জোড়াসাঁকো নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা, অভিনীত নাটক ও অভিনয় অনুষ্ঠান, নটসমাবেশ এবং অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর।

বেলগাছিয়া নাট্যশালা, পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ের পর তৃতীয় প্রধান সথের নাট্যশালা হল জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই এই নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তবে কোন্ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা' সঠিক জানা যায় নি। এই নাট্যশালাটির প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি পত্র থেকে জানা যায় যে গোপাল উড়ের যাত্রা শুনেই তাঁদের মনে নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা জাগে। কেশবচন্দ্র সেনের ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী সেন, কবি অক্ষয় চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি এই নাট্যশালার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। আর শিক্ষক ছিলেন কৃষ্ণবিহারী সেন।


নাট্যশালাটির প্রতিষ্ঠাকাল জানা না গেলেও মনে হয় ১৮৬৩-৬৪ সালেই স্থাপিত হয়েচিল। এখানে সর্বপ্রথম অভিনীত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'কৃষ্ণকুমারী নাটক এবং তারপর মধুসূদনেরই রচিত প্রহসন 'একেই কি বলে সভ্যতা?' এই দু'টি অভিনয়েরই তারিখ জানা যায়নি। তবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি' থেকে উক্ত ‘কৃষ্ণকুমারী' নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে অনেক তথ্যাদি জানতে পারা যায়। এই অভিনয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কৃষ্ণকুমারীর মাতা এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা'য় সার্জেনের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ঐ স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, “তখনকার শ্রেষ্ঠ পটুয়াদিগের দ্বারা দৃশ্যগুলি অঙ্কিত হইয়াছিল। ড্রপসীনে রাজস্থানের ভীমসিংহের সরোবরতটস্থ ‘জগমন্দির’ প্রাসাদ অঙ্কিত হইল।”


নাটকের অভিনয় প্রস্তুতি সম্পর্কে লিখেছেন, “নাট্যোল্লিখিত পত্রগুলির পাঠ আমাদের সবাইকে বিলি করিয়া দেওয়া হইল ।... ছয়মাসকাল যাবৎ দিনে রিহার্শাল, আর রাত্রে বিবিধ যন্ত্র সহকারে কন্‌সার্টের মহড়া চলিল। আমি কসার্টে হারমোনিয়াম বাজাইতাম। স্টেজও যতদূর সাধ্য সুদৃশ্য ও সুন্দর করিয়া সাজান হইয়াছিল। দৃশ্যগুলিকে বাস্তব করিতে যতদূর সম্ভব চেষ্টার ত্রুটি করা হয় নাই। বনদৃশ্যের সীখানিতে নানাবিধ তরুলতা এবং তাহাতে জীবন্ত জোনাকি পোকা আঠা দিয়া জুড়িয়া অতি সুন্দর এবং সুশোভন করা হইয়াছিল। দেখিলে ঠিক সত্যিকারের বনের মতই বোধ হইয়াছিল।”


এই অভিনয়ের পর নাট্যশালার ব্যবস্থাপক কমিটি শিক্ষাপ্রদ উপযুক্ত নাটকের অভাব দেখে ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দীর পরামর্শে বহুবিবাহ সামাজিক সমস্যা বিষয়ক একটি নাটক রচনার জন্য 'Indian Daily News' (জুন ১৮৬৫) পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এবং পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিছুদিন পর ঐ বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে বিখ্যাত নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নের উপর নাটকটি রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার ‘হিন্দু মহিলাদের অবস্থা ও অসহায়তা এবং পল্লীগ্রামের জমিদারগণের অত্যাচার'—এই দুটি বিষয়ে ভাল নাটক রচনার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে 'Indian Mirror' পত্রিকায় ১৮৬৫ সালের ১৫ই জুলাই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।


