‘বাতাসে কথা ভেসে আসে, বিনিদ্র ভালোবাসা কান পেতে থাকে, শুনতে পায়।'—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘বাতাসে কথা ভেসে আসে, বিনিদ্র ভালোবাসা কান পেতে থাকে, শুনতে পায়।'- উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।


উপরিউক্ত উদ্ধৃতিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্পের অন্তর্গত।

গ্রামের ছেলে রতন শৈশবে মাকে হারায়। স্নেহময়ী দিদিই ছিল তার মায়ের মতো। একসময় দিদির বিয়ে হয় পাশের গাঁয়ে। রতন মাঝেমধ্যেই দিদির কাছে গিয়ে থাকত। প্রাণপ্রিয় দিদিকে ছেড়ে সে বাড়ি ফিরতে চাইত না। একদিন খবর এল, দিদির বাড়িতে গোলমাল। কিসের গোলমাল, রতন তা জানতে পারে না। একদিন রতনদের বাড়িতে দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছিল, থানা থেকে চৌকিদারও এসেছিল। রতন শুনতে পেল, তার দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেমানুষ বলে তাকে এসব ব্যাপারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এ-সংবাদে রতন খুব কেঁদেছিল। মাতৃসম দিদির প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিল। বাবাকে দিদির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেও সে কোনো প্রত্যুত্তর পায়নি। রতন বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘটেছে, যা বাবা তার কাছে লুকোতে চায়। দারোগা-পুলিশের আবির্ভাব এবং বাড়িতে দিদির নাম উচ্চারণে নিষেধ থাকায় রতনের শিশুমনে সংশয়ের বোধটি আরও দৃঢ় হতে থাকে। শোকাতুর রতন একদিন শোনে যে, দিদিকে পাওয়া গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও দিদি কেন বাড়ি আসে না, রতন তা বুঝতে পারে। না। একদিন সকালে সে দিদির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু সেখানে দিদি নেই। সেখানে কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। কাঁদোকাঁদো মুখে রতন সেদিন বাড়ি ফিরে আসে। বাবার কাছে দিদিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলে ধমক খায়। রাত্রে মর্মান্তিক বেদনায় রতন তার একান্ত ভালোবাসার দিদির জন্য চুপিচুপি কাঁদে। রতন যদি জানত, তার প্রাণপ্রিয় দিদি কোথায় আছে, তাহলে সে নিজে গিয়েই তাকে নিয়ে আসত। গল্পের এই স্থানে এসে লেখক বলেছেন যে, শিশুর মন আমরা যা মনে করি, তার চেয়ে অনেক বেশি সজাগ। শিশু অনেক কিছু শুনতে পায় ও বুঝতে পারে। রতন কোথা থেকে শোনে যে, রূপকথার চেয়ে অদ্ভুত এক শহরে তার দিদি থাকে। শহরের সেই স্থানের নাম উল্টোডিঙি। লেখকের বক্তব্য, বালক রতন তার দিদির সম্বন্ধে সামান্যতম কথা শুনতে সর্বদা এত উদগ্রীব ছিল যে, কোনো এক মুহূর্তে সে কারোর মুখ থেকে তার প্রাণপ্রিয় দিদির উল্টোডিঙিতে থাকবার কথা শুনতে পায়। দিদির খোঁজ না পাওয়া গেলেও দিদির প্রতি তার সদা জাগ্রত ভালোবাসা যেন সবসময় কান পেতে ছিল দিদির সম্পর্কে কোনো কথা শোনবার জন্য। তারই ফলশ্রুতিতে রতন তার মমতাময়ী দিদি কোথায় আছে, তা জানতে পেরেছিল।



“দিদিকে চিনতেই তার কষ্ট হয়। দিদি যেন কেমন হয়ে গেছে।'—এখানে কার কার কথা বলা হয়েছে? অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটিতে বালক রতন ও তার দিদি চপলার কথা বলা হয়েছে।

