বর্তমান যুগে ‘মুক্তধারা' নাটকের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় কালোত্তীর্ণ কবি। কারণ তাঁর রচনা যুগে যুগে কালে কালে নব নব আলোকে নতুন প্রাসঙ্গিকতায় প্রতিবিম্বিত। সমকালীন যুগ-প্রেক্ষায় দেখা যায় তাঁর বক্তব্য তাঁর ভাবনা চিন্তা যেন উদ্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করেই উদ্ভূত হয়েছিল। তাঁর গান কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটকের মর্মবস্তুগুলি নতুন করে বিচার করতে বসলে এ সত্য সহজেই প্রতিভাত হয়। নাটকের মধ্যে 'বিসর্জন', 'রক্তকরবী’, ‘তাচলায়তন'- এর কথা প্রসঙ্গে সহজেই মনে করা যেতে পারে। তাতে যে সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিদ্ধারণ করা হয়েছে তা আজও প্রাসঙ্গিক। ঠিক সেই রকম আলোচ্য ‘মুক্তধারা' নাটকের প্রাসঙ্গিকতাও বর্তমান প্রেক্ষায় অপর্যুসিত। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ নাটক যন্ত্র বিরোধীতার বার্তাবাহী। কিন্তু যন্ত্র মাত্রেরই বিরোধিতা এখানে করা হয় নি। যে যন্ত্রের চাপে মানবজাতির মনুষ্যত্ব ক্লিষ্ট, সেই যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে কেবলমাত্র বাঁধের বিরুদ্ধাচারী বক্তব্যই এখানে করেছেন এ কথা ভাবাও অনুচিত। বস্তুত, বিভূতির বাঁধ এখানে শাসক দ্বারা নির্দিষ্ট শোষণ যন্ত্র রূপে প্রতিভাত। সেই যন্ত্রের চাপে পড়ে প্রকৃতির অকৃপণ দানসত্র পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ মানবকুলকে ছাপিয়ে প্রকৃতির ওপর পর্যন্ত তার করাল থাবা প্রলম্বিত।


‘বিসর্জন’, ‘অচলায়তন' প্রভৃতি নাটকের মধ্যে যেমন লক্ষ্য করা গেছে আচারসর্বস্বতার কারণে মনুষ্যত্ব অবলুপ্ত, ‘রক্তকরবী’র মধ্যে যেমন দেখা গেছে ধনী হবার লোভে প্রকৃতির বুকের থেকে তাল তাল সোনা ছিনিয়ে আনার নিষ্ঠুরতায় মনুষ্যত্ব অপসৃত, আলোচ্য ‘মুক্তধারা' নাটকের মধ্যেও তেমনি দেখা যায় আপন ক্ষমতা ও আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার উদগ্র বাসনায় মনুষ্যত্বকে বলি চড়িয়েছিল উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ। সেই নিষ্পেষিত, ক্লিষ্ট, অপসৃত মনুষ্যত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বাণী সঞ্চারিত হয়েছে আলোচ্য নাটকে। এখানে আরো একটা বড় সমস্যার প্রসঙ্গ অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। সে সমস্যা শিক্ষা-সমস্যা। শোষণের হাতিয়ার করা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে। রাজার স্বার্থ নির্ভর শিক্ষা দান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে আত্মস্বার্থ সন্ধানী গুরুমশাই-এর মাধ্যমে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগে যুগে এই শিক্ষা পদ্ধতি লক্ষ করা গেছে। দেশ সঞ্চালকগণ যে পদ্ধতিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন। দেশের দশের চেয়ে সেখানে আত্মস্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যই অধিকতর ক্রিয়াশীল বলে মনে হয়।


এরপর আসে প্রশাসন প্রক্রিয়ার কথা। সে প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের প্রথাবলম্বী সংস্কারহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে স্বৈরাচারে পর্যবসিত হয়। দেশের কল্যাণের চেয়ে রাজা তথা দেশ সঞ্চালকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে তাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মূল উদ্দেশ্য একটাই প্ৰজা শোষণ, প্রজা পীড়ন ও প্রজা বঞ্চন।


