'একেই কি বলে সভ্যতা?' প্রহসনরূপে কতখানি সার্থক আলোচনা করো | ‘একেই কি বলে সভ্যতার প্রকৃতি বিচার করো।

পাশ্চাত্য সাহিত্যে কৃতবিদ্য মধুসূদন পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শের কথা মনে রেখে দুটি প্রহসন রচনা করেছিলেন এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, এই রচনাদুটিকে তিনি নিজেই তাঁর চিঠিপত্রে ফার্স রূপে চিহ্নিত করেছেন। পাশ্চাত্য নাট্যশাস্ত্রে ফার্সকে বলা হয়েছে, Non musical drama বা সঙ্গীতবিহীন নাটক। ফার্স নাটকেরই একটি শাখা, তবে এখানে ফার্স ও কমেডির মধ্যে পার্থক্য আছে। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে ফার্সের সঙ্গে কমেডির অভিন্নতা ঘটে যায়। কেউ কেউ ফার্সকে অতিরঞ্জিত কমেডি বলেছেন। ফার্সের সমস্যা হল অবাস্তব, উদ্ভট, ক্রিয়াকলাপ হাস্যকর এবং উদ্দেশ্য পরিহাসজনক। কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে উদ্ভূত বহিরঙ্গগত কার্যকলাপের দ্বারা মঞ্চে কৌতুক সৃষ্টি করাই ফার্সের কাজ। অন্যদিকে কমেডি নির্ভর করে চরিত্রের বিশ্লেষণ ও চরিত্রগুলির বুদ্ধিমত্তার মাত্রার উপর। কমেডির আবেদন শ্রুতিগত এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য; ফার্সের আবেদন প্রত্যক্ষগত এবং হাস্যরসাত্মক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রহসন শেষ পর্যন্ত সুখান্ত পরিণামী হয় এবং তখন সে আর শুধুমাত্র প্রহসন বা ফার্সে থাকে না, তখন সে হয়ে যায় মিলনাত্মক বা সুখান্ত পরিণামী প্রহসন। ফার্সে ঘটনাবস্তু অনেক সময় মেলোড্রামারও বিষয় হতে পারে আবার মেলোড্রামার কাহিনীও ফার্সের অঙ্গীভূত হতে পারে। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই লক্ষ্যগোচর। কোনো কোনো প্রহসন মেলোড্রামার মতই শেষ হয়, ফার্সে নাট্যকার তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের প্রতি অকরুণ আর মেলোড্রামায় সহানুভূতিশীল। ফার্সের চরিত্রগুলি সৎ এবং অসৎ মিশ্রিত; তারা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। ফার্সে চরিত্রসংখ্যা সীমিত, বিকাশ সীমাবদ্ধ। আসলে প্লটের পুষ্টি সাধনেই ফার্সের সার্থকতা নিহিত।


মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা' একটি ফার্স বা প্রহসনরূপে চিহ্নিত। স্বয়ং মধুসূদন এবং নাট্য সমালোচকগণ একে ফার্সরূপেই চিহ্নিত করেছেন। এখানে মধুসূদন সমকালীন পশ্চিমী সভ্যতায় অনুপ্রাণিত কৃত্রিম জীবন, তাদের উক্তি ও অসঙ্গতিকে বিদ্রুপ করা হয়েছে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, উদ্ভট আতিশয্য বা চরম হাস্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে অবশ্য এই প্রহসনের কায়া গঠন করা হয়নি, বরং স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত ঘটনা সন্নিবেশ এই প্রহসনে লক্ষ্য করা যায়। ‘ইয়ংবেঙ্গলে’র প্রতিনিধিরূপে নবকুমার এই প্রহসনের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং এখানে নাগরিক কলকাতার বিকৃতির চিত্রকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মধুসূদন তাঁর কালের সামগ্রিক জীবনকে এখানে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। নবকুমার চরিত্রের মধ্যে তিনি যুগের উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং নব্যশিক্ষিত যুবকদের মদ্যাসক্তি, ভোগবাসনা প্রভৃতিকে ধিক্কার জানানোই আলোচ্য প্রহসনের উদ্দেশ্য। প্রসঙ্গত ধর্মধ্বজী বৈষ্ণবের অসাধুতা, পুলিশ প্রহরীদের অযোগ্যতা, উৎকোচ গ্রহণ প্রভৃতির প্রতিও ব্যঙ্গবাণ বর্ষিত হয়েছে। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের অন্তঃপুরের চিত্র, বারবনিতা, মুসলমান বাবুর্চি প্রভৃতি প্রহসন মধ্যে স্থান লাভ করেছে। মধুসূদন সামগ্রিকভাবে সমাজের মধ্যবর্তী প্রধান দুই শক্তির সংঘাতের রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন। কর্তা মহাশয়ের ধর্মীয় নিষ্ঠা এবং নবকুমার কালীবাবুদের নব্য শিক্ষার আদর্শটি যে কত বিপরীত তাও সুষ্ঠুভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে নববাবুর বক্তৃতাটি সর্বাপেক্ষা স্মরণীয়। এই প্রহসনে সেই সমস্ত উক্তি প্রচারকদের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে যারা ইন্ দি নেম্ অফ ফ্রিডম, লেট আস এনজয় আওয়ারসেলভস' এই উক্তির প্রবক্তা ছিলেন। মধুসূদন শিক্ষিত বা শিক্ষাভিমানী ভণ্ডদের আচরণগত অসঙ্গতির লঘু অথচ বস্তুনিষ্ঠ রূপ তির্যক ভঙ্গিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন বলেই এটি প্রহসনের রূপ নিয়েছে। নবকুমার সম্প্রদায়ের এই পরিণতি দুঃখজনক, কিন্তু তাকে আপাত পরিহাসের লঘুতায় দেখানো হয়েছে বলেই এটি ফার্সে পরিণত হয়েছে এবং মধুসূদন এই কারণেই বোধহয় এটিকে ফার্স বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর পরিণতি মিলনান্তক কিনা তা বিতর্কিত এবং এই প্রহসনের পরিণতি মিলনান্তক কিনা তা বিতর্কিত এবং এই প্রহসনের পরিণতি সুখান্ত পরিণতি নয়। কেননা, এই নাটকের শেষাংশে একটি উক্তি আছে যেটি হরকামিনীর উক্তি— “ও ঠাকুরঝি, এই ভাই তোর দাদার দশা দেখ। হায়, এই কলকেতায় যে আজকাল কত অভাগা স্ত্রী আমার মতন এইরূপ যন্ত্রণা ভোগ করে তার সীমা নাই। হে বিধাতা! তুমি আমাদের উপর এত বাম হলে কেন।” এই উক্তি কিন্তু মিলনান্ত বা সুখান্ত পরিণামের ইঙ্গিত বহন করে না। সুতরাং একে কমেডি বলা অনুচিত। সুতরাং 'একেই কি বলে সভ্যতা?' কিভাবে প্রহসনধর্মী কমেডি বা সুখান্ত পরিণামী কমেডি জাতীয় ফার্স হতে পারে তা সংশয়ের। সেই কারণে একে ফার্স বা প্রহসনরূপে বিচার করাই যুক্তিসঙ্গত।


এই প্রহসনের গঠনরীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে এটি দুটি অঙ্কে বিভক্ত। প্রত্যেক অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক, কাহিনী অজটিল এবং নাট্যকার স্থানগত ঐক্যের জন্য অঙ্কের ব্যবস্থা করেছেন। দৃশ্যে দৃশ্যে কালগত পরিবর্তন ঘটলেও, স্থানগত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নেই। প্রথম গর্ভাঙ্কে নবকুমার বাবুর গৃহ, দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার নিকটে রাজপথ, দ্বিতীয় অঙ্কের দুটি দৃশ্যের একটিতে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা, অপরটিতে নবকুমারের গৃহ। এই চারটি দৃশ্যে কালগত নৈকট্য আছে এবং নাটকের প্রথম দুটি দৃশ্যে ঘটনার প্রস্তুতি, শেষের দুটি দৃশ্যে ফলাফল দেখানো হয়েছে। প্রহসনের চারটি দৃশ্যে কালগত ঐক্য সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। প্রথম দৃশ্যের অনুষ্ঠান বিকাল পাঁচটার কাছাকাছি, দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘটনা সন্ধ্যার পরে ঘটেছে। দৃশ্যে দৃশ্যে ঘটনাগত পারম্পর্য ব্যাহত হয়নি। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নবকুমারের বাবার কাছ থেকে প্রতারণা করে সভায় যাবার অনুমতি আদায় করা, দ্বিতীয় দৃশ্যে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার কাছে পথের উপর বাবাজী, বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা। বাবাজী, সার্জেন্ট, চৌকিদার প্রভৃতির চিত্র বিচ্ছিন্ন সমাজচিত্ররূপে উপস্থিত। বাবাজীর চোখের উপর নিষিদ্ধ মাংস ও বারাঙ্গনাদের আগমন ঘটানো হয়েছে। এর ফলে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার অজ্ঞাত রহস্যের দ্বার বাবাজী তথা দর্শক-পাঠকদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার উৎসব নাট্যঘটনার ক্লাইম্যাক্স নব্য সভ্যতার ছদ্মবেশী চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও ভোগবিলাসিতা এই দৃশ্যে চাতুর্যের সঙ্গে ব্যঙ্গবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় দৃশ্যটি নাটকীয় ঘটনার ক্রমঅবরোহণ। এই দৃশ্যের প্রথমাংশে অন্তঃপুরিকাদের তাস খেলার চিত্রে ঘরোয়া পরিবেশ যেমন প্রাণবন্ত হয়েছে, তেমনি কলিকাল যে গৃহস্থের সংসারে প্রবেশ করেছে তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যটির পরবর্তী অংশে মদোন্মত্ত নবকুমারের বাড়ী ফিরে হল্লা করার মধ্য দিয়ে নাটকীয় দৃশ্যটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।


