'মুক্তধারা’ নাটকের নামকরণ যথাযথ ও সার্থক হয়েছে কিনা আলোচনা করো।

'মুক্তধারা’ নাটকের নামকরণ


মুক্তধারা নাটকের প্রথম নাম রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন ‘পথ'। কিন্তু সে নাম পরে পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ‘পথ মুক্তি’, ‘পথ মোচন’ এবং অবশেষে নাম রাখলেন ‘মুক্তধারা'। এই নামকরণের পিছনে কবির নিশ্চয়ই কোনো না কোনো যুক্তি কাজ করেছিল। নিছক নাম দেবার স্বভাব তাঁর ছিল না। তার অন্যতম প্রমাণ ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নামকরণের দৃষ্টান্তে। উপন্যাসটির নাম প্রথমে তিনি রেখেছিলেন 'তিনপুরুষ' পরে নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করেন ‘যোগাযোগ’। ‘শেষের কবিতা' উপন্যাসের নামও তিনি প্রথমে রেখেছিলেন ‘মিতা'। পরে প্রবাসীতে মুদ্রণের সময় নাম দিয়েছিলেন ‘শেষের কবিতা'। বস্তুত, তিনি নামকরণ করতেন নামীর স্বভাব ব্যক্ত করে। সে পদ্ধতি শুধু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। না। তিনি নামকরণ করতেন গাছপালার, ফুলেরও এবং বলাবাহুল্য, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নামকরণ আদর্শ রূপেই বিবেচিত হয়েছিল। কোনো মানব শিশুর নামকরণের সঙ্গে সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের কিছু পার্থক্য আছে। শিশুর নাম শ্রুতিমধুর এবং সহজ আহ্বান যোগ্য হলেই চলে, কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে নামকৃত উপাদানটির মর্মকথা বা উদ্দেশ্য বা কোনো বিশেষ বক্তব্য। নাটক উপন্যাসের ক্ষেত্রে আবার অনেক সময় নায়ক বা নায়িকার অথবা মূল চরিত্রের নাম দিয়েই নামকরণ করা হয়ে থাকে। আমাদের আলোচ্য ‘মুক্তধারা’ নাটকের ক্ষেত্রে সেইরকম কেন্দ্রীয় বস্তুটির নাম দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে। ‘মুক্তধারা' আলোচ্য নাটকে একটি ঝর্নার নাম, যে ঝর্নাকে বাঁধ দিয়ে বেঁধেছিলেন যন্ত্ররাজ বিভূতি; এবং যে বাঁধকে ভেঙেছিলেন অভিজিৎ জীবন দিয়ে।


শিবতরাইয়ের বিদ্রোহী প্রজাদের জব্দ করার জন্যে তাদের তৃষ্ণার জলের উৎস মুক্তধারা ঝর্নাকে উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ বাঁধ দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলেন। এই জন্যে তিনি যন্ত্ররাজ বিভূতির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের চেষ্টায় অনেক পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ কুড়িয়ে অবশেষে মুক্তধারা ঝর্নাকে বাঁধ দিয়ে বেঁধেছিলেন যন্ত্ররাজ বিভূতি। বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে তার সিদ্ধিতে বা উদ্বোধন মানসে ভৈরবমন্দিরে পূজা দিতে এসেছেন রাজা রণজিৎ। আমবাগানে পড়েছে তাঁর শিবির। কিন্তু মানবকল্যাণকামী যুবরাজ অভিজিৎ ছিলেন এই বাঁধের তথা মানব পীড়নের ঘোর বিরোধী। তিনি মানুষের অধিকার বিস্তৃতির পক্ষে কর্মকারী, ব্রতধারী; কোনো অমানবিক বন্ধনই সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি খুলে দিয়েছেন রাজা রণজিতের পূর্বপুরুষ কর্তৃক অবরুদ্ধ নন্দিসংকটের পথ, দূতের মুখে বার্তা পাঠিয়েছেন যন্ত্ররাজ বিভূতির কাছে— বাঁধ ভাঙতে তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন। এবং নাট্যপরিণতিতে অভিজিৎ বাঁধ ভেঙে আবদ্ধ ঝর্নার ধারাকে মুক্ত করে মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।


রবীন্দ্রনাথ 'মুক্তধারা' নাটক রচনা করেন পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে স্বল্পকালীন অবসর যাপনকালে শিলাইদহে। রচনার সময়ে নাটকটির নামকরণ করেছিলেন ‘পথ'। কিন্তু পরবর্তীকালে ‘প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশের সময় সে নাম পরিবর্তন করে নাটকটির নামকরণ করেছিলেন ‘মুক্তধারা'। এখন দেখা যাচ্ছে দুটি নামই তাৎপর্যবাহী। কিন্তু বিচার্য বিষয় হল, কোন্ নামটি সার্থক। পূর্ব নাম না অধুনা চলিত নাম। কেন না, দুটি নামের স্রষ্টাই নাট্যকার। এমত অবস্থায় দুটি নামকে নিয়েই একে একে বিচার করে দেখা আবশ্যক। প্রথমে আসা যাক ‘পথ’ নামটির বিষয়ে।


