'অন্তঃসলিলা' গল্পটির ছোটোগল্প হিসাবে সার্থকতা বিচার করো।

সাবিত্রী রায়ের 'অন্তঃসলিলা' গল্পটি বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় গল্প না হলেও নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলা সাহিত্যে এটি একটি সার্থক ছোটোগল্পের উদাহরণ। ছোটোগল্পের চরিত্রলক্ষণ সার্থকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে গল্পটির ভাববস্তুর বিন্যাসে এবং গঠনকলায়। ছোটোগল্পের প্রাথমিক বহিরঙ্গ লক্ষণ যদি হয় সংক্ষিপ্ততা, তাহলে ‘অন্তঃসলিলা' গল্পটিকে অবশ্যই ছোটোগল্প বলতে হবে। কেননা গল্পটির পরিসর ছয় পৃষ্ঠার কিঞ্চিৎ বেশি। তা ছাড়া স্থান ঐক্য ও কাল ঐক্যের দিক থেকেও এ গল্প সংহত। কফিহাউস এবং শকুন্তলা দেবীর বাড়ি—এই দুটি মাত্র স্থান পরিসরে সমগ্র গল্প উপস্থাপিত। কালের দিক থেকে এক সকাল থেকে পরবর্তী সকাল পর্যন্ত গল্পটির সময়বিস্তার। চরিত্র সংখ্যার বাহুল্যহীনতা ছোটোগল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। ছোটোগল্পে অপ্রয়োজনীয় চরিত্র এবং ঘটনা বর্জনীয়। ‘অন্তঃসলিলা' গল্পে মূল চরিত্র শকুন্তলা এবং শকুন্তলাকে যার অভিজ্ঞতাসূত্রে দেখানো হয়েছে, সেই দেবব্রত ছাড়া আরও অনেকগুলি চরিত্র এলেও সেগুলি একান্তভাবে স্কেচধর্মী। প্রত্যক্ষ চরিত্রগুলি হল শিবনারায়ণ ব্যানার্জী, রঞ্জন রায়, প্রফেসর সেন, শকুন্তলার কন্যা, দেবর সুকু, শকুন্তলার ভাই সুব্রত। এ ছাড়া নেপথ্যচারিণী দুটি চরিত্র শকুন্তলার শাশুড়ি ও এক প্রাচীনা প্রতিবেশিনী। কিন্তু চরিত্রগুলি এত সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত যে সার্বিকভাবে শকুত্তলাসর্বস্ব গল্প বলেই ‘অন্তঃসলিলা’কে চিহ্নিত করা চলে।


কিন্তু এই সংক্ষিপ্ততা ছোটোগল্পের একান্তই বহিরঙ্গ লক্ষণমাত্র। ছোটোগল্পের আসল আত্মা নিহিত থাকে ভাবনার দৃঢ় সংহতিতে ও একমুখী পরিণামের তীব্র গতিতে। এই দিক থেকেও 'অন্তঃসলিলা'কে সার্থক ছোটোগল্প বলে স্বীকার করতে হবে। এই গল্পে বিংশ শতাব্দীর কলকাতার নাগরিক সমাজে আপাত শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার আবহেও কেমনভাবে নারীকে সামন্ততন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের উপেক্ষা ও পীড়ন সাংসারিক ক্ষুদ্র পরিসরে সন্তান উৎপাদন ও শ্রমযন্ত্র হিসাবে আবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেটিই ভারহীন বাহুল্যহীনভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন সাবিত্রী রায়।


প্রফেসর সেনের স্ত্রী শকুন্তলা দেবী বৃহৎ সংসারের প্রাত্যহিক বোঝা ঠেলেও সাহিত্যসাধনা করেন, এখানেই তাঁর অসামান্যতা। কয়েকটি পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত ও সাহিত্যরসিকদের প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু একজন নারীর এই সাহিত্যচর্চাকে তেমন গুরুত্ব দেন না শিবনারায়ণ ব্যানার্জীর মতো লেখকেরা। তাঁদের মতে— “মেয়েদের লেখা আবার উপন্যাস!” সাহিত্যক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পুরুষতন্ত্র কেমনভাবে নারীকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে, শিবনারায়ণের এই মন্তব্য তা উদ্ঘাটিত করে। দেয়। গল্পের পরবর্তী স্তরে আমরা দেবব্রতর চোখ দিয়ে দেখি শকুন্তলা দেবীর বাড়ির গলিতে প্রবেশ করেই অনুভব করে এক বিরুদ্ধ আবহ। সরু অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর এই গলির ভিতরে শকুন্তলা দেবীর মতো সম্ভাবনাময়ী লেখিকার বাস, তা ভাবতে কষ্ট হয় দেবব্রতর। ৮/৭বি ঠিকানার সেই বাড়িটিতে পৌঁছেও স্পষ্ট হয় একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরই ছবি। বাড়িটির মধ্যে একাধিক পরিবারের বসবাস। শকুন্তলা দেবী তথা প্রফেসর সেনের একটিমাত্র ঘর সে ঘরেই একটি পর্দা টাঙিয়ে অন্তঃপুরকে পৃথক করা হয়েছে। স্তূপীকৃত বালিশ জানিয়ে দিচ্ছে বাড়ির অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ঘরে টাঙানো দেবদেবী ও গুরুদেবের ছবি একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের রক্ষণশীলতার পরিচয় বহন করছে। আর স্তূপীকৃত বইপত্র বলে দিচ্ছে পরিবারটির সঙ্গে শিক্ষা-সাহিত্যের সংযোগ। গলির পরিবেশ এবং ঘরের অপ্রশস্ততা জানিয়ে দেয় শকুন্তলা দেবীর লেখকজীবনের পক্ষে পরিবেশগত প্রতিকূলতা।


পর্দার ওপার থেকে অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের যে সমস্ত কথারার্তা দেবব্রত শুনতে পায়, সেই সংলাপগুলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় সাংসারিক ব্যস্ততা, প্রাচীনাদের স্বভাবসুলভ নানা অভিযোগ-অনুযোগ, বিশেষ করে বাড়ির বধূটির সাহিত্যবিলাসের প্রতি তাঁদের তীব্র বিরাগ ও বিরুদ্ধতা। অন্তঃপুরের সম্ভাব্য শাশুড়িটির বিভিন্ন অনুযোগের মধ্যে অন্যতম এই বয়সেও ঈশ্বরচিন্তা না করে তাঁকে চাল বাছতে হয়। বলে, সংসারের খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে। কিন্তু নেপথ্যের সেইসব সংলাপের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, ঘরের নীরব বধূটি রন্ধনকর্মে ব্যস্ত। শিশুকন্যার কান্না থামাতেও প্রাচীনা বধূকেই ডাক দেন। শিশুটির প্রতি তার মায়ের অমনোযোগের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে সেই প্রাচীনা শাশুড়ি তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত করেন বধূটির সাহিত্য-অনুরাগের প্রতিই—“বিদ্বান ছেলের বিদুষী বৌ।”


এই সাংসারিক দায়িত্ব, ব্যস্ততা এবং প্রাচীনাদের বিরুদ্ধতার মধ্য থেকে একসময় শকুন্তলা দেবী অন্তঃপুর থেকে সাক্ষাৎপ্রার্থী দেবব্রতর সামনে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর হাতে মশলা বাটার চিহ্ন। চোখে-মুখে অন্তঃপুরের অনভিপ্রেত মন্তব্যগুলির জন্য কুণ্ঠা ও লজ্জা। সেইসঙ্গে শিশুকন্যাটির অসুস্থতার কারণে তীব্র উদ্ভবেগ। আমরা বুঝতে পারি, অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের অভিযোগগুলি অন্তঃসারহীন। কেননা, শকুন্তলা দেবী সাংসারিক যাবতীয় দায়িত্বগুলিই নিঃশব্দে পালন করে চলেছেন। রন্ধনকর্ম, পারিবারিক সদস্যদের সেবা ও পরিচর্যা, পরিবেশন, শিশুর পরিচর্যা, কাঁথা কাচা, শাশুড়ির আতপচাল রান্না—সমস্তই তাঁর নিত্যকর্ম। এ ব্যাপারে কোনো অনুযোগ বা অভিযোগও হয়তো শকুন্তলা দেবীর নেই। কিন্তু তবু তিনি এরই ফাঁকে লেখালেখির চর্চা করেন বলেই বোধহয় প্রতিমুহূর্তে শকুন্তলার প্রতি ছিটকে আসে বিদ্বেষভরা নানা মন্তব্য। অগোছালো কাগজপত্রের স্তূপ থেকে নির্দিষ্ট রচনাটিকে খুঁজতে গিয়ে এক ভয়ংকর আশঙ্কা প্রকাশিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে—“পুড়িয়েই ফেলল নাকি ওরা উনুন ধরাতে।” দেবব্রতর কাছে প্রকাশিত হয়, শকুন্তলা দেবীর সাহিত্যসাধনার প্রতি তাঁর পারিবারিক উপেক্ষা, চূড়ান্ত ঔদাসীন্য ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব। এরপর গল্পের খাতাটি খুঁজে পাওয়া গেলে দেবব্রত দেখতে পায়, লেখবার উপযুক্ত খাতা বা কাগজও পান না শকুন্তলা। ছেলেবেলার লাল হয়ে যাওয়া হাতের লেখা অনুশীলনের পুরোনো খাতাতেই গল্পটি তাই লিখতে হয়েছে শকুন্তলাকে।


এহেন বিদ্বেষ কুটিল পরিবেশেও শকুন্তলার চারিত্রিক স্নিগ্ধতা, সৌজন্যবোধ, সংসারের হাজার ঝামেলায় কর্তব্যবুদ্ধি বা আতিথেয়তা কোনোটিই হারায়নি। আমরা তাঁর ব্যস্ততাটি বুঝি, যখন দেখি অফিসের ভাত রান্নার মাঝেই তাঁকে অসুস্থ মেয়ের কান্না সামলাতে হয়, কাঁথা কাচতে গেলে ডাল পোড়ে। কিন্তু তারই মধ্যে ঠিক বড়োমেয়ের হাতে দেবব্রতর কাছে পৌঁছে যায় চায়ের কাপ। পাণ্ডুলিপি দেবার কথা দিয়েও মেয়ের অসুস্থতার জন্য গল্পের নকল করে রাখতে পারেননি বলে দুঃখপ্রকাশটিও তাঁর সৌজন্যবোধেরই পরিচায়ক।


শুধু বাড়ির প্রাচীনারাই নন, শকুন্তলা দেবীর দেবরও তার বৌদির সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যজগতের অন্যান্য অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রতি তীব্র শ্লেষাত্মক ও কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে—“গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই আবার গল্পের নায়িকা হয়ে প'ড়ো না যেন।” এর থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর স্বামী অধ্যাপক সেনের নিরুত্তাপ উদাসীনতা। শকুন্তলার নতুন গল্পটি পড়েছেন কি না দেবব্রত জানতে চাইলে অধ্যাপক সেনের মন্তব্য—“গল্পটল্প পড়ার কি আর ফুরসত আছে।...এককালে ছিল ওসব সাহিত্য-টাহিত্যের উৎসাহ।"


বাইরের সমাজে এবং ঘরে প্রতিনিয়ত এইভাবে বাধাগ্রস্ত ও উপেক্ষিত হয় শকুন্তলার সাহিত্যসাধনা। শকুন্তলার প্রতি রক্ষণশীল প্রাচীনা শাশুড়ির সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব এবং আপাতভাবে সমাজের অগ্রগণ্য স্তরের অধ্যাপক স্বামী ও দেবরের পশ্চাৎপদ পুরুষতান্ত্রিক উপেক্ষা ও তির্যক দৃষ্টি অসামান্য সংক্ষিপ্ততায় অথচ অব্যর্থ ব্যঞ্ছনায় উপস্থাপিত করেছেন সাবিত্রী রায়। অনেকগুলি অপ্রধান চরিত্রের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় সমাজ-সংসারের একটি সামগ্রিক চেহারা লেখিকা সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। ভারহীন, বাহুল্যহীন একমুখী সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ও সংলাপে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংসারের স্বরূপটিকে যেভাবে সার্থকভাবে উপস্থাপিত করেছেন সাবিত্রী রায়, তাতে ‘অন্তঃসলিলা' গল্পটিকে অবিতর্কিতভাবে একটি সার্থক ছোটোগল্প হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।