রামনারায়ণ তর্করত্ন বহুবিবাহ বিষয়ে ‘নবনাটক’ রচনা করেন। অল্পদিনের মধ্যেই দুশ টাকা পুরস্কার ও সম্বর্ধনা লাভ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন ইতিপূর্বে কুলীনপ্রথার বিষময় ফল বিষয় অবলম্বনে 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটক করে প্রচুর খ্যাতি ও পুরস্কার লাভ করেছিলেন। 'নবনাটক' রচনার জন্য জেড়াসাঁকের ঠাকুরবাড়িতে ১৮৬৬ সালের ৬ই মে প্যারীচাঁদ মিত্রের সভাপতিত্বে এক অনুষ্ঠানে রামনারায়ণ তর্করত্নকে একটি রৌপ্যধারে দুই শত টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৮৬৭ সালের ৫ই জানুয়ারী এই নবনাটক অভিনীত হয় জোড়াসাঁকো নাট্যশালায়।


এই নাটকের বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনেতাদের নাম জানা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায়’ : “আমি হইলাম নটী, আমার জ্যেঠতুতো ভগিনীপতি নীলকমল মুখোপাধ্যয় সাজিলেন নট। আমার নিজের আর এক ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় চিত্ততোষ, আর এক ভগিনীপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গে পিাধ্যায় হইলেন গণেশবাবুর বড় স্ত্রী। সুপ্রসিদ্ধ কমিক অক্ষয় মজুমদার লইলেন গণেশবাবুর পাঠ। বাকি আমাদের অন্যান্য আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের জন্য নির্দিষ্ট হইল।... শ্রীযুক্ত মতিলাল চক্রবর্তী কৌতুকের পাঠ লইয়াছিলেন। আমার এক শ্যালক অমৃতলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটগিন্নির ভূমিকায়...। বিনোদলাল গঙ্গোপাধ্যায়... সুবোধের ভূমিকায়...।”


‘নবনাটকের অভিনয় সম্পর্কে বিবরণ জানা যায় 'The National Paper ( ১৮৬৭ সালের ৯ই জানুয়ারী) এবং সোমপ্রকাশ (১৮৬৭সালের ১৮ই জানুয়ারী)-এ। “অভিনয় খুব নিপুণতার সহিত সম্পাদিত হইয়াছিল।” নাট্যশালা প্রকৃত রীতিতে নির্মিত ও দৃশ্যগুলি, সুন্দর, বিশেষত সূর্যাস্ত ও সন্ধার সময় অতি মনোহর হইয়াছিল।... এ সমৃদয়গুলি এতদ্দেশীয় শিল্পজাত।” নাট্যশালার ব্যবস্থাপক ব্যক্তিগণ নাট্য প্রযোজনাকে বাস্তবমুখী করে তুলতে কতখানি সচেষ্ট ছিলেন তা' এইসব বিবরণ থেকেই বোঝা যায়। জীবন্ত জোনাকীপোকা আঠা দিয়ে দৃশ্যপটের গায়ে লাগানোর চেষ্টা কিছুটা অতিরিক্ত মনে হলেও চমকপ্রদ অবশ্য বলতে হবে। তাছাড়া আলোকসম্পাতের কৌশলে সূর্যাস্ত ও সন্ধ্যার দৃশ্যকে বাস্তব করে তোলা, নিপুণতার পরিচয় সন্দেহ নেই। সুতরাং মঞ্চের সাজসজ্জা আলোকসম্পাত এবং সর্বোপরি অভিনয়ের দক্ষতা, এই সব দিক দিয়েই জোড়াসাঁকো নাট্যশালার অবদান নাট্যশালা ও অভিনয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


জোড়াসাঁকো নাট্যশালায় ‘নবনাটকে'র প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৭ সালের ৫ই জানুয়ারী ২২পৌষ, ১২৭৩। প্রথম অভিনয়ের দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন নিজেও। ঠাকুরবাড়ির এই নাট্যশালায় ‘নবনাটক’ নয়বার অভিনীত হয়েছিল। এই অভিনয় কতটা সাফল্য এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল, পরবর্তীকালের একজন বিখ্যাত অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফীর এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় : “ এই অভিনয় দেখিয়াই আমার অভিনয় সম্বন্ধে যাহা কিছু দেখিবার, শুনিবার ও জানিবার বাকী ছিল তাহা সম্পূর্ণ হইয়া গেল।”


১৮৬৭ সালের প্রথমার্ধেই জোড়াসাঁকো নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যায়।