'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি বিচার করো।

‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনে চরিত্রের সংখ্যা অল্প হলেও চরিত্রগুলি জটিল নয়। প্রধান পাত্র-পাত্রী কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিমাত্র তা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় না। এদের সংলাপের সার্থকতাও লক্ষণীয়। ভদ্র হিন্দুর সংলাপ মার্জিত চলিত, কলকাতা ও নিকটবর্তী অঞ্চলের কথ্য ভাষার মত। ভদ্রেতর চরিত্রে গ্রাম্যতার প্রভাব আছে বলে প্রকাশ ক্ষমতা বেড়েছে। বিশেষ করে হানিফ ও ফতেমার ভাষায় গ্রাম্য উচ্চারণের ভঙ্গী ও দু-একটি ফার্সী শব্দের ব্যবহারযোগ স্বাভাবিক। এ প্রহসনের প্রায় প্রতিটি চরিত্রের ভাষায় ও ব্যবহারে তার ব্যক্তি পরিচয় প্রকাশিত।


ভক্তপ্ৰসাদ এই প্রহসনের প্রধান চরিত্র। তাঁর চিন্তাধারা এবং আচরণই এখানে ব্যঙ্গের বিষয়রূপে গৃহীত হয়েছে। ভক্তপ্রসাদকে আশ্রয় করে প্রহসনটি শুধু ব্যক্তিগত চরিত্রহীনতার কথাই বলে নি একটা যুগের সমাজ বাস্তবতার উপাদানও দিয়েছে।


ভক্তপ্রসাদ চরিত্রটি যেন একটি সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদ গ্রামীণ জমিদার। তাঁর চরিত্রের দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যগোচর– নারীলোলুপতা এবং তার জন্য যথেচ্ছ অর্থ ব্যয় এবং প্রজাশোষণ, অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রজাদের নিপীড়ন এবং শত অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও প্রয়োজনে কাউকে কোনো সাহায্য না করা। দুটি বৈশিষ্ট্যই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং এখানেই তার ব্যক্তি চরিত্রের মূল ভিত্তি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তার প্রজা হানিফ গাজী খরাজনিত আজন্মায় ফসল না হওয়ায় খাজনা মকুবের আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। অগত্যা এগার সিকে খাজনার পরিবর্তে তিন সিকে খাজনা দিতে চায়। ভক্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে হানিফ তখন গদাধরের সাহায্য চায়। গদাধর গোপনে ভক্তকে জানায় হানিফের উনিশ বছরের বিবির কথা। বিবিকে পাবার আশায় ভক্তপ্রসাদ হানিফের খাজনা মুকুব করে দেন। মধুসূদন আসলে ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের মাধ্যমে সমস্ত গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজকে ব্যঙ্গ করতে চাননি— ভক্তপ্রসাদ ভণ্ড ধর্মধ্বজীদের প্রতীক। এ প্রহসনের আর একজন ব্রাহ্মণ পঞ্চানন বাচস্পতি। ভক্তের ভণ্ডামির প্রতিফল যাঁর বুদ্ধিতে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ভক্তপ্রসাদ মুখে মুসলমানদের তীব্র ঘৃণা করলেও মুসলমানের নারীকে অপহরণ করে ভোগ করতে তাঁর দ্বিধা নেই। মুসলমানের খাদ্য গ্রহণে ঘৃণা আবার ফতেমাকে দেখার পর স্বধর্ম ত্যাগেও তাঁর আপত্তি নেই। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই ভক্তপ্রসাদ চরিত্রকে বাস্তব এবং প্রহসনের আদর্শ চরিত্র করে তুলেছে। ফতেমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রার পূর্বে ভক্তপ্রসাদের সাজসজ্জা তাঁর চরিত্রের ছদ্মবেশকে অনাবৃত করে দিয়েছে। সাজগোজের পর তাঁর স্বগতোক্তি “এই তাজটা মাথায় দেওয়া ভালই হয়েছে। নেড়ে মাগীরা এই সকল ভালবাসে; আর এতে এই একটা আরও উপকার হচ্ছে যে, টিকিটা ঢাকা পড়েছে।”


বাচস্পতি যে পদ্ধতিতে হানিফের সহায়তায় ভক্তের শাস্তিবিধান করেছে তা যথার্থ, স্বাভাবিক এবং স্থানোচিত ঔচিত্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভক্তপ্রসাদের কার্যকলাপ প্রহসনের বিষয়। সুতরাং তিনিই এই প্রহসনের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সমগ্র প্রহসনের গতি পরিণতি ভক্তপ্রসাদের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর অর্থশোষণ স্পৃহা, কৃপণতা এবং ইন্দ্রিয় চর্চায় অপব্যয় সবই অনুপুঙ্খভাবে চিত্রিত। ভক্তপ্রসাদের ধর্ম সম্পর্কে পরিচয়ও পাওয়া যায়— পুত্রের বন্ধু আনন্দের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে। নিজ পুত্রের সম্পর্কে খবরাখবর নিতে গিয়ে ভক্তপ্ৰসাদ আনন্দকে জিজ্ঞেস করেছেন—


