'মুক্তধারা' নাটকের নায়ক চরিত্র বিশ্লেষণ করো | মুক্তধারা নাটকে অভিজিৎ চরিত্রই নায়কের মর্যাদা সম্পন্ন—চরিত্র বিশ্লেষণ করে উক্তিটি যাথার্থ আলোচনা করো।

লেখক অভিলাষিত তকমা আরোপ না করে নিতান্ত স্বাভাবিক মানবিক চরিত্র চিত্রণে রবীন্দ্রনাথের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি যার যেটুকু বিশেষত্ব চোখে পড়ে তা নিতান্তই চরিত্রটির বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গণণীয়। আমাদের আলোচ্য ‘মুক্তধারা' নাটকের নায়ক চরিত্রও সেই রকম মাটির বাস্তবতায় পূর্ণ অথচ কবিকল্পনার ছায়াময় আবেশ আবেগ তার মধ্যে দ্যোতিত হয়েছে। মাটির মায়ের কোলে জন্ম লাভ করে, যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েও ধূলিময় পথের চিরপথিক রূপে বিশ্বজনের চিত্ত-রাজাসনে তাঁর অধিষ্ঠান।


রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা' নাটকের নায়ক তথা কেন্দ্রিয় চরিত্র অভিজিতের প্রথম পরিচয় হল তিনি যুবরাজ। উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ তাঁকে শিবতরাই অঞ্চলের শাসনভার দিয়ে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন মন্ত্রীর পরামর্শে। কিন্তু যুবরাজ অভিজিৎ রাজার অভিপ্রায়ের চেয়ে প্রজাকল্যাণের কথা বেশি চিন্তা করে, রাজা রণজিতের পূর্বপুরুষ দ্বারা দীর্ঘদিনের শোষণের অভিপ্রায়ে অবরুদ্ধ নন্দিসংকটের পথ খুলে দিয়েছিলেন। এই পথ দিয়ে তাদের পশম রপ্তানি হতো বিদেশের হাটে। তাতেই তারা হয়ে উঠেছিল স্বনির্ভর। এতে উত্তরকূটের স্বার্থবাদী প্রজারা নিতান্ত ক্ষেপে গিয়ে অভিজিতের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মুখর হয়েছিল। এমনকি তারা নিজেরাই আইন শাসন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অভিজিৎকে শাস্তি দেবার পক্ষপাতী ছিল। অবশেষে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে রাজার জয়ধ্বনি দিয়ে চলে গিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, অভিজিৎ আরো অনেক নতুন পথ কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এবং সেই সঙ্গে দরিদ্র শিবতরাই অঞ্চলবাসীদের খাজনাও মকুব করে দিয়েছিলেন। যুবরাজ হয়েও তিনি মনুষ্যত্বহীন রাজাদের মতো বা স্বার্থসর্বস্ব রাজাদের মতো শোষণ নীতি গ্রহণ করতে পারেন নি।


