অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উপন্যাসের নামকরণ তার বিষয়বস্তুকে দ্যোতিত করে। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু বা লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী বা চরিত্রের তাৎপর্য নামকরণের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয়। উপন্যাসিকের জীবনীবীক্ষা ও মানসদৃষ্টি প্রণিধান করতে গেলে নামকরণের তাৎপর্যকে বুঝতে সচেষ্ট হতে হয়।


মহাশ্বেতা দেবী দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী স্রষ্টা। তিনি চান মানুষের সমাজে পরিবর্তন আসুক। এই পরিবর্তনের ফলে শেষ হোক অসাম্য-অশান্তি, দুঃখ-কষ্ট ও যাবতীয় অত্যাচার অনাচার। ইতিহাস চেতনা বা অর্থনৈতিক সমাজনৈতিক চেতনা তাঁর উপন্যাসের গতি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করে। তিনি লিখেছেন, “আমি বিশ্বাস করি ইতিহাস চেতনা।” এই ইতিহাস চেতনা থেকেই জন্ম হয় অর্থনৈতিক ও সামাজনৈতিক চেতনা। “বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায়দায়িত্ব বহনে আমরা সর্বদাই অঙ্গীকারবদ্ধ।"—এই প্রতিশ্রুতি উপন্যাসের দিগদর্শন হয়ে উঠেছে।


মুণ্ডা বিদ্রোহের ইতিহাস এদেশের প্রান্তিক সমাজের এক অভূতপূর্ব শোষণ-নিপীড়নের ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদী শাসক, তাদের পোষ্য জমিদার শ্রেণী ও মহাজন সম্প্রদায়ের সহায়তায় দরিদ্র, নিঃস্ব, অন্নহীন মুণ্ডাদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়ে গেছে তার তুলনা কোথায়? অরণ্য মুণ্ডাদের প্রাণ। অরণ্যভূমিই কৃষ্ণ ভারতের আদিবাসীর কাছে জননী। সেই অরণ্যের অধিকার ব্রিটিশ সরকার কেড়ে নেয়। “জঙ্গল আইন” জারি করে জঙ্গল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে– “ঢোল দিয়া দিয়াছে সকল গ্রামে, সকল খাস জমি জঙ্গলের আপিস নিয়ে নিল। জঙ্গলে আমরা লাখো লাখো চাঁদ ধরে গাই ছাগল চরিয়েছি, জঙ্গল হতে কাঠ আনছি। এখন হতে কেউ গাই ছাগল চরাতে পারবে না জঙ্গলে। জঙ্গল হতে কাঠ, পাতা, মধু আনতে পারবে না। শিকার খেলতে পারবে না। জঙ্গলের ভিতর যত গ্রাম আছে, সব উচ্ছেদ করে দিল।" এই অধিকার হারানোর ট্র্যাজেডিই মুণ্ডা আদিবাসী জীবনের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি। বীরসা বলেছিল ““না'। ও বলে নি। ওর রক্ত ওকে দিয়ে কথাটা বলিয়েছিল। ও বলে নি, সমস্ত কৃষ্ণ ভারত আর সকল কালো মানুষ ওকে দিয়ে কথাটা বলিয়েছিল।”— এই ভাবেই উপন্যাসের নামকরণের বীজ ভূমিটি বোঝা যায়।


বীরসা মুণ্ডা মুণ্ডাদের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা। ব্রিটিশ শাসক শক্তি ও অন্যান্য শোষণ যন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অনিঃশেষ 'উলগুলান' এই অধিকার উদ্ধার করার জন্যই নিয়োজিত হয়েছিল। ১৯০০ সালের মুন্ডাদের এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম আসলে এদেশের জনবৃত্তের সামগ্রিক ইতিহাস ও বিদ্রোহ-কাহিনী। সাঁওতাল, ওঁরাও, হো প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে বীরসা মুণ্ডা পরম পূজা বীর—'ধরতি-আবা'। স্বাধীন ভারতের নিম্নবর্গের মানুষের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একাত্ম হয়ে লেখিকা এই উপন্যাস লিখেছেন। বীরসা এই উপন্যাসের মধ্যমণি।' বীরসা সম্পর্কে মহাশ্বেতা ১৯৮৬ সালে লিখেছিলেন- "বিরসা ভগবান, ধরতি আবা। কালো কালো আদিবাসীদের পরম প্রিয়। বীরসার উলগুলান যখন হয়নি সেদিন বিরসার সন্তান মুণ্ডারা আজ পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যে ব্যাপ্ত হয়ে গেছে। তবু তাদের প্রাণের মানুষ ধরতি আবা।” এই বীরসা কেন্দ্রিক উপন্যাস 'অরণ্যের অধিকার।'


