“তিনি সর্বত্র দেখিতেছেন শুধু শয়তানি এবং তাঁহার এই অনুভূতি তাঁহার মধ্যে যে রস সৃষ্টি করিতেছে তাহারই ডিয়ান করিয়া তাঁহার ছোটগল্পগুলি রচনা করিতেছেন, তাই সেগুলি হইয়া উঠিতেছে, রূপে রসে অদ্বিতীয়"—গল্পকার জগদীশ গুপ্তের 'পয়োমুখম' গল্পটি প্রসঙ্গে সমালোচকদের এই মন্তব্য কতখানি প্রযোজ্য, তা বিচার করো।

পুরাতনের প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে প্রাচীন বিশ্বাসকে চূর্ণ করবার স্পৃহা নিয়েই জগদীশ গুপ্ত সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জীবনের সকল নীতিবোধ ও কল্যাণময়তাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন, কারণ বিশ্বপ্রবাহের মূলে এক বিনাশক, ক্রুর ও কদর্য এক অমোঘ শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। ভগবান, নৈতিকতা, ধর্ম—এসবই জগদীশ গুপ্তের কাছে মিথ্যা, এ বিশ্বের পরিচালক যদি কেউ থাকে সে নির্মম, নিষ্ঠুর শয়তান। জগদীশচন্দ্র সর্বত্রই দেখেছেন শয়তানি ক্রিয়াকলাপ এবং বিভিন্ন গল্পে শয়তানির রূপ উন্মোচন করেছেন। আলোচ্য 'প্রয়োমুখম' গল্পটিতেও জগদীশচন্দ্রের এই উপলব্ধিই প্রকাশিত হয়েছে।


জগদীশচন্দ্রের এই নেতিমূলক মনোভাব তাঁর গল্পগুলিকে আবৃত করে থাকলেও চরিত্রসৃষ্টিতে, সংযত ও অব্যর্থ সংলাপ রচনায় এবং ঘটনা বিন্যাসের কৌশলে তার গল্পগুলি রসোত্তীর্ণ ছোটগল্পে পরিণত হয়েছে। ‘পয়োমুখম' গল্পটিও তেমনি একটি রসোত্তীর্ণ গল্প।


কৃয়কান্ত তাঁর পরিবার নিয়ে যে জীবন যাপন করেন তা অত্যন্ত বাস্তব এবং স্বাভাবিক। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত এই স্বাভাবিক সরল পারিবারিক পরিবেশেও কৃষ্ণকান্তের মত এক ভয়ঙ্কর চরিত্রকে আবিষ্কার করেন যা স্বাভাবিক জীবনের অন্তরালবর্তী জটিলতাকে পাঠকের কাছে উদ্ঘাটিত করে দেয়।


প্রথম পুত্রবধূকে হত্যার পর কৃষ্ণকান্ত যখন পুত্রের আবার বিবাহ দিলেন তখন বলেন, স্বয়ং শিব ও দুবার বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় পুত্রবধূরও জ্বর থেকে সেরে উঠে অন্নপথ্য করার পর ভেদবমি করে জীবনাবসান হল। কৃষ্ণকান্ত প্রথম জনের মৃত্যুতে প্রচার করেছিলেন বৈশাখের কাঁচা আম খেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে, দ্বিতীয় জন রোগের ওপর জিদ বশে গুরুপাক দ্রব্য উদরস্থ করে। তিনি প্রতিবেশীদের সামনে শোকের ভান করলেন। ভূতনাথ আবার বিবাহ করতে না চাওয়ায় কৃষ্ণকান্ত তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবার জন্য ধিক্কার, ভর্ৎসনা, অভিযোগ, অনুযোগ, এমন কি অনুনয়ের বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর অভ্রান্ত তাড়নায় ভূতনাথ মরিয়া হয়ে আত্মসমর্পণ করল। পণ ও পাত্রী ঠিকই ছিল। এবার কন্যার বর্ণ কালো বলে পণ পাওয়া গেল আটশত টাকা। কৃষ্ণকান্তের অনুপস্থিতিকালে বীণাপাণির পিতার কাছ থেকে মণি-অর্ডারে টাকা আসায় ভূতনাথের কাছে কৃষ্ণকান্তের সমস্ত দুষ্কর্ম ফাঁস হয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী বীণাপাণি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল।


আলোচ্য গল্পে লেখক যে পারিবারিক কাঠামোটি উপস্থিত করেছেন এবং পরিবারের গৃহিণী মাতঙ্গিনীর সহজ স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণতার প্রকাশ দেখিয়েছেন তাতে মধ্যবিত্ত বাঙালী সুখী পরিবারের সহজ সানন্দ জীবনের অন্তরালে যে অনেক জটিলতা থাকে, বাইরের পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেখে যে সবকিছু বিচার করা যায় না, এই সত্যের প্রতিই যেন জগদীশ গুপ্ত ইঙ্গিত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে যাকে কত্তর্ব্যপরায়ণ পিতা, দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন গৃহকর্তা এবং পরিবারের প্রতি স্নেহপরায়ণ ব্যক্তি মানুষ বলে মনে হয়, তারই অন্তরে হয়ত লুকিয়ে থাকে এক শয়তান, লোভের দ্বারা তাড়িত ক্রুর ও নিষ্ঠুর হত্যাকারী— ‘পয়োমুখম' গল্পপাঠে পাঠকের এই উপলব্ধিই হয়।