'একরাত্রি' গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

নামকরণ বা নামরূপের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে সুচিহ্নিত করার অভ্যাস মানুষের সুচির অভ্যাস। জন্মলগ্ন থেকেই নামকরণের দ্বারা নবজাতককে সবিশেষ ও বিশিষ্ট করা হয়, তার ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে পিতামাতার মনে নবজাতকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা কল্পনার আদলও ধরা পড়ে। বাবা মা আশা করেন নামীর জীবনে নাম সার্থক হোক। ব্যক্তিজীবনে অবশ্য সে নাম সার্থক হতেও পারে, নাও পারে। অবস্থার প্রতিকূলতায় সুবোধ হয়ে যায় অবোধ বালক। কানা ছেলের নাম হয় পদ্মলোচন। শরৎচন্দ্রের কথায় নাম চিরকাল নামীকে ভেঙচিয়ে চলতে থাকে।


কিন্তু এতো ব্যক্তিজীবনের কথা। নামকরণ যখন হয় তখন ‘নামী' সেই মানুষটির সমগ্র জীবন ও জীবন পরিণতি বাবা মায়ের কাছ থাকে অ-দৃষ্ট। ফলে ব্যক্তিজীবনে নামকরণ সার্থক হলে লোকে খুশি হয়, অসার্থক হলেও বলবার কিছু থাকে না। আর সেক্ষেত্রে নায় নিয়েও কেউ মাথা ঘামায় না। গোলাপকে যে নামেই ডাকা যাক, গোলাপ গোলাপই থাকে।


যে-কোনো নামেই ডাকা যাক, তার রূপ-রস-গন্ধের কোন হেরফের হয় না, এ-কথা ঠিক। এ-কথা ঠিক কোন ব্যক্তি বা বস্তুর নামের নামকরণের ক্ষেত্রেও। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ-কথা ঠিক নয়। সে ক্ষেত্রে সার্থকতা, অসার্থকতার প্রশ্ন ওঠে। বক্তব্য বিষয়ের একটা ইঙ্গিত নামকরণের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে এবং যেহেতু সাহিত্যিক -তাঁর রচনা শেষ করবার পরই রচনার নামকরণ করেন সেহেতু এই নামকরণের মধ্য দিয়ে রচনার বিষয়গত বা ভাবগত সার্থকতা অসার্থকতার প্রশ্ন এসেই যায়।


রচনা, তা প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, নাটক যে কোন রচনায়ই হোক, সর্বক্ষেত্রেই রচনার নামকরণ হয় বক্তব্য বিষয়ের অর্থবোধক। সে অর্থ কোথাও জড়িয়ে থাকে বিষয়কে কেন্দ্র করে, তখন নাম হয় বিষয়কেন্দ্রিক। কখনো বা জড়িয়ে থাকে কোন চরিত্রকে কেন্দ্র করে তখন নাম হয় চরিত্রকেন্দ্রিক। আবার কখনো লেখকের মনের বিশেষ কোন ভাবকে কেন্দ্র করে নামকরণ ঘটে। এক্ষেত্রে ভাবের পরিচয়বাহী নামকরণ কখনো কখনো ইঙ্গিতবাহী ও সংকেতধর্মী হয়ে ওঠে।


রবীন্দ্রনাথের 'একরাত্রি' গল্পে কোনো চরিত্র বা বিষয় প্রধান হয়ে ওঠেনি। এখানে একটি রাত্রির পরম অভিজ্ঞতা বা অনুভবকে তুলে ধরাই যদিও গল্পটির উদ্দেশ্য, এবং সেই উদ্দেশ্যের কথা মনে রেখেই প্রথমদিকে আখ্যানধর্মী কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল, তবু গল্পটি বিষয়কেন্দ্রিক নয়। কোনো সামাজিক বা সাংসারিক সত্যকে এখানে উপস্থাপিত করা হয় নি। করা হয় নি কোনো তত্ত্বকথাকেও। গল্পটি ভাবকেন্দ্রিক। সমস্ত ব্যবহারিক ও লৌকিক অর্থ-তাৎপর্যকে ছাড়িয়ে গল্পটি বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং অনুভূতির এক সৌন্দর্যলোকে পাঠকমনকে পৌঁছে দিয়েছে। “একটি শান্ত ত্যাগে, জীবনের ‘পরম-লগন'কে লাভ করবার রোমান্টিক তৃপ্তিতে অপরূপ সুর-ঝঙ্কার এতে বেজে উঠেছে। লৌকিক প্রয়োজনের কোনো চরিতার্থতা এতে নেই—এর মধ্যে বাঁশির সুরের আনন্দময় মুক্তি। সুতরাং আমরা বলতে পারি—গল্পটি কাব্যধর্মী।”