রতন তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজতে বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে শহরে এসেছিল। বাড়িতে তার দিদির নাম করতে নিষেধ আছে। তাই সে সমস্ত পথ মনের কথা মনেই গোপন করে এসেছে। নৌকো পোনাঘাটে এসে পৌঁছবার পর রতনের বাবা তাকে একটি কদম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। কদমতলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রতন তার বাবাকে কাজে ব্যস্ত দেখে একসময় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে তার দিদির খোঁজে। সারাদিন অনেকটা পথ হেঁটে বিকেলবেলায় রতন একটি মেয়ের সহায়তায় তার দিদির খোঁজ পায় উল্টোডিঙিতে। রতনকে সঙ্গে নিয়ে তার মেটেবাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে যখন সেই মেয়েটি চপলার নাম ধরে ডাকে, তখন নাগরিক কুটিল জীবনের মধ্যে আবদ্ধ চপলা তার কোনো খরিদ্দার অসময়ে এসে পড়েছে ভেবে রুক্ষ স্বরে কথা বলে। তারপর সে দরজার কাছে এসে তার প্রিয় ভাই রতনকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্তে তার মাতৃসম দিদিকে চিনতে রতনের কষ্ট হয়। তার মনে হয়, দিদি যেন কেমন হয়ে গেছে। আসলে অল্পবয়সি রতন তার দিদির বর্তমান বাস্তব জীবন সম্বন্ধে কোনো ধারণা তৈরি করতে পারেনি। কেবলমাত্র বহুদিন পরে দিদিকে দেখে দিদির মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করে রতন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তবে রতনের এই ভাবনার মধ্য দিয়ে চপলার মলিন, যন্ত্রণাজর্জরিত, অন্ধকারময় জীবনযাপনের চিত্র পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। বোঝা যায়, গ্রাম্যবধূ চপলা অবস্থা বিপাকে পড়ে মহানাগরিক অন্ধকারের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। তার পূর্ব জীবনের সমস্ত সাধ-স্বপ্ন-হাসি-আলো-রঙ নগর জীবনের যান্ত্রিক পেষণে পড়ে নিঃশেষে বিলীন হয়ে গেছে। এ কারণে রতন মহানগরে এসে তার এই আমূল পরিবর্তিত, বিষণ্ণ-মলিন দিদিকে চিনতে কষ্ট ভোগ করেছে। মেটে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দিদির বিষাদগ্রস্ত রূপ তার শিশুমনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।



'মহানগর সব কিছুকে দাগী করে দেয়, সার্থকতাকেও দেয় একটু বিষিয়ে।'—উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করো।

উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পের অন্তর্গত। 

মাতৃহারা গ্রাম্য বালক রতন তার হারিয়ে যাওয়া মাতৃসম দিদিকে খুঁজতে মহানগরে এসেছিল। একসময় সে উল্টোডিঙিতে গিয়ে তার দিদিকে খুঁজেও পেয়েছিল। কিন্তু দিদির মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করে সে তৃপ্ত হতে পারেনি। রতনের সঙ্গে থাকা মেয়েটির ডাকে চপলা মেটে বাড়ির দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালে রতন তার প্রাণপ্রিয় দিদিকে দেখে নির্বাক হয়ে যায়। দিদিকে তার চিনতে কষ্ট হয়। রতন ও তার দিদি দুজনেই খানিকক্ষণ নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চপলা ছুটে এসে রতনকে বুকে চেপে ধরে জানতে চায়, সে একা এসেছে কিনা। রতন অব্যক্ত অনুভূতিতে দিদির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে, কোনো কথা বলে না। গল্পের এই স্থানে লেখক উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছেন। মহানগরের অন্ধকার, পাশবিক জীবন গ্রামের মেয়ে চপলাকে ‘দাগী’ করে দিয়েছে, পতিতাপল্লীর মেটে বাড়ির বিলাস সামগ্রীর মাঝখানে সে নিজেও জীবন্ত পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। প্রিয় ভাই রতনের সঙ্গে তাই তার মিলন বিশুদ্ধ আনন্দময় ও তৃপ্তিদায়ক হতে পারেনি। অপরদিকে, মহানগরের কলুষ রতনের হারানো দিদিকে খুঁজে পাওয়ার সার্থকতাকেও বিষময় করে দিয়েছে। স্নেহময় দিদির পূর্বেকার স্নিগ্ধ-সুন্দর রূপ মহানগরের ক্লেদাক্ত পরিবেশে যে বিষাদময় মালিন্যে পরিণত হয়েছে, তা দেখে বিস্ময়ে-বেদনায় রতন স্তব্ধ হয়ে গেছে। মহানগরের অন্ধকার ভাই ও দিদির নির্মল সম্পর্কে তথা গ্রামীণ মাধুর্যে এভাবে বিষাক্ত কালো থাবা বসিয়ে দুজনের পূর্বেকার উজ্জ্বল দিনগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।