যুবরাজ অভিজিতের জন্ম রাজপুরীতে হয়নি। মুক্তধারা ঝর্নার ধারে তাঁকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল। কোনো এক মা তাঁকে জন্ম দিয়ে ঝর্নার ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। রাজা রণজিৎ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে, তাঁর কপালে রাজচক্রবর্তী চিহ্ন দেখে, রাজগুরু অভিরাম স্বামীর কথায় তাঁকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে অভিজিৎ রাজপুরীতে লালিত পালিত হয়েছেন। এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হলে রাজা রণজিৎ তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছেন। এই বৃত্তান্ত থেকে স্বাভাবিক ভাবেই মনে একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, অভিজিতের এ হেন জন্মবৃত্তান্ত জ্ঞাপনের কারণ কি? রাজা তো নিঃসন্তান ছিলেন না। রাজকুমার সঞ্জয় থাকা সত্ত্বেও কুড়িয়ে পাওয়া একটা ছেলেকে কেন তিনি যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন? তার উত্তরে এই যে, অভিজিৎ প্রকৃতির সন্তান, রাজবাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি রাজার উত্তরাধিকারী নন, তিনি মনুষ্যত্ববান। রাজপুরীতে যে অত্যাচারী রাজা অবস্থান করেন, তিনি তার ভিতরকার মানুষ। তিনি রাজার বিবেক। যে বিবেক জাতি-বর্ণ-কুল-জ্ঞাতি-সহায়-সম্পদ নির্বিশেষে আপামর জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। শোষক বঞ্চকের খোলস ছেড়ে রেখে নিজেকে দেশের সেবায় দশের সেবায় উৎসর্গ করতে পারে। সেই বিবেকের জন্ম প্রাচুর্যের মধ্যে হয় না বলেই অভিজিত জন্মেছেন প্রকৃতির কোলে। মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলার মতোই তিনি কুড়িয়ে পাওয়া, সহৃদয় সামাজিক এবং মনুষ্যত্ববান। মুক্তধারা ঝর্নার প্রবাহের মতো তাঁর জীবনও প্রৈতিযুক্ত। অভিজিৎ বলেন, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি পথ কাটবার জন্যে... যে-সব পথ এখনো কাটা হয় নি ঐ দুর্গম পাহাড়ের উপর দিয়ে সেই ভাবীকালের পথ দেখতে পাচ্ছি- দূরকে নিকট করবার পথ।' অর্থাৎ তাঁর কাজ সংযোগস্থাপনের কাজ। দূরকে নিকট করার কাজ। মানুষে মানুষে মেলবন্ধন ঘটানোর কাজ। এই জন্যেই তিনি খুলে দেন দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ নন্দিসংকটের পথ। মানুষের সঙ্গে মানুষকে মেলাতে পারলেই অখণ্ড মৈত্রীবন্ধনে বিশ্বকে বাঁধা যেতে পারে। সেই অখণ্ড মৈত্রী স্থাপনার জন্যে তাঁর সাধনা মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপনের সাধনা। তাঁর সাধনা প্রেমের সাধনা। প্রেম ছাড়া সাম্য আসতে পারে না। সেই জন্যেই দেখি, রাজা মন্ত্রী থেকে শুরু করে অম্বা, বটুর মতো নিতান্ত সাধারণ তথা অবহেলিতদের সঙ্গেও তাঁর অবাধ বিচরণ, অসঙ্কোচ বাক্যালাপ। সকলের প্রতিই তাঁর শ্রদ্ধা। কেননা তিনি মানুষের সেবায় নিয়োজিত, গতিময় পুরুষ। গতিময় বলেই চলার পথের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা তিনি কেটে যেতে চান।


রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আলোচ্য নাটকটির সাংকেতিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “অভিজিৎ হচ্ছে মারনেওয়ালার ভিতরকার মানুষ।” অর্থাৎ অভিজিৎ হলেন শাসকশ্রেণির বিবেক। যার বিচারে রাজাকে মাঝে মাঝেই জবাবদিহি করতে হয় নিজের কাছেই। তাই নাট্যকার বৈরাগী ধনঞ্জয়ের সংলাপের মধ্যে দিয়ে বলেছেন, ‘রাজদরবারে উপরতলার মানুষ যখন নালিশ মঞ্জুর করে তখন রাজার তাড়া রাজাকেই তেড়ে আসে।'


রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, “অভিজিৎ গতির প্রতিভূ। মুক্তধারা ঝর্নার সঙ্গে তাঁহার অন্তরাত্মার যোগ। ঝরনার গতি তাঁহার স্বধর্ম। তাই বন্ধনের ফেনা তাঁহার মধ্যে অতিশয় প্রবল। তাই রাজসিংহাসন, ঐশ্বর্য— কোন বন্ধনই তাঁহাকে বাঁধিতে পারে নাই। গতির আবেগে ঝরনা যেমন অনন্তসন্ধানী, অসীমের পরশ-পিয়াসী, অভিজিৎ তেমনি অমৃত সন্ধানী। যন্ত্রশক্তিকে বড় করিয়া তুলিয়া যে বিষ উঠিয়াছিল, তাহাকে অমৃত করিয়া তুলিবার সাধনায় অভিজিৎ তাঁহার জীবনটাকে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। যন্ত্রকে বারিধারায় পরিণত করার জন্য তাঁহার মৃত্যুবরণ। অভিজিৎ এমন একটি চরিত্র যিনি শুধু নিজের মুক্তি চাহেন নাই, সমস্ত বদ্ধমানবের মুক্তি ছিল তাঁহার কাম্য।


