশিন অভিজাত বা অবস্থাপন্নদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করার কাজে নিয়োজিত হল আরতি। এরপরেই শুরু হল পুরোনোপন্থী মধ্যবিত্ত সংসারে পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন। ঘরের বউ চাকরি করবে, সেটা রক্ষণশীল প্রিয়গোপালের বংশমর্যাদায় লাগে। তাই প্রিয়গোপাল বিরক্ত হন। সরোজিনী বিরক্ত হন ছোটো ছেলেময়েদের তাকেই সামলাতে হয় বলে। আরতি এইসব প্রতিকূলতার মধ্যেই চাকরি করে। সংসারে খুঁটিনাটি বাড়তি প্রয়োজন, ছোটোদের কমলালেবু খাবার শখ-আহ্লাদ, অসুখবিসুখের খরচ সবই সামাল দিতে আরতির চাকরিই ভরসা। অবশ্য মাথায় ঘোমটা দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে যাওয়া বা সকলের অন্যান্য সুখ-সুবিধার দিকে নজর দেবার ব্যপারে কোনো ব্যত্যয় ঘটায় না আরতি। কেবল চাকরির ব্যাপারে সে অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী। চাকরির শর্ত অনুযায়ীই তাই তার ফিরতে ফিরতে কোনো কোনো দিন একটু রাত হয়ে যায়।


ক্রমশ দেখা যায়, আরতির চাকরির ব্যাপারে নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতার ফলে সুব্রতর মধ্যেও জমতে থাকে অসন্তোষ। মুখার্জী অ্যান্ড মুখার্জী ফার্মের জুনিয়ার পার্টনার হিমাংশুবাবুকে যেন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় সুব্রতর। সুব্রতর মনে হতে থাকে আরতির যেন দিনের পর দিন টাকার পিছনে ছোটার একটা নেশা তৈরি হচ্ছে। একটা পার্টটাইম চাকরি পেয়ে যাওয়ায় সে আরতিকে চাকরি ছাড়তে চাপ দেয়। টাকা সংসারে দরকার। কিন্তু সুব্রতর যুক্তি হল, টাকার চেয়ে বড়ো শান্তি। আরতি চাকরি ছাড়তে কিছুতেই চায় না। ফলে সুব্রত-আরতির পরস্পরের দূরত্বও বাড়ে অবধারিতভাবে।


শেষ পর্যন্ত সুব্রত ভদ্রতাবোধ বিসর্জন দিয়ে আরতির ব্যাপারে অভিযোগ জানায় শ্বশুর নিবারণ বাঁড়ুজ্জের কাছে। আরতির সঙ্গে কথা বন্ধ হয়। উভয়ে পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত জানায় শ্বশুরমশাইকে। আরতিকে নিবারণবাবুর কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল সুব্রত। কিন্তু এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনেই একটা আকস্মিক বিপর্যয় ঘটে গেল। সুব্রতদের জয়লক্ষ্মী ব্যাংকে তালা পড়ল। চাকরি গেল সুব্রতর। আর আশ্চর্যজনকভাবে এরপরই সুব্রতর আচরণে তথা সুব্রত-আরতির সম্পর্কের উন্নতি ঘটে গেল। আসলে সুব্রত চরিত্রটির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তীব্র স্ববিরোধ। নিজ অবস্থা, প্রয়োজন ও পরিস্থিতির ভিত্তিতে তার মানসিকতার সুবিধাজনক পরিবর্তন ঘটতে দেখি আমরা। যে সুব্রত অনেকদিন আরতির চাকরির ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী ছিল, সেই সুব্রতই একটা পার্ট টাইম চাকরি পেয়ে গেলে এবং বাবা-মায়ের পুরোনোপন্থীর চাপে স্ত্রীর চাকরি করায় বাধা দেয়। আবার নিজের চাকরি চলে গেলে তাকে দেখি চাকরিস্থলে যাবতীয় অসম্মান ও দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে আরতিকে মালিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরামর্শ দিতে। আরতি আত্মমর্যাদার প্রশ্নে চাকরি ছেড়ে দিলে সাংসারিক প্রয়োজনের কথা ভেবেই সরোজিনী বিস্মিত হন। তাঁর আচরণ ও মন্তব্যে প্রকাশ পেতে থাকে পুত্রবধূর চাকরি করার ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন। প্রিয়গোপাল অবশ্য বাহ্যত সাংসারিক ব্যাপার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চান। কিন্তু তাঁর ডালিমের রসের সঙ্গে স্বর্ণসিন্দুর মেড়ে চেটে চেটে খাবার পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের প্রত্যাশাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


এমনকি আরতির অফিসের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা কর্মচারী এডিথের সঙ্গে কোম্পানির অসংগত ও অসম্মানজনক আচরণের প্রতিবাদে আরতি চাকরি ছেড়ে দিলে সরোজিনী ও সুব্রত যখন এডিথের চরিত্রের প্রতি কু-ইঙ্গিত করে বা নারীর এই আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে আরতির বঙ্গনারীর সেন্টিমেন্ট বলে ব্যাখ্যা করে, তখন আরতি আশ্চর্য হয়ে যায়। অন্তত সুব্রতর এই সুবিধাবাদী ও স্বার্থসর্বস্ব সংকীর্ণ মানসিকতা তাকে বেদনার্ত করে তোলে।


‘অবতরণিকা’ গল্পের আখ্যান ও বর্ণনাভঙ্গিতে কোনো চমক নেই। নিতান্তও বিবৃতিধর্মী এই গল্প। কিন্তু সেই মন্থর বিবৃতি ও গল্পের ধীর-লয় অগ্রগতির সঙ্গে একটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের অস্তিত্ব সংকট ও স্বার্থসর্বস্বতার রূপটি যেন ক্রমশ প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। প্রকাশিত হয়েছে চরিত্রগুলির প্রাচীন আভিজাত্যবোধ ও মর্যাদাবোধের চূড়ান্ত অন্তঃসারশূন্যতাও। পুরাতন ও নতুন ধারণার মধ্যে দোলাচলের মধ্য দিয়ে আসলে শেষ পর্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলির আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থবোধের স্বরুপটিও। বিশেষ করে এই ধরনের পরিবারে একটা সাধারণ অথচ স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী নারীর অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধ কীভাবে লাঞ্ছিত হয়, সেটিও ‘অবতরণিকা’ গল্পটিতে উদ্ঘাটিত হয়েছে। সেদিক থেকে 'অবতরণিকা' গল্পটি যেন স্বার্থসর্বস্ব বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্পণ।