'চুয়াচন্দন' গল্পে নদিয়া নাগর নিমাই পণ্ডিত চরিত্রটি কীভাবে গল্পের কাহিনীকে প্রভাবিত করেছে তা আলোচনা করো।

'চুয়াচন্দন' গল্পে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে নিমাই পণ্ডিত চরিত্রটি কতটা প্রাসঙ্গিক আলোচনা করো।


ঐতিহাসিক কাহিনী রচনায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পরেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভাকে অবিসংবাদিত ভাবে স্বীকার করতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক কাহিনী যেমন রুদ্ধশ্বাস গতিতে এগিয়ে যায়, শরদিন্দুর কাহিনীও তেমনি গতিময়। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ মীরকাশিম, দলনীবেগম, ঔরঙ্গজেব, রাজসিংহ, জগৎসিংহ প্রভৃতি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ চরিত্রগুলি যেন ইতিহাসের ধূলিমলিন পৃষ্ঠা থেকে রংচঙে উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যায়। ইতিহাসের উপাদান উপন্যাসে ‘সুসিদ্ধ’ হতেই পারে, লেখকের এই স্বাধীনতা আছেই। শরদিন্দুর কাহিনীতে তেমনি কালিদাস, স্কন্দগুপ্ত, শীলভদ্র, দ্বিতীয় দেবরায়, শিবাজী, আলাউদ্দিন খিল্জী, নিমাই পণ্ডিত প্রভৃতি ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা অবলীলায় কাল্পনিক চরিত্রগুলির সঙ্গে মিশে গিয়ে গল্পের টানকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে।


আলোচ্য গল্প ‘চুয়াচন্দন’ শুধুমাত্র শরদিন্দু বন্দ্যোপাধায়েরই নয় বাংলা সাহিত্যে এটি একটি বিশিষ্ট গল্প। এ গল্পের কাহিনী প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর পূর্বের নবদ্বীপের জীবনচিত্রের। সে সময়ে নবদ্বীপের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ছিলেন শচীনন্দন শ্রীচৈতন্যদেব বা নিমাই পণ্ডিত। অতি অল্প বয়সেই নিমাই পণ্ডিতমহলে অগ্রগণ্য পণ্ডিত হিসেবে নিজের সুনামকে মহিমান্বিত করেছিলেন।


বৈষুবশাস্ত্রে শ্রীচৈতন্যকে বলা হয়েছে—'অন্তঃকৃয় বহিগৌর'। মনের গোপন কন্দরে কৃষ্ণনামকে সঙ্গী করে নিজের সুন্দর উজ্জ্বল ‘গোরা তনুকে দেহে ধারণ করে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বয়ং মহাপ্রভু। চৈতন্য জীবনী কাব্যগুলিতে এর সত্যতা স্বীকার করে নেওয়া আছে। আলোচ্য গল্পে মহাপ্রভুর কৈশোর পেরোনো সদ্য নবীন যুবা অবস্থা অর্থাৎ নবদ্বীপের দাপুটে পণ্ডিত নিমাইয়ের কাহিনীই প্রাধান্য পেয়েছে। নিমাইয়ের সংসার ত্যাগ, বৈষুবধর্ম প্রবর্তনের কাহিনী, তাঁর নীলাচলবাসের কাহিনী এই গল্পে অনুপস্থিত।


নদিয়া নাগর হিসেবে নিমাইয়ের কীর্তি জগৎবিখ্যাত। নিমাই পণ্ডিত নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র ও তাঁর স্ত্রী শচী দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান বিশ্বস্তর। প্রথম পুত্র বিশ্বরূপ। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব ডানপিটে ও চটুলতা-প্রিয় ছিলেন নিমাই। কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি-পাণ্ডিত্যে সারাভারতের দিকপাল পণ্ডিতেরা তাঁকে বেশ ডরাতেন। সারা ভারতেই তাঁর পাণ্ডিত্য ও তর্কপ্রিয়তার কথা প্রচারিত ছিল। গয়াতে পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সমাপনাস্তে ঈশ্বরপুরীর নিকট গোপালমন্ত্রে দীক্ষিত হন। এবং সেই থেকেই শুরু হয় তাঁর হরিণাম সংকীর্তন। মধুরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ভগবৎ দর্শনের সার কথাকে উপলব্ধি করা এবং সর্বোপরি জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাবাদ ও প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠা করা।