'আমার যে যাবার উপায় নেই ভাই।'—কথাটি কে কাকে বলেছে? একথা বলার কারণ কী?

প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পে মহানগরের গণিকায় রূপান্তরিত গ্রাম্যবধূ চপলা তার ভাই রতনকে এ-কথা বলেছে।

মহানগরে দিদি চপলাকে খুঁজতে এসে রতন অপ্রত্যাশিতভাবে সার্থক হয়। কিন্তু দিদির অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে সে তৃপ্ত হতে পারে না। রতনের সঙ্গে থাকা মেয়েটির ডাকে চপলা মেটে বাড়ির দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালে রতন তার প্রাণপ্রিয় দিদির বিষাদমলিন রূপ দেখে নির্বাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দুজনেই নিস্পন্দভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার পর চপলা ছুটে এসে রতনকে বুকে চেপে ধরে জানতে চায়, সে একা এসেছে কিনা। রতন কিছু না বলে অব্যক্ত অনুভূতিতে দিদির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। তারপর দিদির মাটির ঘরে ঢুকে সাজানো বিলাস-সামগ্রী দেখে রতন এসব দিদির কিনা জানতে চাইলে অশ্রুপ্লাবিত চপলা ম্লান হেসে ভাইয়ের কথায় সায় জানায়। এই হাসি তার ক্লেদাক্ত, গুমোট জীবনের অভিজ্ঞান-স্বরূপ। রতন তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বললে চপলা ভীষণ চমকে ওঠে। রতন তার দিদির সব জিনিসপত্র গোরুর গাড়ি ডেকে তুলে নেওয়ার কথা বলে। চপলার মুখ থেকে তখন তার বর্তমান যন্ত্রণাদগ্ধ পতিতা-জীবনের কাতর স্বীকারোক্তি-হিসাবে উপরিউক্ত কথাটি বেরিয়ে আসে। নিজ জীবনের সমস্ত সাধ-স্বপ্ন-প্রিয়জনদের ত্যাগ করে চপলা কিছু দুষ্ট লোকদের হাতে বন্দি হয়ে মহানগরের পতিতাপল্লীকেই তার বর্তমানের ঠিকানা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবুও একান্ত আপনজনদের স্মৃতি তো ভোলার নয়। আকস্মিকভাবে নিজের অন্ধকার পরিবেশে প্রিয় ভাইকে দেখতে পেয়ে চপলার পূর্ব জীবনের সব স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এখানকার বন্দি-জীবন ছেড়ে আবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ভাববার কোনো উপায় নেই তার। উল্টোডাঙার গণিকালয়ে সে দুষ্টচক্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তাই রতন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলে চপলা নিজের লাঞ্ছিত, অসহায় জীবনের কথা মনে করে স্নানকণ্ঠে প্রিয়ভাইকে বলে যে, সেই স্থান ছেড়ে তার যাবার কোনো উপায় নেই। অপরদিকে, শ্বশুরবাড়ি ও পরিবারের স্বজনরাও যে ফিরে গেলে তাকে আর গ্রহণ করবে না এ ব্যাপারেও চপলার ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে।



'কিন্তু সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসে তত চপলা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে।'—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