......“ভাল, আমি, শুনেছি যে, কলকেতায় নাকি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে?....” আনন্দ প্রত্যুত্তরে জানায় যে “সে কথা সত্য।” ভক্তপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করেন,

“শুনেছি – কলকেতায় না কি বড় বড় হিন্দু সকল মুসলমান বাবুর্চী রাখে? আনন্দ। আজ্ঞে, কেউ কেউ শুনেছি রাখে বটে। 

ভক্ত। থু! থু! বল কি? হিন্দু হয়ে নেড়ের ভাত খায়? রাম! রাম! থু! থু!”


ভক্তপ্রসাদের মত ভণ্ড বকধার্মিকদের চরিত্র এই উক্তিতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। নেড়ের ভাত খেতে তাঁর আপত্তি নেড়ের নিকে করা স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে আপত্তি নেই। ভক্তপ্ৰসাদ আচারসর্বস্ব হিন্দুয়ানীর ভক্ত। চারিত্রিক সমুন্নতি বলতে তিনি বোঝেন আচার পালন। আনন্দকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর পুত্র কোনো অধর্মাচরণ করে কিনা! অধর্মাচরণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন ‘এই দেব ব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের প্রতি ঘৃণা, এই সকল খ্রীষ্টিয়ানি মত—' ভক্তের বকধার্মিক রূপটি অনাবৃত হয়েছে নিম্নোক্ত সংলাপে—  ‘আমার বোধ হয় অম্বিকাপ্রসাদ কখনই এমন কুকর্ম্মাচারী হবে না—সে আমার ছেলে কি না।'


ধনী জমিদার ভক্তপ্রসাদের কাজ হল জমিদারের স্বার্থ রক্ষা করা এবং শোষণ। দেশে অনাবৃষ্টিতে রায়ত মারা পড়লেও ভক্তপ্রসাদ আধপয়সা খাজনা রেহাই দিতে রাজী নয়। বাচস্পতির ব্রহ্মাত্র জমি দখল করে নিয়ে বাগানটি মাপসই করায় ভক্তপ্ৰসাদ দ্বিধাহীন। গ্রাম্য জমিদারদের শোষণের দিকটাই তার চরিত্রে ছিল, তাদের চরিত্রের বদান্যতা ভক্তপ্রসাদ চরিত্রে ছিল না। বাচস্পতির মাতৃশ্রাদ্ধে পাঁচ টাকার বেশি সে দিতে পারে নি।


গ্রাম্য জমিদারের লাম্পট্য ভক্তপ্রসাদের চরিত্রে এমন একটা স্তরে উঠেছিল যাতে কুমারী বালিকাকে চিরকালের জন্য বারাঙ্গনা-পল্লীর অধিবাসী করতে তার দ্বিধা হয় নি। মুসলমান কৃষকবধূ ফতেমা কিংবা হিন্দুঘরের কিশোরী পঞ্চীকে ভোগ করার বাসনায় সে উম্মাদ হয়ে ওঠে। এই উদ্দেশ্যে সহজকৃপণ জমিদার অর্থব্যয়ে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।


ভক্তপ্রসাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমালোচক ক্ষেত্র গুপ্ত তাঁর ‘নাট্যকার মধুসূদন' গ্রন্থে বলেছেন— “ভক্তপ্রসাদ নব্য ইংরেজী শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তার বিস্তারে আতঙ্ক অনুভব করে। পুরাতন সব কিছুকে সনাতন হিন্দুধর্মের অবশ্য রক্ষণীয় আচরণ বলে তার বিশ্বাস। দেব ব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের প্রতি ঘৃণা খৃষ্টিয়ানি মত প্রভৃতিকে অধর্ম্মচরণ বলে মনে করে। জাতিভেদ প্রথা অবশ্য রক্ষণীয়। কলির প্রতাপে সব-কিছু যেতে বসেছে দেখে তার আক্ষেপের শেষ নেই। পুত্রের উচ্চ শিক্ষালাভ বরং বন্ধ থাক, কিন্তু সনাতন হিন্দুধর্মের সংস্কার থেকে ভ্রষ্ট হওয়া চলবে না।


