'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে কে ‘পুতুল' আর কেই বা ‘পুতুলওয়ালা’? এই উপন্যাসটির মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুমাত্রিক জীবনভাবনা ও শিল্পচেতনার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে লেখো।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে মানুষকে পুতুল রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবী এক বিরাট রঙ্গমঞ্জ—এই রঙ্গমঞ্চে মানুষ পুতুল। এই উপন্যাসে শশী, কুসুম, বিন্দু, নন্দ, মতি, জয়া, বনবিহারী, কুমুদ-নানা চরিত্র জীবনের নানা স্তর থেকে উঠে এসেছে। জীবনের রঙ্গমঞ্চে তারা সবাই পুতুল।


কোনো অদৃশ্য স্রষ্টা এই পুতুল গড়েন, ভাঙেন। এই অদৃশ্য স্রষ্টা অদৃশ্য শক্তির মত পুতুলকে চালিত করেন। ‘নদীর মত নিজের খুশিতে গড়াপথে তার জীবনের স্রোত বয়ে চলে না।' এই 'পুতুলওয়ালার' সুতোর টানাপোড়েনে মানুষ নাচে, কাঁদে।


উপন্যাস জীবনের শিল্পরূপ। বহুমাত্রিক জীবনের ভাব ও ভাবনা উপন্যাসের মধ্যে অস্তিত্বের নতুন বাণী ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। গাওদিয়া গ্রামের নানা স্তরের নানা মানুষ। তাদের সুখ-দুঃখ, আর্তি ও যন্ত্রণা নানা রূপে ফুটে উঠেছে। বহুরূপী জীবনের রূপ এই সব চরিত্রের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। মানবমনের অতল রহস্যকে নিয়ে লেখক নানা চরিত্রের মধ্যে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবজীবনের নানা মনস্তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল এই সব বৃত্তে ফুটে উঠেছে। কুমুদ-মতি, বিন্দু-নন্দলাল, পাগলদিদি-যাদব এই সব চরিত্রের মধ্যে অস্তিত্বের নানা প্রশ্ন লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। এই সব চরিত্র, ঘটনা ও মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতকে নিয়ে এক একটা ‘episode' বা বৃত্ত ফুটে উঠেছে। বিন্দু-নন্দলাল, যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদি, কুমুদ-মতি সবই এক একটি ‘episode' বা বৃত্ত। এই বৃত্তগুলির মধ্যে উপন্যাসের জীবন-বীক্ষা নানা সুরে, নানা ছন্দে ফুটে উঠেছে। কুমুদ-মতি উপাখ্যানে মতির স্বপ্নকে লেখক তার আবাল্য জীবনের সম্পদ হিসেবে তুলে ধরেছেন। এই স্বপ্নপূরণের নায়ক হিসেবে বিনোদিনী অপেরার দলের কুমুদ এসে প্রবীরের রাজবেশে তার মনোহরণ করে। “স্বপ্ন মতির অফুরন্ত।" স্বপ্নমূর্তি দিয়ে মতি তার কামনাকে পূর্ণ করতে গ্রাম ছেড়ে শহরের অজানা পথে পাড়ি দেয়। সেখানে কুমুদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে—“রাগে-দুঃখে অভিমানে পাখি হইয়া মতির গাওদিয়া উড়িয়া যাইতে সাধ হয়।” জয়া-বনবিহারীর জীবনযাত্রীর মতির সুপ্ত বাসনা জাগ্রত হয়। সে ঘরোয়া জীবনের ঘরণী হবার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ওঠে। কুমুদ শিল্পী। তার জীবনে অনিয়মই নিয়ম। নিজের খেয়ালতৃপ্তিতে তার অবাধ আকর্ষণ। মতির সাধের হারটা কুমুদ বিক্রি করে দেয়। কুমুদ তার মনে সান্ত্বনা দেবার জন্য থিয়েটারে নিয়ে যায়। প্রেক্ষাগৃহে বসে যোগেশ নয় প্রবীরকে দেখে তার পুরাতন রোমাঞ্চ মনে আসে। কুমুদ বোহেমিয়ানের মত সেই নিরুদ্দেশের পথে চলে যায়। মতিও তার সঙ্গী হয়। স্বপ্নের বেদীপীঠ থেকে কেমন করে এই দম্পতি অজানা রহস্যলোকে হারিয়ে যায়, তার বেদনাহত চিত্র এই বৃত্ত। লেখকের পুতুল-ভাবনা এইভাবে নতুন মাত্রা নেয়। বিন্দু-নন্দলাল আখ্যানের শৈল্পিকতা নির্ভর করে জীবনের অচলিত, অজানা জীবনচর্যার সূত্রে। এই ‘বৃত্তে’ নরনারীর হৃদয়যন্ত্রণার করুণ ও ট্র্যাজিক দিকটি ফুটে উঠেছে। গোপালের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিন্দু-নন্দলালের পরিচয়। এক নাটকীয় গণ্ডগোলের পটভূমি দিয়ে চিহ্নিত এই যুগল-জীবন। তারপর শুরু হল বিচ্ছিন্নতার শাস্তি। 