অবশেষে একদিন আবির্ভূত হয় অভিজিৎ। বাইরে থেকে তীব্র আঘাত করে অচেতন মনে চেতনা ফিরিয়ে আনে সে। কোনো সংঘাতের মধ্যে দিয়ে নয়, আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপন করে, মানব শৃঙ্খলা রচনা করে শোষণ মুক্তির আন্দোলনে ব্রতী হয়। দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ প্রেমের পথ উন্মোচন করে, অবরুদ্ধ উন্মুক্ত করে বিভদের অবসান ঘটিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করে সে।


আজকের প্রেক্ষিতে ‘মুক্তধারা' নাটককে যখন দেখি, তখন সে সমস্যাটা বড় হয়ে দেখা দেয় তা হল মনুষ্যত্বহীনতার সমস্যা। পৃথিবী দূষণের পাশাপাশি মনুষ্যত্ব দূষণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যেখানে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্ন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে উন্নতি সাধিত হয়েছে, তাতে মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে বটে, কিন্তু তার প্রায় সবটাই শর্ত ও স্বার্থ সাপেক্ষে। অনাবিল মনুষ্যত্বের বন্ধন আজ পর্যুদস্ত। বাণিজ্যিক চাপে পড়ে ব্যস্ততার যুপকাষ্ঠে বলি প্রদত্ত করা হয়েছে মনুষ্যত্বের। যন্ত্ররাজ বিস্তৃতির বাঁধ নির্মাণের কাজে যেমন বলি চড়ানো হয়েছিল শিশু-বালক নির্বিশেষে আঠারোদ্ধ কিশোরদেরও। প্রাণে না হলেও মনে মারা হচ্ছে মানুষদের। ব্যস্ততার চাপে পড়ে মানুষের মনের আকাশও ‘মুক্তধারা'র আকাশের মতোই মন্দিরের চূড়া আর লৌহযন্ত্রের মাঝে পিষ্ট সংকীর্ণ। মন সংকীর্ণ বলেই জীবনধারা নিস্তরঙ্গ। মুক্তধারা ঝর্নার প্রবাহ তাই কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ ও আবিল। এ থেকে মুক্তির উপায় হল অবরুদ্ধ প্রবাহকে গতি দান করা, সংকীর্ণ দৃশ্যায়িত আকাশকে ব্যাপ্ত করা। এ কাজ তখনই সম্ভব হবে যখন, মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হবে হৃদয়বৃত্তীয় উচ্ছ্বাসে। তা একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন রাজার বুকে ব্যথা বাজবে।


আলোচ্য নাটকে মুক্তধারার প্রবাহ গতি পেয়েছিল তখন-যখন রাজা হারিয়েছিলেন তাঁর বুকের ধন অভিজিৎকে। এতকাল অন্যের বুকের ধন হরণ করে হারানোর ব্যথা অনুভব করেন নি, করেছেন নিষ্ঠুরতার উল্লাস। কিন্তু অভিজিৎকে হারিয়ে রাজা সমস্ত প্রজাদের মনের ব্যাথার সঙ্গে নিজের ব্যথার সাদৃশ্য উপলব্ধি করেছেন। নিজের প্রাণ দিয়ে অভিজিৎ সমগ্র উত্তরকূটবাসীর জীবনযাপনে প্রাণ সঞ্চার করে গেছেন। মনুষ্যত্বের উদ্বোধন করে গেছেন। বাস্তব জগতেও সমগ্র দেশবাসীর মনুষ্যত্ব জাগ্রত হলে, বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটতে পারে। দেশ বর্ণ জাতি নির্বিশেষে মানুষে মানুষে মিলিত হতে পারলেই সব রকমের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয়। আলোচ্য নাটকের এই বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য।