আলোচ্য পত্তিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্প থেকে গৃহীত।

মাতৃসম দিদিকে মহানগরে খুঁজতে এসে রতন সফল হয়। কিন্তু দিদির অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে সে তৃপ্ত হতে পারে না। রতন তার দিদিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বললে চপলা ভীষণ চমকে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার ভাইকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়। রতন তার দিদির সব জিনিসপত্র গোরুর গাড়ি ডেকে তুলে নেওয়ার কথা বললে যন্ত্রণা-জর্জরিত পতিতা জীবনের কাতর স্বীকারোক্তি হিসেবে চপলা তার প্রাণপ্রিয় ভাইকে জানায় যে, তার সেই স্থান ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। দিদির মুখে এই কথা শুনে রতনের মুখের সব দীপ্তি যেন নিভে যায়। তারপর হঠাৎ সে উজ্জ্বল মুখে বলে যে, সে বাড়ি ফিরে না গিয়ে তার দিদির কাছে থাকবে। ভাইয়ের এমন আবদার শুনে চপলার বেদনার্ত মুখ আরও ম্লান হয়ে আসে। সেই প্রবৃত্তি প্রজ্জ্বলিত পরিবেশে তার প্রিয় ভাইয়ের থাকবার কথা চপলার কাছে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। অল্পবয়সি অবুঝ ভাইকে সে ক্লেদাক্ত সেই পরিবেশ সম্বন্ধে সবিস্তারে কিছু বলতে পারে না, আবার ভাইয়ের এমন সারল্যমাখা আবদারকে কীভাবে কৌশলে প্রত্যাখ্যান করবে, তাও তার বুদ্ধির অগম্য হয়ে ওঠে। এদিকে সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে, চপলার অস্থিরতাও বেড়ে যায়। কারণ সন্ধে থেকেই মহানগরের এই কানাগলি তার স্বমূর্তি ধারণ করবে। ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যাবে নারীত্বের লাঞ্ছনার নির্মম নিত্যকর্ম। তার পূর্বেই চপলাকে প্রতিদিনকার মতো সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু সেদিন রতনের উপস্থিতিতে চপলার এসব কাজের সময় এসে গেলে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সর্বোপরি সে তার এই প্রাণপ্রিয় ভাইকে সন্ধের আগেই কীভাবে সেই অন্ধকার স্থান থেকে সরিয়ে দিতে পারে, এই ভেবে চপলা উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে ওঠে।



'এখানে যে তোমার থাকতে নেই ভাই।'—উক্তিটি কে কার উদ্দেশ্যে করেছে? এখানে সে তার ভাইকে থাকতে না দেওয়ার কারণ কী?

উদ্ধৃত লাইনটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পে চপলার উক্তি। 

সে তার ভাই রতনের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছে। উল্টোডিঙির পতিতাপল্লীতে এসে রতন একটি মেয়ের সহায়তায় তার হারিয়ে যাওয়া দিদি চপলাকে খুঁজে বার করে। এমন এক পরিবেশে তার অল্পবয়সি প্রিয় ভাই রতনকে দেখে চপলা স্তম্ভিত হয়ে যায়। রতন তার দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে চপলা কাতরমুখে তার সেই স্থান ছেড়ে যাওয়ার অক্ষমতা জানায়। মাতৃসম দিদির মুখে এই কথা শুনে রতনের মুখের সব দীপ্তি যেন নিতে যায়। তারপর হঠাৎ সে উজ্জ্বল মুখে বলে যে, সে তার দিদির কাছে থাকবে। ভাইয়ের এমন আবদার শুনে চপলার বেদনার্ত মুখ আরও ম্লান হয়ে আসে। ওদিকে সন্ধ্যা যত নিকটবর্তী হয়, চপলা ততই অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ সন্ধে থেকেই শুরু হয়ে যাবে পতিতাপমীর নিত্যকার কর্ম তথা দেহব্যাবসার লাভ-লোকসানের হিসেব। এমন বিষাক্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই চপলা কীভাবে রতনকে এখান থেকে সরিয়ে দেবে, এই চিন্তায় সে আকুল হয়ে ওঠে। সে কৌশলে নড়ালের পোলের কথা, সেখানে যাতায়াতের যানবাহনের কথা বলে ভাইকে চলে যেতে প্ররোচিত করে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় চপলা অশ্রুসজল চোখে মাথা নিচু করে কম্পিত স্বরে ভাইকে প্রকৃত সত্য কথাটা জানাতে উপরিউক্ত উক্তিটি করে। অল্পবয়সি অবুঝ রতনকে চপলা ক্লেদাক্ত সেই পরিবেশের হাল-হকিকৎ সম্বন্ধে সবিস্তারে কিছু বলতে পারে না। তাই এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে প্রগাঢ় স্নেহ-মমতার সঙ্গে সে তার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের আবদারকে প্রতিরোধ করতে চায়। অবস্থা বিপাকে পড়ে গ্রামের পরিবার-স্বজন-ঘেরা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চপলা মহানগরের অন্ধকার গলিতে নিজের জীবনের ঠিকানা তৈরি করতে বাধ্য হয়। তার সৌন্দর্যহীন, বিষাদ-মলিন রুপই বলে দেয় তার এই নারকীয় জীবনের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা। এ অবস্থায় ভাইয়ের দেখা পেয়ে তার সমস্ত দুঃখ চোখের জল হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। পতিতাপল্লীর নিষ্ঠুর রীতিনীতির মধ্যে আবদ্ধ চপলা তার অল্পবয়সি ভাইয়ের সম্ভাবনাময় জীবনের কথা ভেবে তাকে সেই বিষাক্ত স্থান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এমন কথা বলে।