জীবনের পরম-মুহূর্তটিকে উপস্থাপন করতে গিয়ে গল্পকথার প্রয়োজনে কিছু কিছু ঘটনার বিন্যাস এখানে থাকলেও ঘটনার পরিণামে গল্পটি শেষ হয়নি। শেষ হয়েছে নায়ক মনের অনুপম এক ভাবকে আশ্রয় করে। এক পরম মুহূর্তের পরম প্রাপ্তিই সমস্ত গল্পটিকে পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছে। আর নায়কমনে সেই পরম মুহূর্তটি এসেছে বিশেষ একরাত্রির এক বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে। নায়কের কথায়, “আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে, কেবল হাত-পাঁচছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম। তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে.....কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম, পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল।.....এখন কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃত্তটুকু হইতে খসিয়া আমরা দু'জনে এক হইয়া যাই। সে ঢেউ না আসুক।...আমি এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।”


এখানে গল্পটির মহামুহূর্ত। এরপর রাত্রি শেষ হয়ে এল। ঝড় থেমে গেল। জল নেমে গেল। সুরবালাও কোন কথা না বলে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু ঐ একরাত্রির মাত্র কয়েকটি ক্ষণ নিয়ে তার উপস্থিতি নায়কের মনের তন্ত্রীতে যে সুর জাগিয়ে গেল, সেই খণ্ডকালের সুরের মধ্যেই লাগল অখণ্ডের স্পর্শ। সেই একরাত্রির পরম অনুভব নায়কের জীবনের সমস্ত দিন ও রাত্রির সামান্যতাকে অসামান্য তাৎপর্যে মণ্ডিত করে তুলল। নায়কের কথায়, “আমার সমস্ত ইহ জীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল—আমার সমস্ত পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”


গল্পটি কবির 'মানসী-সোনার তরী' পর্বে লিখিত। এই পর্বে কবি দেহগত প্রেমবাসনা থেকে বিরহের স্বর্গলোকে অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে প্রিয়ার সঙ্গে ভাবসম্মিলনকেই কাম্য বলে মনে করেছেন। কবির মনে হয়েছে মিলন ও বিরহের মধ্যে বিরহই বড়ো। মিলনে যা এক জায়গায় বাঁধা পড়ে, বিরহে তাই বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে যায়।


ধূপ দগ্ধ হয়ে গেলে 'গন্ধ বাষ্প তার/পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারিধার।' ‘একরাত্রি' গল্পের বক্তব্যে নায়ক তেমনি বিরহের স্বর্গলোকে গিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছে। নায়িকাকে 'পরশ বন্ধনে' পাবার কামনা এখানে নায়কের মনকে উদ্দীপিত করে নি। দেহ-প্রেমের খন্ড-ক্ষুদ্রতা বিলীন হয়েছে মানসলোকের ভাবসম্মিলনে। দেহ-প্রেমের বাসনাবিহীন ক্ষণমিলন হয়ে উঠেছে চিরমিলনের মহিমায় ভাস্বর। এখানে কোথাও মৃত্যু কোথাও বিচ্ছেদ নেই। নায়ক মনের এই পরম উপলব্ধিতেই তার মনের অশান্তি, অতৃপ্তি, সমস্ত ক্ষোভের অবসান হয়েছে। তাই মহাপ্রলয়ের শেষে, রাত্রির অবসানে নবসূর্য উদয়ের প্রাক্ষণে ঐ পুকুরের পাড় থেকে কোন কথা না বলে নায়ক যখন ঘরে ফিরল তখন এক সম্পাদিত প্রশান্তিতে, পরম পাওয়ার আনন্দে তার মন ভরে উঠেছে। আর এই প্রশান্তি, এই দুর্লভ অনুভব তার মনে এনে দিয়েছে ঐ একরাত্রির ঘটনা। তাই অধ্যাপক সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “একরাত্রি ছাড়া এ গল্পের নামান্তর কল্পনাই করা চলে না-only one night but the eternal night." সবরাত্রি নয়, বিশেষ একরাত্রির এক বিশেষ অনুভবই এই গল্পের প্রাণ-ভ্রমরা। গল্পের এই ইংগিতময়, ভাবাত্মক নামকরণ সার্থক।