বীরসা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে অরণ্য জননীকে ভালোবেসেছে। “অন্তরে অন্তরে ও অরণ্য জননীর কান্না শুনতে পাচ্ছিল, শুদ্ধ শুচি হব আমি। অন্তরে অন্তরে ওর রক্তের নদীকূলে ও সেই জননীকে দেখতে পাচ্ছিল।” অরণ্যজননীকে সে নিজের সত্তার সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছিল। 'দিকু'দের অত্যাচারে অরণ্যদেবীর সম্ভ্রম বিনষ্ট হয়েছে। সেই সম্ভ্রমকে উদ্ধার করার জন্য বীরসার 'উলগুলান'। তাই লেখিকা লিখেছেন— “উলগুলানের আগুনে জঙ্গল জ্বলে না, মানুষের হৃদয় আর রক্ত জ্বলে। সে আগুনে জঙ্গল জ্বলে না। জঙ্গলে নতুন করে মুণ্ডা মায়ের মত, বীরসার মায়ের মত, জঙ্গলের সন্তানদের কোলে নিয়ে বসে।”


ধানী মুণ্ডা জানে যে জমির অধিকার, জঙ্গলের অধিকার জন্ম সূত্রে মুণ্ডারা পেয়েছিল, তা থেকে উৎখাত হয়ে মুণ্ডারা সর্বহারা হয়ে গেল। অরণ্য কাঁদছে। সেই কান্না বীরসাকেও কাঁদিয়েছে— "হা জঙ্গল। তুমি বল না কেনে। তোমার দয়া কেড়ে নেবার হক কারো নেই। বীরসা বুঝতে পারছিল ওর অরণ্য জননী কাঁদছে। অরণ্য ধর্ষিতা। দিকুদের হাতে, আইনের হাতে বন্দিনী। জননী অরণ্য বলেছিল, মোরে বাঁচা বীরসা। আমি শুদ্ধ শুচি নিষ্কলঙ্ক হব।”


অরণ্য জননীর কান্নার অগ্নিহানে বীরসার প্রতিজ্ঞা। কাহিনীর কেন্দ্রীয় বিষয় অরণ্যের অধিকার উদ্ধার। তাই অরণ্যের অধিকারই উপন্যাসের 'Central motif'। মুণ্ডারা এই অধিকার রক্ষার আন্দোলনের জন্য 'উলগুলান' করেছে। দলে দলে মুন্ডা পুরুষ ও নারী ছুটে এসেছে বীরসার আহ্বানে। এই অধিকার রক্ষার জন্য তারা 'ভগবান'কে ডাক দিয়েছে। 'ভগবান' যেমন তাদের ডাক দিয়েছে। এই আহ্বান 'অরণ্যের অধিকার’ উদ্ধারের আহ্বান। কাহিনীর দিক থেকে এই মূল ভর কেন্দ্রকে ঘিরে যেমন নানা চরিত্রের ওঠাপড়া তেমনি চরিত্র সৃষ্টির আলোকে যা সত্য হয়ে দেখা যায় তা একান্তই ভাবনিষ্ট। বীরসার প্রতিজ্ঞা—“আমি মুন্ডাদের ছেলে ভুলাব না, কোলে দুলাব না। আমি সকলের জন্য এই জঙ্গল মাটি জিনে এনে দেব।”


বীরসার পাশে সমান্তরালভাবে আছে ধানী মুণ্ডার স্বপ্ন ও সংগ্রাম। সে ‘লড়াই খেপা'। সে ত্রিকালদর্শী পুরুষ। তাই মুণ্ডাদের ইতিহাসে লড়াইয়ের পরম্পরাকে সে জানে। সে জানে এ লড়াই তাদের পুরুষ পরম্পরার লড়াই। সে মুণ্ডাদের নিপীড়িত নির্যাতিত অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য 'ভগবান'-এর আবির্ভাব কামনা করেছে। 'ভগবান' হয়ে 'বীরসা' এসেছে, তার এই ঘোষণা কেবল মৌখিক নয়, সে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বলয়া তৈরী করে সালীর ঝুড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বহুদর্শী, প্রবীণ এই সংগ্রামীর জীবন ও সংগ্রাম সবই 'অরণ্যের অধিকার' লাভের জন্য। 'অরণ্যের অধিকার ফিরে পেতে চায় মুণ্ডারা। এই অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মুণ্ডাদের প্রয়াসের শেষ নেই। তারা সীমাহীন কষ্টের ভেতর দিয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করে এই প্রাপ্তিকে সত্য করে তুলতে চায়। এই দিক থেকে বলা চলে 'অরণ্যের অধিকার' নামকরণটি সত্যই সার্থক।