‘পথ' নামের পক্ষে যুক্তি হল, প্রথমত এই নাটকটি একটিই দৃশ্য বা পট। সে পট বা দৃশ্য— পথের দৃশ্য। ভৈরবমন্দিরে যাবার পথে সমস্ত পাত্রপাত্রী কথোপকথনে রত। তার মধ্যে দিয়েই নাটকের কাহিনি বিন্যস্ত। এই পথ সীমাহীনতার প্রতীক, জীবনের প্রতীক আবার গতিময়তারও প্রতীক। সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদার মুক্তধারা'র আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “রবীন্দ্রসাহিত্যে পথের অবস্থান নিতান্ত তাৎপর্য মণ্ডিত। পথ যেমন গতির প্রতীক তেমনি মিলনের ক্ষেত্র রূপেও চিহ্নিত হয়েছে কোথাও কোথাও। আলোচ্য নাটকে দেখা যায় একটি মাত্র দৃশ্যে সমস্ত নাটক আবর্তিত হয়েছে। সে পথের দৃশ্য। ভৈরবমন্দিরে যাবার পথের ওপর পথিক, নাগরিক, রাজা, মন্ত্রী সকলেরই পদচারণা। এই পথ নাটকে তাই তাৎপর্যপূর্ণ। পথ হল নিরন্তর অগ্রসরের ক্ষেত্র। জীবনের সঙ্গে তার একটা সাদৃশ্য বর্তমান। জীবনও পথেরই মতো অবিরাম অগ্রসরের ক্ষেত্র। উভয়েই সীমাহীনতার ইঙ্গিতবাহী। কিন্তু উভয়েরই অপর প্রান্তে অভীষ্টের স্থান। এক প্রান্ত থেকে অভীষ্ট পর্যন্ত নিরন্তর যাত্রী মানুষ। পথে ও জীবনে তার নানা মুখ, নানা অভিজ্ঞতা — লব্ধ ও বিম্বিত। পথ এবং জীবন তাই গতির প্রতীক। আলোচ্য নাটকে সেই পথের গতিকে রোধ করতে রাজশক্তি যন্ত্রশক্তিকে আশ্রয় করেছে।”


নাটকের ‘পথ’ নামটি নাট্যকার শেষপর্যন্ত রাখেন নি। রেখেছেন 'মুক্তধারা'। এই নাম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নাট্যকারের অভিপ্রায় অনুমান করা যায়। ‘পথ’ নামটি বিশেষ করে পরিণতিহীন অনস্ত অভিসার ক্ষেত্রকে স্মরণ করায়। তাই ‘পথ’ নামের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। কিন্তু বিভূতির বাঁধ ভাঙা ও অভিজিতের মৃত্যুবরণ এই দুই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে পরিণতি নাটকের মধ্যে বিবৃত তার মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েনি। আবার, আলোচ্য নাটকের পথকে সীমাহীন বলতে পারি না এই কারণে যে, নাট্যদৃশ্যে দৃশ্যমান অংশে দেখি উত্তরকূটের আকাশটা ভৈরবমন্দিরের চূড়া ও মুক্তধারার বাঁধের মাঝখানে আবদ্ধ হওয়ায় সীমায়িত। এবং অভিজিৎ বাঁধ ভাঙলেও বাঁধের চূড়াটা ভেঙে আকাশের অসীমতাকে ব্যাপ্ত করতে পারেন নি। তাই এ নাটকের নাম ‘পথ’ বা ‘পথ মোচন' না রাখাটা সঙ্গতই হয়েছে।


বহু সভায় বহু শ্রোতার কাছে শোনানোর পর, আলোচ্য নাটকের নাম নাট্যকার রেখেছেন ‘মুক্তধারা'। এই নামের পক্ষে অনেকগুলি কারণ দর্শানো যেতে পারে। প্রথমত ‘মুক্তধারা' নামটি কাব্যগুণান্বিত ও শ্রুতিমধুর। দ্বিতীয়ত, ‘মুক্তধারা' নামের মধ্যে পাওয়া গেল প্রতিপাদ্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বদ্ধ জলধারা মুক্ত হয়ে প্রাণকল্লোল মুক্তধারায় পরিণতি লাভ করেছে। তৃতীয়ত, শুধু ঝর্নাকে নয়, বদ্ধ প্রাণের প্রবাহকে, শোষণে আবদ্ধ মনুষ্যত্বকে আত্ম প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মুক্ত করেছেন যুবরাজ অভিজিৎ। এই সব কারণে আলোচ্য নাটকের 'মুক্তধারা' নাম সার্থক হয়ে উঠেছে।