'ফসিল' গল্পটির মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে নামকরণের সঙ্গতি রয়েছে কিনা তা বিচার করো। এতে সার্থক ছোটগল্পের বাঞ্ছিত প্রকরণটি কি অক্ষুণ্ণ থাকতে পেরেছে?

'ফসিল' গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।


সাহিত্যে নামকরণ অনেক সময় জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। তবে নামকরণের মাপকাঠি সর্বত্র এক নয়। কোথাও নায়ক বা নায়িকা, কোথাও কেন্দ্রীয় চরিত্র, কোথাও মূল বিষয়বস্তু অনুসারী হয় নামকরণ। কখনও কখনও লেখকের মূলভাবনার দ্যোতক কোনও শব্দ বা বাক্যের সাহায্যেও নামকরণ করা হয়ে থাকে। এই গল্পের ক্ষেত্রে 'ফসিল' নামটি লেখকের ভাবনাবাহী ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ হিসাবেই গণ্য করা যেতে পারে।


লক্ষ বছর পরে পৃথিবীর নতুন প্রত্নতাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে দুলাল মাহাতো এবং অন্যান্যের শিল্পীভূত দেহাস্থি দেখে এই মানুষদের অর্ধপশু, অপরিণত মস্তিষ্ক, আত্মহত্যাপ্রবণ, সাব-হিউম্যান শ্রেণির মানুষের কঙ্কালের ফসিল বলে মনে হতে পারে বলে লেখক কল্পনা করেছেন। এই ফসিলের কথাতেই গল্পটির পরিসমাপ্তি এবং 'ফসিল' শব্দটিকেই লেখক গল্পের নামকরণরূপে ব্যবহার করেছেন। মূল গল্পের সঙ্গে এই নামকরণের যোগসূত্র কোনো কোনো সমালোচক আরোপিত ও কৃত্রিম বলে মনে করেছেন। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 'ফসিল' নামকরণটি সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর মতে, মূল বিষয়ের সঙ্গে ভূগর্ভে সমাহিত মৃতদেহগুলির ফসিলে পরিণতির যোগসূত্র অত্যন্ত ক্ষীণ।


‘ফসিল' গল্পের যারা মূল কুশীলব তারা হচ্ছে অগ্নুনগড়ের ভীল ও কুর্মী প্রজা। তাদেরই দলপতি দুলাল মাহাতো। এই দুলাল মাহাতো ও তার সাথী কুর্মী শ্রমিকদের মৃত্যু ও দেহাস্থির কথাতেই গল্প শেষ হয়েছে। লক্ষ বছর পরের মানুষের কাছে তাদের শিলীভূত কঙ্কাল দেখে অর্ধপশু মনে হওয়ার কথায় বর্তমান সমাজের শোষণ ও নিপীড়ন কিভাবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের পশুর স্তরে নামিয়ে দেয় লেখক তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুতরাং এই ব্যানাধর্মী নামকরণই গল্পের মূল ভাবনাকে ব্যঞ্ছিত করায় লেখকের বক্তব্যই পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয়ে যায়। এদিক থেকে বিচার করলে নামকরণের সার্থকতা অস্বীকার করা যায় না।


আরও একদিক থেকে দেখা যায়, গল্পের মধ্যে সমধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত মুখার্জী চরিত্রটির আদর্শবাদী ও গণতান্ত্রিক ভাবনায় নতুন রূপ পেয়েছে নেটিভস্টেট অনগড়। স্টেটের ক্ষয়িষ্ণুতা রোধ করে তার যৌবনশ্রী ফিরিয়ে দিয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুখার্জীর স্বপ্ন। কাজেই তার স্বপ্ন সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারা এক অর্থে গল্পটির প্রাণস্বরূপ এবং সেই স্বপ্ন ও চিন্তাগুচ্ছ গল্পের মধ্যে যথেষ্ট গুরুত্বও পেয়েছে। সেই মুখার্জীই গল্পের শেষাংশে কুর্মীদের করুণ পরিণতিতে ছলছল চোখে যখন স্বপ্ন দেখছে সুদূর ভবিষ্যতে এই সব লাস ঘিরে জিজ্ঞাসু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যখন গবেষণা করবে, তখন কেবল ফসিলগুলোই তারা দেখবে। আজকের এত লাল রক্ত সেদিন তারা দেখতে পাবে না। এদের জীবন সংগ্রামের করুণ ইতিহাসও সেদিন মুক্ত হয়েই থাকবে। মুখার্জীর এই নৈরাশ্যজনক চিন্তাধারার ভিত্তিতে গল্পটির নামকরণে, সার্থকতার সংগতি বজায় রেখেছে—এ কথা নিশ্চয়ই বলা যেতে পারে।


ছোটগল্পের আঙ্গিকের দিক থেকে বিচার করলে ‘ফসিলকে' একটি সার্থক ছোটগল্প বলে স্বীকার না করে উপায় নেই।


এ গল্পের মূল বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তরকালে বিলীয়মান সামন্ততন্ত্র ও উদীয়মান ধনতন্ত্রের কঠোর বাস্তব রূপ। এদের অর্থনৈতিক শোষণ নিষ্পেষিত শোষিত মানুষদের অসহায়তা এবং মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী মানুষের পরাভূত আদর্শবাদের ট্র্যাজেডি এ গল্পের মূল সুর। লেখক সুবোধ ঘোষ আলোচ্য গঙ্গে শুধু শোষক শোষিতের সংগ্রামই দেখাননি, তার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণার স্বরূপটিও সহানুভূতির সঙ্গে উদ্ঘাটিত করেছেন।


আঙ্গিকের দিক থেকে মুখার্জী চরিত্রটিকে অবলম্বন করে লেখক গল্পের মূল দ্বন্দ্বটিকে চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন। ছোট ছোট বিশিষ্ট ঘটনার উপস্থাপনে এবং চরিত্রের সংলাপে সাবলীল ধারায় আলোচ্য ছোটগল্পটি অগ্রসর হয়েছে এবং মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডিতে সমাপ্তি লাভ করেছে।