পৃথিবীর মাধুর্যটাকে অভিজিৎ মনে করিয়াছেন স্বাভাবিক। যন্ত্র পৃথিবীর মাধুর্যকে ঢাকিয়া ফেলিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া তিনি ব্যথিত হইয়াছেন এবং পৃথিবীর মাধুর্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য— মধুরের মর্যাদা রাখিতে কঠিনের সাধনা করিয়াছেন। পৃথিবীতে বসন্ত আবাহনের জন্য তাঁহার জীবন বিসর্জন।” একের জীবন বিসর্জনে অন্যের মধ্যে মনুষ্যত্ব উদ্বোধনের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্যে আরো অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। যেমন ‘বিসর্জন’ নাটকে জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতির মনুষ্যত্বের উদ্বোধন হয়েছিল, ‘রক্তকরবী’তে রঞ্জনের মৃত্যু যেমন রাজাকে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল, তেমনি আলোচ্য নাটকেও অভিজিতের মৃত্যু রাজা রণজিৎ সহ সমগ্র উত্তরকূটের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল। সংকীর্ণতার গণ্ডী থেকে তাদের প্রাণকে, প্রাণের প্রবাহের ধারাকে মুক্ত করেছিল।


বস্তুত, “যাকে আঘাত করা হচ্ছে সে সেই আঘাতের দ্বারাই আঘাতের অতীত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু যে মানুষ আঘাত করছে আত্মার ট্র্যাজেডি তারই— মুক্তির সাধনা তাকেই করতে হবে, যন্ত্রকে প্রাণ দিয়ে ভাঙবার ভার তারই হাতে। পৃথিবীতে যন্ত্রী বলছে, মার লাগিয়ে জয়ী হব। পৃথিবীতে মন্ত্রী বলছে, হে মন, মারকে ছাড়িয়ে উঠে জয়ী হও। আর নিজের যন্ত্রে নিজে বন্দী মানুষটি বলছে, প্রাণের দ্বারা যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। মুক্তি দিতে হবে। যন্ত্রী হচ্ছে বিভূতি, মন্ত্রী হচ্ছে ধনঞ্জয়, আর মানুষ হচ্ছে অভিজিৎ।”—‘মানুষ’ বলেই তিনি মানবকল্যাণকামী। 'মানুষ' বলেই তিনি মানবতাবাদী এবং মনুষ্যত্বের দীক্ষা প্রদাতা। সমগ্র উত্তরকূট ও শিবতরাই অঞ্চলের সকলের তৃষ্ণা ও ক্ষুধা মেটানোর এবং প্রেমের উদ্বোধনের উপায় হিসেবে পথ কেটেছেন, বাঁধ ভেঙেছেন, দিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার অনুপ্রেরণা। তিনি প্রচার সর্বস্ব, প্রকাশ্য প্রশস্ত পথে জনসেবা করে নিজেকে ব্যক্ত করেন নি। নিজেকে প্রচ্ছন্নে রেখে কখন যে নন্দিসংকটের পথ কেটে দিয়েছেন, মুক্তধারার বাঁধকে ভেঙে অবাধ মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন তা কেউ লক্ষ করেন নি। সমগ্র নাটকে তাঁর অবস্থান খুব বেশিক্ষণের না হলেও তাঁকে ঘিরে, তাঁর কর্মকাণ্ডকে অবলম্বন করে নাট্যকাহিনি আবর্তিত হয়েছে। তাই আলোচ্য নাটকের নায়কের সম্মান তাঁকেই দেওয়া যায়।