আমাদের আলোচ্য 'চুয়াচন্দন' গল্পে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে নিমাই পণ্ডিত যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব হওয়ার আগে নিমাই পণ্ডিত হয়ে নবদ্বীপ মাতিয়ে রাখার ও গল্পের নায়ক-নায়িকার মিলনসহ সৎকার্যাবলীর পুরোধা পুরুষ হিসেবে তাঁকে অঙ্কন করেছেন শরদিন্দুবাবু। গল্পে তিনি নিজেই বলেছেন—“নদের নিমাই তখনও ব্যাকরণের টোলে ছাত্র পড়াইতেছেন ও নানাপ্রকার ছেলেমানুষি করিতেছেন। তখনও সেই হরিচরণস্তুত প্রেমের বন্যা আসে নাই—'। এই একটি কথাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় গল্পে নিমাইয়ের বিচরণকাল ও তাঁর বয়স ও ক্ষণ।


গল্পের শুরুতে আমরা নবদ্বীপের স্নানের ঘাটের দৃশ্য দেখতে পাই। নবদ্বীপের তাবড় তাবড় পণ্ডিতেরা ছাড়াও সেখানকার সাধারণ মানুষ সকলেই স্নানরত। নিমাই পণ্ডিতও স্নান করতে এসেছেন। ঠিক এইসময়ই বিদেশ থেকে বাণিজ্য করে দেশে বিশাল বাণিজ্যতরী নিয়ে ফিরে আসতে থাকে গল্পের নায়ক চন্দনদাস। তার নৌকার প্রবল জলতাড়নায় গঙ্গার ঘাটে স্নানরত নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত কাণভট্ট শিরোমণি মহাশয় জলে ডুবে যান। আচমকা এই ঘটনায় সকলেই হতবাক হয়ে যান, কিন্তু কেউই তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি কিন্তু তরুণ যুবক নিমাই নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে কাণভট্টকে বাঁচাতে নদীতে ডুব দেন এবং অবশেষে তাকে উদ্ধারও করেন। এই অংশে নিমাই পণ্ডিতের সাহসিকতা, ধৈর্য এই সমস্ত গুণাবলী প্রকাশ পেয়েছে।


কাণভট্ট শিরোমণিকে বাঁচানো অতি কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। নিজ প্রাণের কথা চিন্তা না করে নিমাই নদীতে ডুব দিয়েছিল আর্তকে বাঁচাতে কিন্তু এইসময়ও তাঁর রসোজ্জ্বল ভাবমূর্তিটির পরিচয় পাওয়া যায়—“সকলে সচিৎকারে প্রশ্ন করিল, “পেয়েছ? পেয়েছ?” যুবক হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বলতে পারি না। তবে একমুঠো টিকি পেয়েছি।” এই অংশে হাস্যের নির্মলতা নিমাই চরিত্রকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। শিরোমণি মশাইকে বাঁচাবার পর তিনি আরও একটি হাস্যরসের কথা বলেন—“শিরোমণি মশায়, বলুন দেখি বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন? আপনার নব্য ন্যায়শাস্ত্র কি বলে?"


ছোট-খাটো এইসব হাস্য-পরিহাসছলে কথাগুলির মধ্য দিয়ে এক প্রাণচঞ্চল, হাস্যপরিহাস মুখর যুবক হিসেবে নিমাই পণ্ডিতের ছবি এঁকেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।


কাণভট্ট শিরোমণি মশাই নিমাইকে 'নিপাতনে সিদ্ধ' বলে ডাকতেন। লেখক বলেছেন— “যুবককে শিরোমণি মহাশয় 'নিপাতনে সিদ্ধ’ বলিয়া ডাকিতেন। একটু ব্যাকরণের খোঁচাও ছিল ; কূটতর্কে অপরাজেয় শক্তির জন্য সমাদর মিশ্রিত স্নেহও ছিল।”