ভক্তপ্রসাদের এই শ্রেণী চরিত্রের সঙ্গে কতকগুলি ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে। নারীদেহ লোলুপতাকে তার চরিত্রে কেন্দ্রীয় প্রত্যয়রূপে দাঁড় করিয়েছেন নাট্যকার। বার্ধক্য এই লোলুপতাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। সুন্দরী তরুণীর কথা শুনলেই যেন নখদন্তহীন এই বৃদ্ধ ব্যাঘ্রের লালা ঝরতে থাকত”।


ভক্তপ্রসাদের নারীদেহ-লোলুপতা নাট্যকার গদাধর ও ভক্তর কথোপকথনে সুন্দরভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—“গদা। মশায়, তার রূপের কথা আর কি বলবো? বয়েস বছর উনিশ, এখনও ছেলেপিলে হয় নি, আর রঙ যেন কাঁচা সোনা। ভক্ত। (মালা শীঘ্র জপিতে জপিতে) অ্যা, অ্যা বলিস্ কিরে?” ফতেমা মুসলমান হওয়ায় প্রথমে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্বের ভাব তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানীকে বশ করার জন্য মাথায় তাজ পরতে, আতর মাখতে সে তৎপরতা দেখিয়েছে। এমন কি ধর্মত্যাগের কথাও সে একবার বলেছে।


ভক্তপ্রসাদের ভোগ শুধু দেহের নয়, চোখেরও তা পঞ্চীর সংলাপে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—“ও মা! এ বুড়ো মিন্‌সে তো কম নয় গো। এ কি আমাকে খেয়ে ফেলতে চায় না কি? ও মা, ছি! ও কি গো? এ যে কেবল আমার বুকের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে? মর্?” পঞ্চীকে দেখে ভক্তপ্ৰসাদ আবৃত্তি করে উঠেছে—

“মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া। 

অদ্যাপি কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া ৷৷

কুচ হৈতে কত উচ্চ মেরু চূড়া ধরে। 

শিহরে কদম্ব ফুল দাড়িম্ব বিদরে।।”


ফতেমাকে লক্ষ্য করে ভক্তপ্রসাদ টপ্পা গেয়েছে—

“তুমি প্রাণ, তুমি ধন, তুমি মন, তুমি জন, 

নিকটে যে ক্ষণ থাক সেই ক্ষণ ভাল লো।

যত জন আর আছে, তুচ্ছ করি তোমা কাছে,

ত্রিভুবনে তুমি ভাল আর সব কাল লো।”


ভক্তপ্রসাদের কবিত্বের ঘোর তার গদ্যসংলাপেও রূপায়িত “বিধুমুখী তোমার বদনচন্দ্র দেখে আজ আমার মনকুমুদ প্রফুল্ল হোলো।" তার লাম্পট্যবৃত্তির সঙ্গে কিঞ্চিৎ কাব্যরসের যোগ ঘটানোর ফলে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে উপমায় কিছু নকল বীররসের সঞ্চার হওয়ায় চরিত্রটি হাস্যকর প্রকাশ হয়ে উঠেছে। যেমন – (এক) “এমন কনকপদ্মটি তুলতে পাল্‌লেম না হে। সসাগরা পৃথিবী জয় করে পার্থ কি অবশেষে প্রমীলার হস্তে পরাভূত হলেন?” (দুই) ‘ধনঞ্জয় অষ্টাদশ দিনে একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা সমরে বধ করেন, আমি কি আর এক মাসে একটা তেলীর মেয়েকে বশ করতে পারব না?"


‘ভক্তপ্রসাদের সংলাপে চরম অসৎ কর্মের সময় হরিবোল ধ্বনি,' যেন ‘ভাবের অন্তরে সর্বনাশসাধনের বাসনা, সাদা ভাষার সঙ্গে আলাপকারিকতা এবং কদর্য মনোভাবজাত কবিত্বের সুর আকর্ষণীয় বিশিষ্টতা সৃষ্টি করেছে।'


“নাট্যসমাপ্তিতে তার চরিত্রের পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তা আদৌ সম্ভব কিনা এরূপ প্রশ্ন মনে জাগতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনটি আসল কথা নয়, ভক্তপ্রসাদের ভণ্ডামি নষ্টামির মুখোশ আজ খুলে গিয়েছে, দিনের আলোয় সে ভীতিবিহ্বল এটাই বড় কথা।”—[নাট্যকার মধুসূদন—ক্ষেত্র গুপ্ত।]


প্রাক-মধুসূদন বাংলা নাটক বা প্রহসনে এই জাতীয় চরিত্র যেন দুর্লভ। অবশ্য এই জাতীয় চরিত্র সৃষ্টির দ্বারা মধুসূদন যে গুরুতর সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, এমন নয়, হাস্যে-পরিহাসে পরনারীলোলুপ ভণ্ড ধর্মধ্বজী ভক্তপ্রসাদের চরিত্র অংকনই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।