যে নিষ্করুণতা ফার্সের অন্যতম ধর্ম, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় তা দুর্লক্ষ্য নয়। নাট্যকার অসঙ্গতিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর তীব্র সহানুভূতিতে চরিত্রগুলি দ্রবীভূত হয়নি এবং ফার্স রচয়িতাদের সমাজ সচেতনতার যে বৈশিষ্ট্য, মধুসূদন তাকেই অবলম্বন করেছেন। এই প্রহসনে জটিলতার দ্বারা হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা হয়নি। কয়েকটি চরিত্রের আচরণগত অসঙ্গতি থেকেই লঘু কৌতুকের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। চরিত্রের কার্যকলাপ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অসহায়তা, বিশ্বাস, উক্তি ও আচরণের বৈপরীত্য থেকে যে কৌতুকহাস্যের জন্ম তা এখানে রূপায়িত হয়েছে। নবকুমারের চরিত্র শ্রেণির প্রতিনিধি বলে তার হাসি বিশুদ্ধ কৌতুকের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপে পরিণত হয়েছে। নবকুমার ও তার বন্ধু বান্ধবরা এখানে যে সমস্ত উক্তি করেছে সেগুলি সুবিধাবাদী প্রতিধ্বনি মাত্র, জীবনের আচরণের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। কলেজে পড়া ইংরাজি শিক্ষিত কালীনাথ গীতগোবিন্দ বা শ্রীমদ্ভাগবতগীতার নাম জানে না। তার ভক্ত বৈষ্ণব কাকা তার কাছে ‘ওল্ড-ফুল’ মাত্র। এইভাবে তৎকালীন কলকাতার নাগরিক জীবনের নীতিভ্রষ্টতার ও কপটতার খণ্ডচিত্র এই প্রহসনে প্রকাশিত।


সাধারণত প্রহসনের আয়তন সংক্ষিপ্ত, অপরিসর; ঘটনা জটিলতাবিহীন। এই প্রহসনের চারটি দৃশ্যে একটিমাত্র দিনের ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে মধুসূদন প্রহসনের গতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সাধারণ ট্র্যাজেডি-কমেডি নাটকে নাট্যচরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ঘাত-প্রতিঘাতের যে সুযোগ থাকে প্রহসনে তার একান্ত অসদ্ভাব দেখা যায়। আলোচ্য প্রহসনের চরিত্রগুলি অজটিল এবং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণহীন। বৈষ্ণব কর্তামশাই থেকে শুরু করে তার অনুগত বাবাজী, কালীনাথ, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সদস্যবৃন্দ, নবকুমারের জননী, ভগ্নীবৃন্দ, পত্নী, পুলিশের প্রতিনিধিবৃন্দ, বারবিলাসিনীর দল সকলকেই অল্পক্ষণের জন্য মঞ্চে দেখা গেছে এবং তাদের চরিত্রের কোনো গভীর গোপন দিকে নাট্যকার আলো না ফেলে বহিরঙ্গ দিক থেকে তাদের স্বরূপ প্রকাশে প্রয়াসী হয়েছেন। এই সমস্ত কারণে ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ সার্থক প্রহসনে উন্নীত হয়েছে।