'তারপর বউ হইয়া সেই যে কলকাতায় গেল—গাওদিয়ার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রহিল না। এই বিচ্ছিন্নতা বিন্দুকে নিয়ে আসে চেনা জীবনের পরিধি থেকে। পরে জানা যায়, নন্দলাল সত্যই লক্ষ্মীছাড়া। বিন্দু-নন্দলালের জীবনের মধ্যে জীবনের আর এক প্রশ্ন সোচ্চার হয়ে ওঠে। পুরুষের অমিতাচারের মধ্যে, নারী সম্ভোগের দুর্বার তৃয়ার মধ্যে জীবনের অপভ্রষ্টতার সুর বাজে। শশী চিন্তিত হয়। নন্দলাল বিন্দুকে সম্মান দেয় নি, তবু ধার করা গয়না দিয়ে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছিল। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। “জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে, কলকাতার অনামী রহস্য। কলকাতায় থাকিয়া পড়িবার সময় শশী যাহা ভেদ করিতে পারে নাই।” বিলাস প্রাচুর্যের সজ্জিত আয়োজনের মধ্যেও বিন্দু কি অসুখী? জীবনের অজ্ঞাত রহস্য তাকে ঘিরে জেগে উঠেছে, শশীর চোখে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিন্দু তার বোন, তবু বিন্দু তার অজানা। চোখের জলে সে স্বীকার করে নন্দ বিন্দুকে আলাদা বাড়ি, প্রসাধন সব দিয়েছে, কিন্তু মর্যাদা দেয়নি। বিন্দু নন্দলালের রক্ষিতা। শশী বিন্দুকে গ্রামে নিয়ে যায়। গ্রামে এসে গ্রামের অশিক্ষিত কৌতূহলী মানুষ তাকে শ্লেষ ও ব্যঙ্গে বিদ্ধ করে। গ্রামে বিন্দু হয়ে ওঠে কলঙ্কিনী। ক্ষণিকের জীবনরহস্যসন্ধানে এক দিক বিন্দু চরিত্র।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে বহুমাত্রিক জীবনের আর এক চিত্র মতি-কুমুদ বৃত্ত। মতির স্বপ্ন অফুরন্ত। বাল্য-কৈশোর থেকে তার স্বপ্ন সচ্ছল সংসারে বিবাহের। এই উচ্চাশার ফলে তার জীবনে ট্র্যাজেডি নেমে আসে। গ্রামের এক যাত্রা দেখতে গিয়ে তার দেখা হয় রাজপুত্রবেশী কুমুদের। কুমুদ 'প্রবীরের' ভূমিকায় অভিনয় করছিল। মুগ্ধ হৃদয়দান-পর্ব শেষ হল কঠিন বাস্তবতার মধ্যে। মতি-কুমুদের যাযাবর জীবনের সঙ্গিনী হল। সে নিরুদ্দেশের পথে হারিয়ে গেল। জীবনরহস্য ভাবনার এ আর একদিক।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী-কুসুম আখ্যান। কুসুম পরাণের বৌ। গ্রামের ভগবান শশী ডাক্তার পরোপকারী, আদর্শবাদী চরিত্র। কুসুমের আচার-আচরণের জৈব ভাষা শশী বুঝতে পারে না। কুসুমের নীরব অনুভূতি নানা আকারে-ইঙ্গিতে সরব হয়ে ওঠে। কুসুম হাস্যলাস্যময়ী নারী। শশীর চোখে কুসুম 'সরলা বালিকা’, ‘মতির চেয়েও নির্বোধ। কুসুম রহস্যময়ী নারী, বিচিত্ররূপিনী নারী। তার খামখেয়ালীপনা, তার খাপছাড়া প্রকৃতি তাকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। শশীর জন্য তার ‘উম্মাদ ভালোবাসা' এই উপন্যাসের শিক্ষগত সৌন্দর্য। কুসুমের স্ফুট-অস্ফুট প্রেম শেষ পর্যন্ত অন্য রূপ নেয়, অন্য মাত্রা নেয়। 'চপল রহস্যময়ী নারী, জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম জীবনরহস্যের দূত। শশী যখন তাকে ডাকে, তখন কুসুম বলে “কাকে ডাকছেন ছোটবাবু? কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে?” নারীহৃদয়ের রহস্যকে জানার পর শশীর জীবনে আসে পরিবর্তন। নারীচরিত্র যে রহস্যময়ী, সে কথা শশী এতদিন পরে উপলব্ধি করেছে ও কুসুমের বিচ্ছেদ শশীকে বিপর্যস্ত করে তোলে, সে হয়ে ওঠে রূপান্তরিত মানুষ। কুসুম যে কথা বলেছে, তা লেখকের জীবনভাবনার এক চরমোৎকর্ষ। "চিরদিন কি একরকম যায়? মানুষ কি লোহায় গড়া চিরকাল সে একরকম থাকবে, বদলাবে না। বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি। আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না?” নারীর চরিত্রের তেজ ও অভিমান শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক সুর বয়ে এনেছে। কুসুম ও শশীর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্ব নরনারীর আদিম প্রণয়ের সংঘাতের কথা তাকে বলা চলে দেহমনের দ্বন্দ্ব। কুসুমের শরীরীভাষা, শশীর মনসন্ধানী ভাষার সঙ্গে এক বিন্দুতে মেলেনি। তাই এই ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়েছে। শশী চরিত্রে কল্পনা ও রসবোধের পাশাপাশি যে বাস্তবপ্রাধান্য আছে তা তার চরিত্রকে সুসম্পন্ন করেছিল। কিন্তু কুসুমের ট্র্যাজেডি তাকে কেন্দ্রভ্রষ্ট করে দিল। জীবনসংঘাতের এই রূপায়ণ লেখকের জীবন-সমীক্ষার এক উল্লেখযোগ্য দিক।