'মুখের দিকে চাইলেও হয়তো দিদির অবিশ্রান্ত চোখের জলের মানে সে বুঝতে পারত না।'—ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য পঙক্তিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পের অন্তর্গত। 

গ্রাম্য পরিবেশে পরিবার-স্বজনদের প্রীতিপূর্ণ আবেষ্টন থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে চপলাকে মহানগরের উল্টোডিঙি নামক স্থানের পতিতাপল্লীতে আশ্রয় নিতে হয়। নিজের সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলি এভাবে নিঃশেষে হারিয়ে যাওয়ায় চপলার বেদনার অস্ত ছিল না। গণিকালয়ের মেটে ঘরে সাজানো বিলাস-সামগ্রীর মাঝে সে নিজেও জীবন্ত পণ্যদ্রব্য হয়ে থাকতে বাধ্য হত। এমন অবস্থায় আকস্মিকভাবে একদিন বিকেলে চপলার অল্পবয়সি ভাই রতন সেই স্থানে গিয়ে হাজির হয় দিদির খোঁজে। রতনকে দেখে চপলা প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যায়, তারপরে ছুটে গিয়ে সে তার প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে। রতন তার দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে চপলা কাতরমুখে তার সেই স্থান ছেড়ে যাবার অক্ষমতার কথা জানায়। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসে, নিজের নিত্যকর্মের সময় নিকটবর্তী বলে চপলা রতনের কথা চিন্তা করে অস্থির হয়ে ওঠে। সে কৌশলে নড়ালের পোলের কথা, সেখানে যাতায়াতের যানবাহনের প্রসঙ্গ তুলে ভাইকে চলে যাবার জন্য প্ররোচিত করে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় চপলা অশ্রুসজল চোখে কম্পিত স্বরে রতনকে বলে যে, সেই স্থানে তার থাকতে নিষেধ আছে। প্রাণপ্রিয় দিদির মুখে এই কথা শুনে অল্পবয়সি অবুঝ রতনের অত্যন্ত অভিমান হয়। দিদি তার হাতে চার টাকা দিলে সে কোনো কথা না বলে বেদনাহত হৃদয়ে দিদির ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং দিদির মুখের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে গলি দিয়ে সোজা বড়ো রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। দিদির কাছ থেকে রতনের এই চলে যাওয়া প্রসঙ্গে লেখক উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছেন যে— হৃদয়মথিত যন্ত্রণাকে বুকে চেপে রেখে চপলাকে প্রতিদিন দেহ ব্যবসার বীভৎস কর্মে লিপ্ত হতে হত, রতনকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখতে পেয়ে তার সেইসব চাপা যন্ত্রণা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ছিল। পূর্বজীবনের স্নিগ্ধ-সুন্দর জীবনের স্মৃতি চপলার বুকের মাঝে প্রতি মুহূর্তে ঠেলে ঠেলে উঠছিল প্রিয় ভাইকে দেখতে পেয়ে। রতনের আন্তরিকভাবে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে চপলা সফল করতে দিতে পারল না নির্মম বাস্তব কারণে, আবার রতনের তার দিদির কাছে থাকবার ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যাত হল চপলার কথায়। তাও সেই একই বাস্তব কারণেই। অভিমানাহত রতন দিদির সঙ্গে থাকতে না পারার ব্যর্থতাকে বুকে নিয়ে বিদায়-মুহূর্তে কোনো কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল—এই দৃশ্য চপলার অন্তরে যেন বেদনার প্রস্তর চাপিয়ে দিচ্ছিল। ভাইয়ের সঙ্গে ক্ষণিকের মিলন, সেই সূত্রে পরিবার-স্বজনদের কথা মনে পড়া, ভাইয়ের ব্যাকুল প্রত্যাশাকে পূর্ণ হতে না দেওয়া—এইসব কারণে ভাইয়ের বিদায়ের ক্ষণে চপলার দু'চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল ঝরে পড়ছিল, যে অশ্রুর অর্থ বোঝবার সামর্থ্য অল্পবয়সি, অবুঝ ও অভিমান ক্ষুব্ধ রতনের ছিল না।



