সমালোচকের মতে, স্টীলের চঞ্চু গল্পের মধ্যে দিয়ে গল্পকার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি বিদ্রূপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তোমার মত কী?

প্রাথমিক ভাবে মনে হতেই পারে যে, সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘স্টীলের চঞ্চু' গল্পের মধ্যে ভূপতির জীবনের করুণ কাহিনি ও রুনুর অসহায় মানসিক রোগের কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু একটু গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, ভূপতি রুনুর প্রসঙ্গ এখানে গৌণ হয়ে গেছে। প্রধান ভাবে উঠে এসেছে কোনো এক বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি গল্পকারের বিদ্রূপ। সে বিদ্রূপে তাচ্ছিল্যের কণামাত্র নেই। রয়েছে কতকটা যেন ভুল ধরিয়ে দেবার প্রয়াস।


গল্পের শুরু থেকে দেখা যায় এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রুনু মানসিক রোগগ্রস্থ। রুনুর বাবা ভূপতি মধ্যবিত্ত মানুষ। প্রৌঢ় জীবনে এসেও স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সুখের জন্যে জীবনসংগ্রামে রত। অথচ এই ভূপতিই একদিন উল্লেখযোগ্য কমরেড রূপে জনতার সেবা করে এসেছিলেন আন্তরিক ভাবে। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন— সেবা, রাজনীতি, দায়বদ্ধতা যে নামই দেওয়া হোক না কেন মানুষের মুক্তির পথ বাৎলানোই তাঁদের একমাত্র কাজ। তারপর যুগের পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তন ঘটেছে মানসিকতা ও মূল্যবোধের। পুত্র রুনু চাকরি, সংসারের দায় সমস্ত অস্বীকার করে মেতেছে গোপন রাজনীতির মতাদর্শে। এখানে উল্লেখ্য যে রুনুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবই লোকচক্ষুর অন্তরালে। মানুষকে তারা জানতে দিতে চায় না তাদের উদ্দেশ্য। অথচ, মানুষের উপকার করার ইচ্ছে আছে তাদের। কিন্তু তাকে সেবা বলা যাবে না। তবে সেটা যে কী— তাও তারা পরিস্কার করে জানে না।


রুনুদের পলিটব্যুরো পাঁচ সদস্যের। কিন্তু তারা যে পদ্ধতিতে সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, তা কথার জালে যতই ফুলিয়ে বড় করে তোলা যাক না কেন আপাতদৃষ্টিতে অন্যের ঘাড় ভেঙে খাওয়া ও জীবন কাটানোর প্রবণতা ছাড়া আর কোনো শিক্ষা দেয় না। বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার সরিক হতে তারা পারবে না বলে রুনু অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেলে ডুব মারে। প্রেসিডেন্ট কোনো কাজ করেন কি না গল্পকার বলেন নি। তবে এই পচা সমাজকে রাতারাতি পাল্টে ফেলার জন্যে গোপনে তাদের মীটিং চলে আর সেই মীটিং-এ চা আসে বুর্জোয়া সমাজের পকেট মেরে। প্রেসিডেন্টের সংসারের জন্যে তার রাতের বাজার করে দিয়ে যেতে বলেন অন্য দুই সদস্যকে। রোগীকে এরা হাসপাতালে পাঠাতে পারে না— সমাজের আর পাঁচজন্যের সেইরকম সুযোগ সুবিধা হয় না বলে। এই আদর্শ বয়ে নিয়ে চলেছে রুনু। সেই জন্যেই রুনু অসুস্থ — মানসিক রোগী। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েও তার অসুস্থতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কেন না, তার মাথায় তার প্রেসিডেন্টের মতবাদ ছাড়া আর কিছুই স্থান পায় না।


আসলে রুনু নিতান্তই ভাল ছেলে। বাবার ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। ছাত্রজীবন থেকেই সে ‘গুডবয়'। ভাল নম্বর নিয়ে পরীক্ষায় পাশ করে নিজের চেষ্টাতেই রেলের চাকরি জোগাড় করে। কলেজে কখনো কমনরুমে আড্ডা দেয় নি। অন্যদিকে তার মাথা খুব পরিস্কার, সায়েন্সের ছাত্র বলে সব কিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু যেহেতু তার মাথায় সমাজের সমস্যা, রাজনৈতিক ভাবনা ভূপতি কখনো ঢোকান নি তাই সমাজের সমস্যার কথা শুনে তার ভূপতির ওপর বিরক্ত হওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে করা যায় না। হয়তো তার মনে এই প্রশ্নই এসেছিল যে, যার কথা এলাকার ইতিহাসে অবশ্যই আলোচিত হয়, তার ছেলে হয়ে তাকে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয় নি। এই জন্যে অবশ্যই ভূপতি দায়ী। তাই সমাজ সমস্যার কথা শোনার পরেই সে ভূপতিকে দায়ী করেছে। ভূপতির প্রতি বিরক্ত হয়েছে। যথাযোগ্য উত্তরসূরী ভূপতি তৈরি করতে পারে নি বলেই ভূপতির প্রতি নানা ভাবে তার তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা বর্ষণ করেছে। এবং সম্ভবত ভূপতির আদর্শেই সমাজ সেবার ধ্বজা বইতে প্রাণিত হয়ে সে বিপথে চালিত হয়েছে।


শুধু রাজনীতি নয়, সমাজের ক্ষেত্রেও রুনুদের মতাদর্শ আবর্জনারই নামান্তর। তারা রোগীর সেবা করতে পারে না। অসুস্থ বাপকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখে। অকারণে ইচ্ছে করে কাজে ফাঁকি দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটায়। চুরি করে। অন্যের ওপর নিজের দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়। মানবতার কথা বলে, অথচ নিজের প্রয়োজনে বাবা-মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত ক্রীতদাস দাসীর মতো আচরণ করে। এদের মতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে পরিস্কার বলে মানতে পারা যায় না। তাই কাকের চঞ্চুতে এরা পরিষ্কৃত হয়। সমাজের বুক থেকে। কারো কারো মতে আলোচ্য গল্পের নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখকের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়েছে। রুনুদের রাজনৈতির আদর্শের সঙ্গে আচরণের দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, সমালোচকদের উক্ত মন্তব্যের পক্ষে মত দান করা যায়।