আমরা জানি, ব্যাকরণের সন্ধির নিয়মে এই ‘নিপাতনে সিদ্ধ' কথাটি প্রচলিত। 'নিপাতনে সিদ্ধ’ সন্ধি কোনো নিয়ম মেনে চলে না। স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জন কিংবা বিসর্গ সন্ধিতে একটি নির্দিষ্ট সূত্র আছে। সেই সূত্রের নিয়মেই সন্ধিটি গড়ে ওঠে কিন্তু ‘নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধির নির্দিষ্ট কোনো সূত্র নেই।


নিমাইও তাই। সমস্তরকম নিয়ম, সংস্কারের বেড়াজাল-এ সে আবদ্ধ থাকে না। নিয়মের বন্ধসূত্রে বাঁধা থাকে না নিমাই। এক মুক্ত প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ততাকে প্রকাশ করে নিমাই পণ্ডিত। তাই কাণভট্ট শিরোমণি তাঁকে এ নামে ডাকতেন। আর একটি বিষয়ও এখানে লক্ষণীয়, নিমাই কূটতর্কে ও অপরাজেয় ছিলেন। ন্যায়, জ্যোতিষ, স্মৃতি প্রভৃতি বিশিষ্ট শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন নিমাই। বিখ্যাত তর্কবাগীশ বলে ভারতবর্ষে অত্যধিক খ্যাতি ছিল তাঁর। কাণভট্ট শিরোমণি নবদ্বীপের বিশিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর কাছে এই নব্যযুবক নিমাই পণ্ডিতাগ্রগণ্য ছিল সারা নবদ্বীপে। শিষ্য যদি কম বয়সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন তাহলে গুরুর কাছে সেটি চরম আনন্দের, এইজন্যই স্নেহমিশ্রিত সমাদর ছিল তাঁর প্রতি কাণভট্টর।


কাণভট্ট বেশ কিছুক্ষণ নিমজ্জিত ছিলেন গঙ্গার জলে, নিমাই তাঁকে তীরে তুলে নিয়ে এসে বাঁচায়। একটু সুস্থ বোধ করে কাণভট্ট একটি অসাধারণ কথা বলেন— ‘‘বিশ্বস্তর, এতদিন জানতাম তুমি নিপাতনেই সিদ্ধ, কিন্তু এখন দেখেছি প্রাণদানেও তুমি কম পটু নও। আশীর্বাদ করি, এমনিভাবে মজ্জমানকে উদ্ধার করেই যেন তোমার জীবন সার্থক হয়।"


নিমাই পণ্ডিত শুধুমাত্র 'নিপাতনে সিদ্ধ' অর্থাৎ নিয়ম না মানার প্রতিমূর্তিই নন তিনি, সকলকে প্রাণদানেও পটু কারণ নিজ জীবনের বিপর্যয়কে তুচ্ছ করে শিরোমণি মশাইকে বাঁচান তিনি। এতে শিরোমণি মশাই যথেষ্টই প্রীত হন এবং আশীর্বাদ করেন—মজ্জমানকে বাঁচিয়ে জীবন সার্থক করার।


গল্পটিকে লক্ষ করলে আমরা এই আশীর্বাদের ফলটি ধরতে পারব। চুয়া সমাজের থেকে চ্যুত এক অনাথা তরুণী তাকে চন্দনের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে সমাজের পতিত 'মজ্জমান'কে বাঁচানোর পথটি দেখিয়ে দিয়েছেন। নিমাই পণ্ডিত এক জায়গায় নিজে স্বীকার করেও নিয়েছেন যে কাণভট্ট মশাইয়ের আশীর্বাদ এরই মধ্যে ফলতে শুরু করেছে বলে। চুয়া ও চন্দনকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে বাঁচানোর পথটি দেখিয়েছেন স্বয়ং নিমাই পণ্ডিত।