'বড়ো হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব দিদি! কারুর কথা শুনব না!'—কথাটি কে কাকে বলেছে? উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পে বালক রতন তার দিদি চপলাকে উল্লিখিত উক্তিটি করেছে।

মহানগর কলকাতার উল্টোডিঙি নামক স্থানে এসে রতন তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে পায়। নগরের পরিবেশে দিদির মাটির ঘরের মধ্যে সাজানো বিলাসসামগ্রী দেখে সে বিস্মিত হয়। কিন্তু রতনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, দিদিকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই সে গোরুর গাড়ি ডেকে দিদির জিনিসপত্র তুলে দেওয়ার কথা বলে। তবে দিদির কাতর মুখ থেকে তার ফিরতে না পারার অক্ষমতার কথা শুনে রতন বেদনার্ত হয়। পরক্ষণেই সে আশায় উজ্জ্বল মুখে জানায় যে, সে তার দিদির কাছেই থাকবে। তখন চপলা সেই স্থানে তার ভাইয়ের থাকবার নিষেধের কথা বললে রতনের অত্যন্ত অভিমান হয়। দিদি তার হাতে চার টাকা দিলে সে কোনো কথা না বলে বেদনাহত হৃদয়ে দিদির ঘর থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে সোজা বড়ো রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। একবেলার এই অভিজ্ঞতাতেই রতন যেন জীবন সম্বন্ধে অনেক পরিণত বোধ অর্জন করে। বড়ো রাস্তার কাছে গিয়ে হঠাৎ সে ফিরে এসে উপরিউক্ত অঙ্গীকারের কথাটি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে। পূর্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে রতন অনুভব করেছিল, দিদির গ্রামে ফেরার পথে প্রধান অন্তরায় বড়োরা। বালক হয়েও সে উপলব্ধি করেছিল, বাড়িতে দিদির নাম উচ্চারণ করাতেই নিষেধ আছে। তার দিদি কেন কীভাবে নগরে এসেছে তা সে জানে না, নগরের মেটেবাড়িতে সে কীভাবে জীবনযাপন করছে, অল্পবয়সের কারণে সেটাও সে বোঝেনি। কিন্তু রতন বুঝতে পেরেছিল, বড়োরা তার দিদিকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেবে না। তাই সে শপথ করেছিল, সে বড়ো হয়ে যাবতীয় নিষেধকে অগ্রাহ্য করেই দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। গল্পের এ স্থানে রতনের শিশু ব্যক্তিত্বে পরিণতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে।