'মেঘমল্লার' গল্পে দেশ-কাল-সমাজ কিভাবে চিত্রায়িত হয়েছে তা আলোচনা করো।

বিভূতিভূষণের প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'মেঘমল্লার' ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থেরই বিশিষ্ট গল্প ‘মেঘমল্লার'। এই গল্পটির প্রথম প্রকাশ 'প্রবাসী' পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩০ সংখ্যায়।


স্বভাব-রোমান্টিক বিভূতিভূষণ প্রাচীন যুগ বিশেষত ইতিহাসাশ্রিত রোম্যান্টিক গল্প রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর 'অভিশপ্ত', 'প্রত্নতত্ত্ব', 'নাস্তিক', 'মেঘমল্লার' প্রভৃতি গল্প এই কথার সত্যতাকেই স্বীকৃতি দান করে।


সুপ্রাচীন বৌদ্ধযুগ, ইতিহাস, রোমাঈময়তা, প্রেম, নিসর্গ এবং সর্বোপরি কল্পনাকে আশ্রয় করে ‘মেঘমল্লার'-এর কাহিনী গড়ে উঠেছে। প্রাচীন বৌদ্ধযুগ ও তান্ত্রিকযুগের 'কাল'কে পটভূমি করে গল্পটির ভিত্তি রচিত হয়েছে।


বৌদ্ধযুগের শেষপাদ-ই গল্পে চিত্রিত হয়েছে। গৌতমবুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম দীর্ঘকাল ভারতবর্ষের প্রধান ধর্ম হিসেবে বিবেচ্য হয়েছিল। মগধ, বৈশালি, শ্রাবস্তি, বিদিশা প্রভৃতি প্রাচীন জনপদগুলি বৌদ্ধধর্মের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম জনপদ ছিল মগধ। সেখানকার রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণ পর্যন্ত সবাই এই নতুন ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন। এই বৌদ্ধযুগের শেষ সময়ই চিত্রিত হয়েছে এই গল্পে।


গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি দশপারমিতার মন্দিরের উল্লেখ। এই দশপারমিতার প্রধানা দেবী হলেন ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। প্রখ্যাত দার্শনিক হাইনরিশ জিমার মনে করেন, 'পারমিতা' হলেন ‘Highest virtues of perfections.' মহাযান বৌদ্ধদের বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ‘বুদ্ধত্ব' আছে, তার মধ্যে শক্তি আছে নিজেকে ‘সম্যক-সম্বুদ্ধ’ করে তোলার। প্রয়োজন গভীর সাধনা যার সাহায্যে সে তার নিজের অন্তরের শক্তিকে জাগ্রত করে ‘পারমিতা’র উন্মেষ ঘটিয়ে বোধিচিত্তকে লাভ করতে সক্ষম হবে। এদের মধ্যে 'প্রজ্ঞা' হল প্রধান, অন্যান্য পারমিতা এর পরিবার বিশেষ।


গল্পে দশপারমিতার মন্দির প্রাঙ্গনে শুরুতেই সাপুড়ের খেলা দেখবার জন্য জনসমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। গল্পের নায়ক প্রদ্যুম্নও সাপুড়ের খেলা দেখবার জন্য ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে হঠাৎ গায়ক সুরদাসের দেখা পেয়েছে। গল্পে এই গায়ক সুরদাসকে কেন্দ্র করে জমাট বাঁধে অপার কৌতূহল। পারমিতার পুজোর সময় জ্যৈষ্ঠমাসের সংক্রান্তি। কিন্তু এর মধ্যে ‘সাপুড়ে’ প্রসঙ্গ চলে আসে কেন? মনে রাখতে হবে প্রদ্যুম্ন ভালো বীণ বাজিয়ের সন্ধানে ছিল। সর্পদের বশ করার জন্য যে বীণ অপরিহার্য তা সবাই জানে। এই 'সাপুড়ে' প্রসঙ্গে বলা যায় যে বৌদ্ধদর্শনের অনুষঙ্গে পাখি-পশু-সর্প-সমস্তই মানুষের সঙ্গে এবং পারস্পরিক জীবজাতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে যুক্ত। 'জাতক কথা’য় বোধিসত্ত্ব পক্ষী, নকুল, গরুড়, মৎস্য, কচ্ছপ, গৃধ্ন, কুম্ভীর ইত্যাদি নানা জীবের রূপধারণ করেছিলেন— এটাই তার প্রমাণ।


কিন্তু ‘সাপুড়ে’ শব্দের উল্লেখে যে লৌকিক তন্ত্র মন্ত্র পূজার্চনার ঐতিহ্য যুক্ত হয়ে যায় তা মহাযান ধর্মের প্রতিষ্ঠার যুগে লক্ষণীয়। সুতরাং বলা যেতেই পারে বৌদ্ধযুগের যখন অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে তখনই এই গল্পের কাহিনীর নির্মাণ হয়েছে। এই কাল পরিধিতে ভারতবর্ষে বিশুদ্ধ বুদ্ধমত প্রাঞ্জলতা হারিয়েছে।


‘মেঘমল্লার' গল্পে কাল নির্ণয়ের একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেল। এই গল্পে কিছু প্রাচীন জনপদের নামোল্লেখ দেখা যায়।


গল্পের শুরুতেই দশপারমিতার মন্দিরে প্রদ্যুম্ন যখন গায়ক সুরদাসের সঙ্গে দেখা করে তখন সুরদাস তাকে বলে—“আমি অবন্তীর গাইয়ে সুরদাস।"


আমরা যদি গল্পের ঘটনাক্রম অনুসরণ করি তাহলে দেখতে পাব সুরদাস একজন তন্ত্রসাধক। তার আসল নাম গুণাঢ্য। সে মোটেই গাইয়ে নয়। কিন্তু গল্পের প্রথমে বলা এই অংশে অবস্তী নামে এক জনপদের নাম পাই। Encyclopedia Britannica (-"Avanti-kingdom of ancient India, in the territory of present day Madhyapradesh State, Northern India. Located on the overland trade routes between northern and Southern India. Its capital was at Ujjain. It flourished in the 6th-4th century BC as one of the great powers of northern India.” সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে প্রাচীন ভারতে অবন্তী এক উল্লেখ্য জনপদ ছিল। ষোড়শ মহাজনপদ-এর একটি হল এই রাজ্য। এর রাজধানী উজ্জয়িনী। বর্তমান ভারতে এটি মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্গত। Britannica'-তে বলছে এর উৎকর্ষ হয়েছিল অর্থাৎ এই অবন্তী রাজ্যের সমৃদ্ধির সময় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে ৪০০ অব্দ পর্যন্ত। তারপরেও আমরা গুপ্তযুগেও উজ্জয়িনীর সমৃদ্ধির খবর পাই। বিক্রমাদিত্য কিংবা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে উজ্জয়িনী সমৃদ্ধির শিখরে ওঠে। এখানে হিন্দুধর্মের প্রসার তো ঘটেইছিল তার পরে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মও প্রসার লাভ করে। অবস্তীনগরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ও প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে এখানে বৌদ্ধধর্ম, দর্শন ও শিক্ষা বিশেষভাবে কার্যকরী হয়েছিল।


এছাড়াও এই গল্পে বিদিশা নগরীর নাম পাই। বিদিশাও এখন মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্গত। মগধ-এর নামও পাই এই গল্পে। মগধ যে বিহার রাজ্যের অন্তর্গত তা আমরা জানি। মগধের রাজধানী প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত পাটলিপুত্র নগর। Britannica তে আছে— "Magadha was a ancient kingdom, in India.... An important kingdom in the 7th Century BC, it absorbed the kingdom of Anga in the 6th century BC Pataliputra (Patna) was its capital. Its strength grew under the Nanda dynasty; under the Mauryan dynasty (4th-2nd centuries BC) it comprised nearly the entire Indian subcontient. ....It was the Scene of many events in the life of Buddha."


সুতরাং মগধে ষোড়শ মহাজনপদের নন্দবংশের অবস্থান যেমন দেখতে পাই তেমনি মৌর্য যুগে এর বিপুল সমৃদ্ধি ঘটে। গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।


এছাড়াও এই গল্পে কাঞ্ঝী, তক্ষশীলা, কোশল প্রভৃতি প্রাচীন জনপদের নাম পাই। এর বর্তমানে কাঞ্চী দক্ষিণভারতে, কোশল উত্তর ভারতে এবং তক্ষশীলা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত।


আর একটি স্থানের নাম আমরা পাই তা হল 'কাশী'। উত্তর ভারতের এই প্রসিদ্ধ জনপদ বারাণসী নামেই অধিক পরিচিত। এখানে গল্পের নায়ক প্রদ্যুম্নর আবাসস্থল। তার পিতা কাশীর বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ইন্দ্রদ্যুম্ন হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ ও জৈন প্রায় সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র এই বারাণসী। পৃথিবীখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির, জ্ঞানব্যপী মসজিদ, সারনাথ প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্রই এর প্রমাণ। বারাণসী যে সঙ্গীতেরও জায়গা তা আমরা জানি। বিভিন্ন শাস্ত্রীয়, ধ্রুপদী, খেয়াল, হিন্দুস্থানী রাগসংগীতের পীঠস্থান হল কাশী। সুতরাং ইন্দ্রদ্যুম্ন ও তাঁর পুত্র প্রদ্যুম্ন যে স্থান মাহাত্ম্যে সংগীত রসে আচ্ছন্ন তা বলাই যায়।


এছাড়া পাই ভদ্রাবতী নদীর তীরে শাল-পিয়াল-তমাল বনে ঘনঘোর বর্ষা আগমনের চিত্র। মনে পড়ে মহাকবির রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'-এর দৃশ্য। সেই অসাধারণ কাব্যেও শকুন্তলার বেড়ে ওঠা কণ্বমুনির আশ্রমও শাল-পিয়াল ও তমাল বনে ঘেরা। সেই অতি শান্ত তপোবন এবং তার সন্নিকটে বয়ে যাওয়া মালিনী নদী হয়ত এই গল্পে ভদ্রাবতী হিসেবে ধরা দিয়েছে। আর তপোবনে যে বর্ষা তার আগমনবার্তা ধ্বনিত করত তার ইঙ্গিত আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকালীন গ্রন্থ 'শকুন্তলা'য়—'বর্ষায় ময়ূর নাচত'। মহাকবির চেতনায় যে তপোবন সেটি মধ্যভারতেরই কোন গহন অরণ্য। আর গল্পের ভদ্রাবতীর তীরে গহন অরণ্য ও ভারতের মধ্য অঞ্চলেরই কোন অরণ্য এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।


‘মেঘমল্লার’ গল্পে তৎকালীন সমাজও ছায়া ফেলেছে অনবদ্য লেখনীমাধুর্যে। এই গল্পটি রোমান্টিক তথা কল্পনাপ্রবণ হলেও ধূসর অতীতের সমাজ খুব সুন্দরভাবেই চিত্রিত হয়েছে এখানে।


দশপারমিতার মন্দিরে পুজো এবং সেখানে প্রদ্যুম্নর সঙ্গে সুরদাসের আলাপের মধ্য দিয়ে গল্পের সূচনা। সেখানে আমরা দেখি মেয়েদেরও ভিড়। গ্রামের মেয়েরাও ভিড় করে সেখানে সাপুড়ের খেলা দেখতে এসেছে। সেখানে আমরা প্রদ্যুম্নর প্রিয়া সুনন্দাকেও আসতে দেখি। তাদের দুজনের দেখাও হয়। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ সে সময়কার কথোপকথন আমরা কিছুটা লক্ষ্য করি— 


“সুনন্দা বললে—বাবা তিন চার দিন হল কৌশাম্বী গিয়েছেন মহারাজের ডাকে।

প্রদ্যুম্ন হঠাৎ খুব উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল, বলল–ওহো তাই, নইলে আমি ভাবছি এত রাত পর্যন্ত সুনন্দা কি-

সুনন্দা তাড়াতাড়ি প্রদ্যুম্নের মুখে নিজের হাতদুটি চাপা দিয়ে লজ্জিত মুখে বললে–চুপ, চুপ, তোমার কি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই? এখুনি যে সব আরতি দেখে লোক ফিরবে!"


এই অংশটুকু পাঠ করে আমাদের মনে হয় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পর একজন তরুণ এর সঙ্গে আর এক তরুণীর মেলামেশা সে সময় অবাধ ছিল না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি প্রাচীন ভারতে বৈদিক কিংবা পুরাণ যুগে নারী আপন স্ব-মহিমায় প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি নারীরা রীতিমত তর্কযুদ্ধে নেমে পুরুষদের পরাজিত করেছিলেন। দ্রৌপদী অবলীলায় পঞ্চস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন কারণ পর্দাপ্রথা তখন ছিল না। নারীরা স্বয়ম্বরা ছিলেন। নিজেই স্বামী নির্বাচন করতেন। কিন্তু সুনন্দার ক্ষেত্রটা বুঝতে গেলে, আমাদের ‘কাল’ টাকে মাথায় রাখতে হবে। গল্পের সময় কাল বৌদ্ধযুগ। শুধুমাত্র বৌদ্ধযুগ নয় এই যুগের একেবারে শেষ দিকে–সুতরাং তখন অনেক বৈদেশিক আক্রমণ ঘটছে, নানারকম তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনা শুরু হচ্ছে দেশীয় রাষ্ট্রগুলি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে গুপ্তবংশের দাপটও আর সেরকম নয় এ সময় নারীর স্থান কিছুটা হেয় হয়েছিল। পুরুষের পাশাপাশি তাদের সমানাধিকারের ব্যাপার কিছুটা খর্ব হয়েছে। তাইজন্যই সুনন্দা এই উক্তি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিষ্পাপ এক তরুণীর অপবাদের ভয়েই এই উক্তি।


বৌদ্ধবিহারে বৌদ্ধধর্মমত, দর্শন নানা মার্গ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান বিতরণ করা হত। খুব কঠোর অনুশাসনের মধ্যে শিক্ষার্থী শিখে নিত বুদ্ধমতের খুঁটিনাটি। অষ্টাঙ্গিক মার্গের উন্নত পথে বিচরণ করতে করতে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠত শুদ্ধ পবিত্র নিষ্পাপ এক মানবাত্মা। প্রাচীন ভারতে মূলত বিহার রাজ্য ও উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এরকম অসংখ্য বৌদ্ধবিহার। এরমধ্যে বিক্রমশীলা মহাবিহার, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গদেশের সমতটের বিহারটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ ছিল। আচার্য শীলভদ্র, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তৎকালীন যুগের বিশিষ্ট বৌদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন।


অনুশাসন এখানে খুব কড়া হলেও বৌদ্ধযুগের অবক্ষয়ের সময় আচার্যদের মধ্যে প্রশাসক অবস্থার কিছুটা হানি ঘটেছিল। না হলে সন্ধ্যারাতের পরেও কিংবা আরও অনেক সময় প্রদ্যুম্নর ওপরে তেমন শাসন দেখা যায় না। প্রদ্যুম্ন বিহার থেকে নির্দ্বিধায় বের হতে পেরেছে। সমাজের অবক্ষয়ের চোরা স্রোত যে বিহারেও ঢেউ তুলেছিল তা পরিষ্কার।


বৌদ্ধযুগে নারীরাও শ্রমণ হতে পারতেন। তার বড় প্রমাণ বুদ্ধদেন পত্নী যশোধরা, সুজাতা কিংবা বৈশালির নটী আম্রপালীও শ্রমণ গ্রহণ করে বুদ্ধদেবের শিষ্যত্বে বরণীয় হয়েছেন। এই গল্পেও আমরা দেখি শ্রেষ্ঠী সংস্তদাসের কন্যা সুনন্দা শ্রমণ হয়েছে সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছে সংসারের সুখশয্যা ত্যাগ করে।


গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত নতুন এই ধর্মমত প্রতিবাদী আন্দোলন হিসেবে খ্যাত। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা হিন্দুধর্মের প্রতি এক তীব্র প্রতিবাদ ছিল এটি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সামাজিক স্তরে আলোড়ন ও পরিবর্তনের তরঙ্গ এনে দিয়েছিল এই নব ধর্মমত। রাজনৈতিক স্তরে পরিবর্তন ঘটলো—যেখানে বৈদিক যুগে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল উত্তর-পশ্চিমে তেমনি এ যুগে পূর্ব থেকে আরও পূর্বে সরে আসছে তা। গান্ধার-মদ্র-কুরু পাঞ্চালের জায়গায় কোশল-বৈশালী-মগধ, পুরোনো সাম্রাজ্যবাদের নীতির সঙ্গে ঘটছে নতুন মৈত্রী-ভাবনার সংঘাত।


অর্থনৈতিক স্তরেও পরিবর্তন এলো-ক্ষমতার প্রতিসরণ ঘটছে শ্রেণীবিন্যাসেও। ধনই তখন হয়ে উঠছে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস। বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রজীবী এবং শাস্ত্রজীবীদের পিছনে রেখে উঠে আসেন বণিক ও ধনজীবীরা।


গল্পে আমরা এভাবেই দেখি সুনন্দার পিতা ধনী শ্রেষ্ঠী। তখনকার দিনে শ্রেষ্ঠীদের ভূমিকা রাজার মতোই ছিল। গৌতমবুদ্ধকে অনেক শ্রেষ্ঠী সাহায্য করেছেন। 'জাতক' কাহিনীতে ‘শ্রেষ্ঠী জাতক' বলে বোধিসত্ত্বের একরূপও লক্ষণীয়। গল্পে সুনন্দার পরিচয়ে তাই বলা হয়েছে— “সে হিরণ্যনগরের ধনবান শ্রেষ্ঠী সামস্তদাসের মেয়ে।”

বৌদ্ধধর্ম সামাজিকস্তরেও প্রভাব ফেলেছিল। বৃহত্তর জনজীবনে কৃষিজীবী, বৃত্তিজীবী, ভূম্যধিকারী নাগরিক, ছোট ব্যবসায়ী, কবি, নটী, দাস প্রমুখের ক্ষেত্রে চলছিল শাশ্বত জীবনচর্যা। তবু তার মধ্যেও পরিবর্তনের সূক্ষ্ম আঁচড়টি রয়েই গিয়েছিল।


তন্ত্রচর্চা 'মেঘমল্লার' গল্পের একটি প্রধান বিষয়। সুরদাস ওরফে গুণাঢ্য তন্ত্রবলে দেবী সরস্বতীকে নিজ ক্ষমতায় কুক্ষিগত করেছিলো।


আমরা তন্ত্র চর্চার ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করব। 'বাংলার তন্ত্রসাধনা' শীর্ষক প্রবন্ধে (উদ্বোধন ১০০ : শতাব্দীজয়ন্তী নির্বাচিত সংকলন) স্বামী হিরন্ময়ানন্দ বলেছেন যে প্রাচীন ভারতে যাগ, যজ্ঞ, ক্রিয়া, মতবাদ, তত্ত্ব, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বোঝানোর জন্য 'তন্ত্র' শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। সাংখ্যদর্শনের গ্রন্থাদির নাম ছিল 'যষ্টিতন্ত্রশাস্ত্র।" সেইভাবে ন্যায়তন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, ব্রষ্মতন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু কালক্রমে ‘তন্ত্র' শব্দের সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে প্রয়োগ দেখা যায়।


স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ বহু মনীষীর মতে বৌদ্ধরাই তন্ত্রের স্রষ্টা। হিন্দু সমাজ চিরদিনই বহিঃসংস্পর্শ ব্যবার্তক। কাজেই হিন্দুধর্মের বা সমাজের মধ্যে আতের মতো অনুপ্রবেশ সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু নবীন বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রচারধর্মী। বহু নব নব জাতি তাদের আচার ব্যবহার, সংস্কৃতি পরিবহন করে বৌদ্ধধর্মে অনুস্যূতি লাভ করে। এই সুযোগে তাতার, মঙ্গল প্রভৃতি জাতিও বৌদ্ধধর্মের কুক্ষিগত হয়। নবদীক্ষিত এইসব অনার্যজাতির বহু আচারব্যবহার এইভাবেই বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ লাভ করে।


বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা নৈতিকতার দৃঢ়ভূমির ওপর। সর্বপ্রকার গৃহ্যসাধন বা বিস্তৃতি লাভাদির বিরোধী ছিল এই ধর্ম। কিন্তু বহির্ভাবধারার অনুস্যুতির ফলে নানা ক্রিয়াকলাপ, বিভূতি প্রভৃতির অনুপ্রবেশ বৌদ্ধধর্মে ঘটে। খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর গ্রন্থ 'মাঞ্জুশ্রীমূলকল্প' পাঠে দেখা যায় কিভাবে ক্রিয়াকলাপাদি ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করেছিল।


এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বৌদ্ধসংঘের ভিতর ‘একাভিপ্পায়ী' বলে একটি মতবাদের অভ্যুত্থান হয়। বুদ্ধশিষ্য আনন্দের আবেদনে বুদ্ধদেব ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্ঘে নারীজাতির স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কঠিন বিধিনিষেধের দ্বারা সংঘস্থ স্ত্রী পুরুষের মেলামেশাকে নিয়ন্ত্রিতও করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও প্রকৃতির সহজপ্রবণতা বিধিনিষেধের দ্বারা অবদমিত হয় নি। এরই ফলে এবং নবদীক্ষিত জাতিসমূহের অনৈতিক প্রথার সংমিশ্রণে একাভিপ্পায়ী মতের উদ্ভব। এই মতবাদে স্ত্রী-পুরুষের সাহচর্যে নিশাকালে নানারূপ গৃহ্যসাধনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের বৌদ্ধগ্রন্থ গুহাসমাজতন্ত্রে বামাচার তন্ত্রের সকল লক্ষণই পাওয়া যায়। এর অষ্টাদশ অধ্যায়ে প্রজ্ঞাভিষেকের উল্লেখ আছে। এই প্রজ্ঞাভিষেকের মূলকথা শক্তিগ্রহণ। গুরু, শিষ্যের অভিলষিতা সুন্দরী, যোগপারদর্শিনী শক্তির সঙ্গে শিষ্যকে মিলিত করবেন। এই বিদ্যাগ্রহণ বা শক্তিগ্রহণ ব্যতিরেকে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির অন্য উপায় নেই। যখন বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল তখন পূর্বোক্তহীন বৌদ্ধতান্ত্রিক আচার হিন্দুধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে হিন্দুতন্ত্রের সৃষ্টি করেছিল।


গল্পেও আমরা দেখি মহাকোট্‌ঠি বিহারের আচার্য-পূর্ণবর্ধন প্রদ্যুম্নকে বলেছেন— “পদ্মসম্ভব আর তার কতকগুলো কাণ্ডজ্ঞান হীন তান্ত্রিক শিষ্য দেশের ধর্মকর্ম লোপ করতে বসেছে।”


আচার্যের এই উক্তিতে পরিষ্কার হয়ে যায় বৌদ্ধধর্ম থেকেই তন্ত্রসাধনার সৃষ্টি কারণ—অষ্টম শতকের আচার্য শ্মশানচারী যোগাচারপন্থী তান্ত্রিক পদ্মসম্ভব পূর্বভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে নালন্দায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর কুড়িজন শিষ্য ছিলেন তান্ত্রিক কার্যকলাপে বিশেষ পারদর্শী। এইরকম এক শিষ্যই যে গল্পের গুণাঢ্য তা বুঝতে পারা যায়। এই শিষ্যই সরস্বতীকে হীন তন্ত্রাচারের মাধ্যমে বন্দিনী করতে প্রদ্যুম্নর সাহায্য চেয়েছিল। আচার্য পূর্ণবর্ধনের বলা কাহিনীতে গুণাঢ্যের উদ্দেশ্য বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়— “এই গুণাঢ্য একবার অবন্তীর প্রসিদ্ধ গায়ক সুরদাসের সঙ্গে ওই ঢিবিতে উপস্থিত ছিল। সুরদাস মেঘ মল্লারে সিদ্ধ ছিলেন। তাঁর গানে নাকি সরস্বতী দেবী তাঁর সম্মুখে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলেন।....তারপর দেবী যখন গুণাঢ্যকে বর প্রার্থনার কথা বলেন, তখন সে দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই প্রার্থনা করে বসেন। সরস্বতী দেবী বলেছিলেন, তাঁকে পাওয়া নির্গুণের কাজ নয়, সে নামে গুণাঢ্য হলেও কার্যও তার এমন কোনো কলাতেই নিপুণতা নেই যে তাঁকে পেতে পারে।.....সরস্বতী দেবী অন্তর্হিত হওয়ার পর মূর্খ গুণাঢ্যের মোহ আরও বেড়ে যায়, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে দেবীর উপর তার অত্যন্ত রাগ হয়। সে তন্ত্রোক্ত মন্ত্রবলে দেবীকে বন্দি করবার জন্য উপযুক্ত তান্ত্রিক গুরু খুঁজতে থাকে।"


হিরন্ময়ানন্দ-এর কথাতে যে বামাচার ও গুহ্যসাধনার কথা বলা হয়েছে গুণাঢ্য সেই তন্ত্রেরই এক সাধক। সে হীনতন্ত্র বলে মদ্য-মাংস উপচারে দেবী সরস্বতীকে বশীভূত করে। তার ছল, কাপট্য প্রদ্যুম্নর জীবনকেও ধ্বংস করে। তাঁর এই তন্ত্রমন্ত্র, উপাচারকে ইংরাজিতে Black Magic বলা যায়। এই ধরনের বিদ্যা মানুষের ক্ষতিসাধনেই মূলত ব্যবহৃত হয়। গল্পেও আমরা তেমনটাই লক্ষ্য করি। এই তন্ত্রোক্ত চর্চা তৎকালীন সমাজ জীবনকে বিপর্যস্ত ও অবক্ষয়ের দিকে ঠেকে দিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।


'মেঘমল্লার' গল্পে অসাধারণ মুর্শিয়ানায় বিভূতিভূষণ তৎকালীন সমাজ, ঘটনার কাল ও স্থানকে চিত্রিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই গল্পটি ব্যতিক্রম। গল্পটিতে রোমান্সময়তা ও কল্পনার আতিশয্য থাকলেও দেশ কাল ও সমাজচিত্র অঙ্কনে বিভূতিভূষণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।