আর শ্রীচৈতন্যদের হবার পর 'হরিণাম' কণ্ঠে ধারণ করে 'আচণ্ডালে ধরি দেয় কোল। ধনী দরিদ্র-বর্ণাশ্রম নির্বিশেষে প্রেমগান শুনিয়ে গেছেন। চৈতন্যদেব আর সমাজের সংস্কারের বেড়াজালকে ছিন্ন করে মানুষকে ঔদার্য্যের মন্ত্র দিয়েছেন। মহাপ্রভুর এই বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডের আভাস অতি অল্পভাবে গুছিয়ে বলেছেন শরদিন্দু।


চন্দন যখন প্রথম নৌকা থেকে নিমাইকে দেখে তখন তার মনে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়— “এই গৌরাঙ্গ যুবকের অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব দেখিয়া সে মুগ্ধ হইয়া গেল। সে পৃথিবীর অনেক দেশ দেখিয়াছে; সিংহল, কোচিন, সুমাত্রা, যবদ্বীপ কোথাও যাইতে তাহার বাকি নাই। কিন্তু এমন অপরূপ তেজোদীপ্ত পুরুষমূর্তি আর কখনও দেখে নাই।"


এখানে গৌরাঙ্গ অর্থাৎ নিমাইয়ের দেহরূপ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তেজোদীপ্ত পুরুষমূর্তির রূপটাও বলে দিয়েছেন গল্পকার। আর ওই তেজস্বিতার পরিচয়ই আমরা গল্পের পরবর্তী অংশে পাব।


নিমাই পণ্ডিত নবদ্বীপের মানুষ, চুয়াও তাই। চুয়ার দুর্দশার কথা নিমাইয়ের অবিদিত ছিল না কিন্তু তিনি নিজে এককভাবে কিছু করে উঠতে পারছিলেন না। চন্দনদাস যখন চুয়াকে ভালোবেসে মর্যাদা দিয়ে তাকে বিবাহ করবে বলেছে তখন নিমাই এই কাজের জন্য চন্দনকে প্রশংসা করতেও ভোলেননি—“আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার উদ্যম প্রশংসনীয়...।” চুয়াকে উদ্ধার করার জন্য চন্দনের একমাত্র গোপন পরামর্শদাতা হলেন নিমাই পণ্ডিত। নিজে সৎ ও নির্ভীক তাইজন্য অপরের মহৎ কার্যাবলিকে মাহাত্ম্য দান করতেও দ্বিধা বোধ করেন। না। নিমাই চরিত্রের এই সৎ, ঔদার্য্য গুণটি পাঠকের সম্মুখে সুন্দরভাবে তুলে ধরেন গল্পকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।


চুয়া ও চন্দনের শেষপর্যন্ত নৌকার মধ্যে মিলন ঘটিয়ে রাক্ষসমতে বিবাহ দিয়ে নিজের কার্য সমাধা করেছেন নিমাই। এতে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের উজ্জ্বলতম দিকটি প্রতিভাত হয়েছে গল্পে।


‘একমুঠো টিকি পেয়েছি’ নিমাই পণ্ডিতের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে ত্রাণের কথাই বোঝানো হয়েছে। ষোড়শ শতকে ‘ধর্ম ও সমাজের দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ ঘোর দুর্দিন থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। সে কথারই আগাম ইঙ্গিত বহন করেছে কথাটি। মানবপ্রেমের অগ্রদূত নদিয়া নাগর নিমাই টিকিধারী শাস্ত্রের বচনসর্বস্ব পণ্ডিতদের মনে মনে বেশ ঘৃণা করতেন। বাহ্যিক জ্ঞানের আস্ফালন, ভেকধারী তর্কবাগীশদের বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষঘাত করতেন, 'টিকি' নিয়ে রক্তাব্যঙ্গ প্রসঙ্গে শরদিন্দুবাবু সেই বিষয়টির প্রতিই আলোকপাত করতে চেয়েছেন। 'বিশ্বম্ভর' নামটি প্রয়োগে যেমন চরিত্রটির ঐতিহাসিক ভিত্তিকে দৃঢ় করা হয়েছে, তেমনি চৈতন্য জীবনীকারের আঁকা চৈতন্যভাবমূর্তি থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক ছবি এঁকেছেন লেখক। গল্পের শেষপর্বে চুয়াচন্দনের বিয়ে দিয়েই নিমাই পণ্ডিত বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলে বণিকপুত্র তার নৌকায় বিশ্রাম করার অনুরোধ জানালে তিনি ছোট্ট একটু রসিকতা করে বসেন—“তোমার নৌকায় তো একটি বই ঘর নেই। বলিয়া মৃদু হাসিলেন।” এই একটিমাত্র উক্তিতেই শরদিন্দু গতানুগতিক চৈতন্য চরিত্রের বদলে স্বতন্ত্র এক ভাবমূর্তি যেন অবলম্বন করেছেন। তাই প্রমথনাথ বিশী বলেন— “ ‘চুয়াচন্দন’ চৈতন্যদেবের আমলের নদীয়ার একটি কাহিনী। যেমন রোমান্টিক তেমনি বাস্তব; কিন্তু ইহার মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগিয়াছে কিশোর চৈতন্যের চিত্রটি, চৈতন্যদেবের যে মুন্ডিত মস্তক কৌপীন সম্বল মূর্তির সঙ্গে আমরা সচরাচর পরিচিত, এ চিত্র সে চিত্র নয়। এ সেই দুর্দান্ত বিদ্বান, মূর্খ পণ্ডিতদের মূর্তিমান ভয় স্বরূপ, দৈব প্রতিভায় সমুজ্জ্বল, এক ডুবে গঙ্গাগর্ভ-নিমজ্জিত পণ্ডিতদের টিকি ধরিয়া টানিয়া তোলা, প্রচুর হাস্যে প্রগল্ভ সন্ন্যাস পূর্ববর্তী চৈতন্যদেবের চিত্র। চৈতন্যদেব যে এমন ছিলেন তাহা কোন কোন বৈয়ব লেখকের জীবনী হইতে পাওয়া যায়, কিন্তু স্পষ্টভাবে সে ছবি দেখি নাই।”


নিমাই পণ্ডিতের প্রাথমিক হাস্যপরিহাসোচ্ছল মূর্তি গড়ে পরবর্তী ঘটনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন অর্থাৎ লঘুচপল পণ্ডিত মনস্ক এই মানুষটি নরখাদক মাধবের কবল থেকে চুয়াকে উদ্ধার করে সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। পরার্থপরতার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেলা ভার। মূলত তাঁর বুদ্ধিতেই চন্দনের চুয়া লাভ হয়েছে। কার্যসিদ্ধিতে তিনি চাতুরী অবলম্বন করতেও পিছপা নন–“মাধব যে রকম দুর্ধর্ষ পাষণ্ড তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে কোনও ফল হবে না।" তাঁর পৌরোহিত্যে চুয়াচন্দনের রাক্ষসমতে বিবাহের মধ্য দিয়ে উভয়ের মিলন ঘটেছে, এ ঘটনা কাল্পনিক হলেও শরদিন্দুর লেখনীগুণে নিমাই পণ্ডিতের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রসজ্ঞ সমালোচক প্রমথনাথ বিশী যথার্থই লিখেছেন— “যে চৈতন্য একদিন বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই, তিনি আবার একদিন অন্ধকার রাত্রে মাঝগঙ্গায় চন্দনের সহিত চুয়ার রাক্ষস বিবাহ দিয়াছিলেন এমনতর মিথ্যা সত্য ইহার আগে পড়ি নাই। যাঁহারা চৈতন্যদেবের গতানুগতিক চিত্র দেখিয়া বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহারা এ দৃশ্য দেখিলে চৈতন্যদেবের ভক্ত হইয়া উঠিবেন, আশা করিতেছি।”


নিমাই পণ্ডিতের এই অসাধারণ রসমূর্তি চোখে লেগে থাকে গল্প শেষ হওয়ার পর পর্যন্ত। বিশিষ্ট গল্পকার শরদিন্দুবাবু ইতিহাসের এক চরিত্রকে খুব সুন্দরভাবে গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত করে সফলতা লাভ করেছেন। হরিণাম কণ্ঠী শ্রীচৈতন্যের পূর্বাশ্রমের খণ্ডিতচিত্র নিমাইয়ের স্বরূপকে আমাদের সম্মুখে প্রতিভাত করে তোলে।