‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনে হানিফ গাজী চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

আলোচ্য প্রহসনটির নায়ক জমিদার ভক্তপ্রসাদকে অবলম্বন করে নাট্যকার আরও কয়েকটি জীবন্ত চরিত্র এখানে অঙ্কন করেছেন। ভবিষ্যতের অনেক নাট্যকার এই সমস্ত চরিত্র থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এদের মধ্যে হানিফ একটি নিখুঁত চরিত্র। সে গ্রাম্য চাষা, অর্ধভুক্ত অবস্থায় তার দিন কাটে। মাথা উঁচু করবার অবকাশ না পেলেও তাদের মা রোন আছে; তাদেরও যে ইজ্জত আছে তা তারা ভুলতে পারে না। গ্রাম্য গোঁয়ার চরিত্র হওয়ার ফলে হানিফ নাটকে বেশ জীবন্ত চরিত্র।


হানিফ গরীব চাষী, তার ভয় খাজনার দায়ে তার ভিটেটাই না ত্যাগ করতে হয়। হানিফ বুদ্ধি করে আট সিকে কাছায় বেধে রেখেছিল। ভক্তবাবু বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে হয়ত টাকাটা দিত। তবে কৌশলে না দিতে পারায় সে খুশী। অন্যদিকে হানিফ নিজের বাস্তব বুদ্ধিবলে জমিদারকে নাজেহাল করে।


হানিফের পরামর্শ মতই তার বৌ ফতিমা পুঁটির কথায় রাজি হয়। হানিফ গরীব হওয়ায় টাকার লোভ সে সহজে ছাড়তে পারে না।


ঘটনাস্থল ভাঙ্গা শিবমন্দিরে এসে একটা শক্তিমত্ত উদ্দাম পৌরুষ স্ত্রীর সম্ভাব্য অসম্মানে যেন গর্জন করে উঠেছে। 'বাচস্পতি যতক্ষণ না ইশারা করি, ততক্ষণ তাকে চুপ করে বসে থাকতে বলায় সে বলেছে,- “লেকিন আমার সামনে যদি আমার বিবির গায়ে হাত দেয়, কি কোন রকম বেইজ্জৎ কত্যি যায়, তা হলি তো আমি তখনই সে হারামজাদা বেটার মাথাটা টান্যে ছিঁড়ে ফেলবো।”


তার কথায় যথার্থই ভয় বাচস্পতি বলে - “বেটা একে সাক্ষাৎ যমদূত, তাতে আবার রেগেছে। না জানি, আজ একটা কি বিভ্রাটই বা ঘটায়।”


দেখা যাচ্ছে হানিফ রেগে গিয়ে যে একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে, এ ভয় আছে বাচস্পতির।


অবশ্য হানিফ যতটা গর্জন করেছে ততটা কার্যে প্রকাশ পায়নি। তাকে খানিকটা সামলায় বাচস্পতি। ভূত হয়ে সে গদাধরকে চড় মারে। পুঁটিকে লাথি মারে আর ভক্তর পিঠে বসে ঘুষি মারে। এইভাবেই সে তার মনের জ্বালা জুড়ায়।


হানিফ সবশেষে আবার রসিকতা করতেও ছাড়ে না। ভক্তকে সে বলেছে - “সে কি, কত্তাবাবু? – আপনি যে নাড়্যেদের এত গাল্ পাড়তেন, এখনে আপনি খোদ্ সেই নাড়ে হতি বসেছেন, এর চায়ে খুসীর কথা আর কি হতি পারে? তা এ কথা তো আমার জাত কুটুমগো কতিই হবে।”


হানিফ এ প্রহসনের অতি সজীব চরিত্র। তার ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে ঘটেছে, তাতে গ্রাম্য সরল চাষীরূপে সে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বস্তুত হানিফের মতো চরিত্রের জন্যই এই প্রহসন এত সার্থক। এই প্রহসনে ভক্তপ্ৰসাদ যদি প্রধান চরিত্র হয়, তবে হানিফ হল তার যথার্থ প্রতিনায়ক। হানিফের কার্যকলাপ এ নাটকের কাহিনীকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যায় তাই নয়, তাকে সার্থক পরিণতিও দান করে।


হানিফ-গাজী চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য নির্ণয় প্রসঙ্গে ক্ষেত্র গুপ্ত তাঁর ‘নাট্যকার মধুসূদন’ গ্রন্থে বলেছেন—“হানিফ-গাজীর মধ্যে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি এবং এই শক্তিজাত অস্থৈর্য তথা বাস্তব কৌশলের বোধ—এ দুই প্রবৃত্তি মিলেছে। তাকে সোজা সাদা স্বল্প বুদ্ধি ভাল মানুষ করে মধুসূদন সৃষ্টি করেন নি। তার গায়ে যমদূতের মত জোর যেমন আছে, উপস্থিত বুদ্ধিরও বড় অভাব নেই। জমিদারের প্রাপ্ত খাজনার কিছু অংশ যে কোঁচড়ে লুকিয়ে দারিদ্র্য নিয়ে মায়াকান্না কেঁদেছে এবং কায়দায় ফেলে ভক্তপ্রসাদের কাছ থেকে মোটা রকম আদায়ের ফন্দীও সে এঁটেছে। আর সেই ফন্দীতে তার স্ত্রী ফতেমাকেই টোপরূপে ফেলতে হয়েছে। ভক্তপ্রসাদ ধরা পড়ে যাবার পরে তার ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করায় হানিফের এই ফন্দীবাজ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু মধুসূদনের মানবচিত্তের গভীরতম প্রান্ত পর্যন্ত উপলব্ধি করার মত চোখ ছিল। ফতেমার অপমান হানিফের নিজের পৌরুষের অপমান”।


হানিফ গাজীর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য নির্ণয় কালে সমালোচক অশোককুমার মিশ্র তাঁর ‘বাংলা প্রহসনের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন- “হানিফ গাজীর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য তার অসাধারণ সাহস ও গোঁয়ার্তুমি। মুসলমান কৃষক সমাজের প্রতিনিধি সে। তার ক্রোধ প্রকাশ, তার হঠকারী পদক্ষেপ যেন 'নীলদর্পণে'র তোরাপের আবির্ভাব লগ্ন ঘোষণা করেছে। বাচস্পতি তার ভাল চায় একথা বুঝতে পেরে সে তার কথা মত চলেছে। পঞ্চানন ও হানিফ গাজীর মিলনে অত্যাচারী লম্পট ভূস্বামীকে শায়েস্তা করার মাধ্যমে বাংলা নাটকে প্রথম সংঘ শক্তির বিজয় ঘোষিত হয়েছে। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে স্বাভাবিক গ্রাম্য চরিত্রকে এভাবে ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যে স্থান দেওয়া হয় নি।”


নাট্যকারের অধিকতর কৃতিত্ব হানিফের মুখের সংলাপ সৃষ্টিতে। আরবি-ফার্সি মিশ্রিত হানিফের জবান তার পৌরুষের অভিব্যক্তিতে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। গোপনে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছে ভক্তপ্রসাদকে জব্দ করার; সেখানে তার ক্রোধ আর আক্রোশ যেন প্রতিটি শব্দের মধ্যে প্রতিফলিত। পুঁটিকে উপলক্ষ্য করে সে বলেছে– “হারামজাদীর মাথাটা ভাঙ্গি, তা হল্যি গা জুড়ায়। হা আল্লা, এ কাফের শালা কি মুসলমানের ইজ্জত মাত্তি চায়?” কিছুদিন পরে হানিফের আদর্শে দীনবন্ধু তোরাপের চরিত্রটি সৃষ্ট করেন এবং তোরাপের মুখে সংলাপ বলিয়ে তোরাপকে অমর করে রেখেছেন। হানিফ চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকারের কুশলতা স্মরণীয়।