ঐতিহাসিক উপন্যাস কাকে বলে? 'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা কতদূর সঙ্গত আলোচনা করো।

'অরণ্যের অধিকার'কে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে গ্রহণ করা যায় কী? যুক্তি ও তথ্যসহ পক্ষে অথবা বিপক্ষে মতামত দাও।

ইতিহাসের কাহিনী বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে যে উপন্যাস গড়ে ওঠে, তাকে বলে ঐতিহাসিক উপন্যাস। ঐতিহাসিক উপন্যাসে অতীতকালের কাহিনী থাকে। ইতিহাসের রক্তমাংসের মানুষকে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্থাপন করা স্কটের মত ঔপন্যাসিকের উদ্দেশ্য ছিল। ঐতিহাসিক পটভূমি, ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও ঐতিহাসিক আবহসৃষ্টি ঐতিহাসিক উপন্যাসের লক্ষ্য। "The historical novel takes its setting and some of its characters and events from history; the term in usually applied only if the historical mileu and events are farely elaborately developed, and important to the central narrate" ( A Glossary of Literay Terms : M. H. Abrams) এখানে 'historical mileu'-র কথা বলা হয়েছে। ডিকেন্সের 'A tale of two Cities', কেনেথ রবার্টস-এর 'North west Passage' ও বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাজসিংহ' এর দৃষ্টান্ত। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ইতিহাসের ছায়াতলে পারস্পরিক জীবনের কাহিনী ঐতিহাসিক উপন্যাসের পরিচয়। ড. সুকুমার সেন 'ইতিহাস' বলতে বুঝিয়েছেন 'তথ্যসৰ্বস্বতা', ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে বুঝিয়েছেন ‘অংশত তথ্যনির্ভর অংশত কল্পনানিষ্ঠ'। ড. সুকুমার সেনের মতে গল্পরস স্থান কাল-প্রসঙ্গের আধারে পরিবেশিত হওয়া এক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয়।


একজন সমালোচক লিখেছেন – “A term which refers to novels set in a period of time recognigally 'Historical' in value to the time of writing. The past tense may be employed in the narration, the account may purport to have been within in that past time or in some interesting time". (A Dichner of Modern Critical Terms: Ely Rogd Fowler)। রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে বলেছেন, ঐতিহাসিক রসসৃষ্টি ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রাণ। ঐতিহাসিক ঘটনা, ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও ঐতিহাসিক রস-এই চতুর্থা পথেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের গতি ও পরাগতি।


সমালোচকরা বলেছেন, অরণ্যের অধিকার আদ্যন্ত ঐতিহাসিক উপন্যাস। মুণ্ডা বিদ্রোহের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে। বীরসাও ইতিহাস-বিশ্রুত নায়ক। তার সমগ্র জীবন-আখ্যানে ঐতিহাসিক সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে। ঐতিহাসিক কাল ও উপাদান সম্পর্কে মহাশ্বেতা দেবীও কৃতনিশ্চয়। “সাহিত্য বিচার ইতিহাস প্রেক্ষিত হওয়া দরকার। লেখকের লেখার সময় ও ইতিহাসের প্রেক্ষিত মাথায় না রাখলে কোন লোককেই মূল্যায়ন করা যায় না।"— (শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের কথা)। ঐতিহাসিক নজিরের জন্য লেখিকা গাথা, ছড়া, গান ও কিংবদন্তী সংগ্রহ করে যা পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছেন, তা ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। লোকসংস্কৃতি ও লৌকিক জীবনব্যবস্থার মধ্যে ‘the why and how of the peoples evolution" (যদুনাথ সরকার) পরিস্ফুট হয়। ‘অরণ্যের অধিকার’-এ মুণ্ডাদের জীবনযাত্রার মধ্যে যদুনাথ সরকার-উক্ত ঐতিহাসিক তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। মহাশ্বেতার দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষই ইতিহাসের স্রষ্টা। লোকবৃত্তের উপাদান থেকেই ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা হয়। ইতিহাস সেই লোকবৃত্ত বা জনবৃত্তেরই অন্বেষণ করে। মুণ্ডাবিদ্রোহের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে প্রতিবাদের দলিলীকরণ।


এই চিন্তাসূত্র থেকে বোঝা যায় যে 'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসে ইতিহাসের কাল ও উপাদান, ঐতিহাসিক রসের সন্ধান সবই একযোগে চলেছে। 'দিকু'-দের বিরুদ্ধে বীরসা পরিচালিত 'উলগুলানের' বিস্তার ও ব্যর্থতা, সংগ্রামের তীব্রতা সবই ঐতিহাসিক উপন্যাস লক্ষণে চিহ্নিত। 'ইতিহাস রস' এইভাবেই দিশা পেয়েছে, লোকবৃত্তের খননের মধ্যে দিয়া আদিবাসী সমাজের চিত্র ও চরিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। এই সব বিষয়বিন্যাসে ও নিয়ন্ত্রণে মহাশ্বেতা দেবী একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।


‘অরণ্যের অধিকার'-এর কাহিনী ইতিহাস রসে সিখিত। লেখিকার বর্ণনানৈপুণ্য বীরসার চেতনায় কিভাবে জনমন সক্রিয় হয়ে উঠেছে তার বর্ণনা সার্থকভাবেই করা হয়েছে। উপন্যাসের ঘটনাধারা সব ইতিহাসভিত্তিক। এই উপাখ্যানের কাহিনী লোকবৃত্তের কাহিনী। ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে যে 'উলগুলান' সংঘটিত হয়, তা ঐতিহাসিক বিষয়। মুণ্ডা সর্দারদের বিদ্রোহও এখানে উল্লেখ্য। 'অরণ্যের অধিকার' বর্ণিত উলগুলানের পশ্চাতে আছে শতাব্দীব্যাপী সংগ্রামের প্রস্তুতি। এসব ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গবেষণাপত্রের মত তিনি সনতারিখের ব্যবহার করেছেন। 'খুঁটকাটি' গ্রামের জমির অধিকার পুনরায় লাভ করার জন্য মুণ্ডারা আইনি লড়াই শুরু করে। মুণ্ডার এই আবেদন-নিবেদনের পালা বা আইনি লড়াই কয়েক দশক ধরে চালায়। তারপর ১৮৭৯, ১৮৮১, ১৮৮৬ ৮৭ এবং ১৮৮৯-৯০ সালে এই লড়াই ক্রমসঞ্চিত তীব্রতা লাভ করে। ১৮৮৯-৯০ খ্রিস্টাব্দে এই সংগ্রামের Climax-পূর্ব। খ্রিস্টান মিশনারিরা এই লড়াইয়ে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও শেষে তারা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এই মুলুক লড়াই 'অরণ্যের অধিকার' রেখাঙ্কিত আছে।


“ততদিনে সর্দাররা, মিশনের মুণ্ডারা বলছে মুলুকই লড়াইয়ের কথা। দশ বছর ধরে ওরা মুলুকই লড়াই চালাল। জেকব সাহেব ওদের হয়ে মিশনের সঙ্গে, সমবায়ের সঙ্গে কত লড়াই করল, জিতল না। মুলুকই লড়াই ধিমাধিমা চলতে লাগল।” আবার দেখা যায় “১৮৮৭-৮৮ সালের মধ্যে সরকারের সঙ্গে মিশনের কাটাকাটি হয়ে গেল।”


এই সব তথ্য দিয়ে এ সিদ্ধান্ত করা চলে যে সর্দারদের লড়াই লেখিকা যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা ইতিহাসস্মিত।


উপন্যাসটি বীরসা-কেন্দ্রিক। ১৮৯৫ সালে বীরসা প্রথমবারে কারাগারে যায়, ১৮৯৭ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৮৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবর বীরসার বিচার আরম্ভ হয়। বীরসা মুণ্ডাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে, এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাজরোষ। ঐতিহাসিক চরিত্রকে রূপায়িত করতে লেখকের দৃষ্টি ও স্পর্শের সতর্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উপন্যাসের নায়ক বীরসা ঐতিহাসিক চরিত্র, এছাড়া জগমোহন, করমি, সুগানা সবই ঐতিহাসিক চরিত্র। ইতিহাস বহির্ভূত চরিত্র জেকব, অমূল্য, ধানী। এই চরিত্র লেখকের কল্পনার সৃষ্টি।


বীরসা চরিত্র ইতিহাসরস ও মানবীয় অনুভূতির মিলনকেন্দ্র। ইতিহাসনিষ্ঠ এই চরিত্র মানবীয় গুণে পূর্ণ। বীরসা ঐতিহাসিক ব্যক্তি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে লিখেছেন, “মুণ্ডা অধিবাসীদের সবচেয়ে স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম শুরু হয় বীরসা মুন্ডার আবির্ভাবে। বিদেশী ইংরেজ শাসন, শোষণ এবং জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয়।” এই ‘চিরস্মরণীয় ব্যক্তিটি যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি এ বিষয়ে কোন তর্ক নেই। ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্যতম শর্ত যে ঐতিহাসিক চরিত্র-কে উপন্যাসের নায়ক করা প্রয়োজন, সেই শর্ত এখানে পূর্ণ হয়েছে। ইনি ইতিহাসের নায়ক বিদ্রোহী বীর, মুণ্ডাদের ‘ধরতি আবা'। বীরসার সংগ্রামপ্রিয়তা, দলগঠনের শক্তি, দিকু ও সরকারের সঙ্গে লড়াই সবই ঐতিহাসিক তথ্যসম্মত। কিন্তু সে শুধু আদর্শবাদী নেতা ও স্বদেশপ্রেমিকই নয়, সে মানবীয় গুণে পূর্ণ। বীরসার মানবীয় দুর্বলতাকে লেখিকা উপন্যাসের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন - “দেখতে দেখতে বীরসার চোখ কুয়াশায় ঢেকে গেল। ভগবান হতে হলে অনেক বড় দাম দিতে হয়। সে জীবনে কোন বরযাত্রা নেই, বাজনা বাজিয়ে মেয়েরা আমপাতায় জল ছিটিয়ে বরকে নামিয়ে নিয়ে চুমান' স্ত্রী আচার করে না।" বীরসাকে তেল-হলুদে স্নান করিয়ে কোনো কনের বাপ কোলে বসায় না। পাঁচ 'পঞ্চেশ' এসে বিয়ে দেয় না। এই বর্ণনা বীরসা চরিত্রের স্বাভাবিক বৃত্তির প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। সালী ও পরমী বীরসার দুই নারী সঙ্গিনী। বীরসার এই দুই নারীর প্রতি অনুভূতি উপন্যাসে সোচ্চার নয়, তারা বীরসার জীবনব্রতে সহায়ক হয়েছে।


উপন্যাসে কয়েকটি চরিত্র ইতিহাস বহির্ভূত—জেকব, অমূল্য ও ধানী মুণ্ডা। কিন্তু এই কাল্পনিক চরিত্র তিনটি উপন্যাসের পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। ধানী মুণ্ডা প্রবীণতর নেতা, লড়াকু মন তার সত্তার গভীরে। বীরসার মধ্যে ভগবান হবার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেছে। 'উলগুলানের' পরিবেশে সে শক্তিকেন্দ্র। তাই ঐতিহাসিক পরিবেশ সৃষ্টিতে এই চরিত্রাবলীর প্রয়োজন অসাধারণ। ইতিহাসের আকাশতলে পারিবারিক জীবনের চিত্র-এই সূত্র অনুযায়ী 'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের ইতিহাস অংশ ও পারিবারিক অংশ বিচার করা চলে। ইতিহাসের যে আলোড়ন হয়েছে, তাতে করমি সুগানার পরিবার, গয়ামুণ্ডার পরিবার, সালী ও পরমীর অস্তিত্ব সবই আন্দোলিত হয়েছে। উলগুলানের আহ্বানে বীরসাইতরা সব ছেড়ে ছুটে গেছে। সালীর ঐশ্বর্যময় জীবনও লুপ্ত হয়েছে, উলগুলানের ডাকে। সাধারণ মুণ্ডা পরিবারে সংগ্রামের অগ্নিগর্ভ মেঘ সঞ্চারিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতিহাসের বিরাট ভরঙ্গ এসে মুণ্ডা পরিবারকেও অভিঘাতে বিপর্যয়ে আহত করেছে।