'অশ্বমেধের ঘোড়া' গল্পের লিপিকুশলতা বর্ণনা করো।

দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশ্বমেধের ঘোড়া' গল্পটির মধ্যে আধুনিকতার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে যুগযন্ত্রণা ও যুগের অবক্ষয়ী-বিম্বন ধরা পড়েছে দ্ব্যর্থহীন ভাবে। সেই সঙ্গে ধরা পড়েছে যুগের অনিশ্চিত পরিণাম, অস্থিরতা, দারিদ্র্য সহ সমস্ত কর্কশ অভিব্যক্তি। কিন্তু যুগের এই চিত্রকে বিম্বিত করার জন্যে লেখক কোথাও এই শব্দগুলো ব্যবহার করেননি। এমনকি বর্ণনা বিশ্লেষণেরও অবতারণা ঘটাননি— তিনি কেবল নায়ক কাঞ্চন আর নায়িকা রেখার অন্যান্য দিনের মতোই একটি বৈকালিক মিলনের দৃশ্যকে তুলে ধরেছেন। দিনটির বিশেষত্ব এই যে, সেটা ছিল কাঞ্চন ও রেখার রেজিস্ট্রি বিয়ের বিবাহবার্ষিকী। বিবাহবার্ষিকীর বিকালে কাঞ্চন-রেখা উভয়ে মিলিত হয়ে প্রথমেই লক্ষ করেছিল 'নাইনটিহু সেঞ্চুরির সমাধি' 'সেনেট হল ভেঙে পড়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে এই যুগযন্ত্রণা উপশমের জন্যে অনেক পাগলই দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছিল। কিন্তু পাগলদের বক্তৃতায় কিছুই লাভ হয়নি। যে যুগযন্ত্রণা ছিল তা আজও রয়ে গেছে, মাঝখান থেকে আশ্বাস পাওয়ার ক্ষেত্র সেনেট হলটাও ভেঙে পড়েছে। এ যুগের কোনো কিছুর মধ্যেই যেন হৃদয়বৃত্তির সাড়া নেই। সদ্য বিবাহিত রেখা তাই অনায়াসে রুমাল দিয়ে মুছে ফেলতে পারে কপালের সিঁদুর — কাঞ্চনের সামনেই। বিবাহের এক বছর পরেও কেউ কারো মনকে, ইচ্ছাকে শরীরকে চিনতে পারেনি। এবং প্রতি মুহূর্তে তারা চলেছে হিসেব করে করে। কথায় হিসেব, চলায় হিসেব, অবসরের হিসেব, বাসের টিকিটের হিসেব, গাড়ী ভাড়ার হিসেব এত হিসেবের মধ্যে পড়ে তাদের প্রেম, তাদের হৃদয়বৃত্তি নিষ্পেষিত। তাই প্রেম ভাবনার তুলনায় তারা হয়ে উঠেছে আবেগহীন বুদ্ধিজীবী। সব কিছুই প্রয়োজনের খাতিরে পরিমিত। রেস্তরাঁর কেবিন ছোট, বসার জায়গা, শোবার ঘর ছোট। বাস্তবতার চাপে পড়ে মানুষের মন হয়ে গেছে ছোট। তাই কোথাও দ্বিতীয় জনকে নিয়ে বসার স্থান সঙ্কুলান হয় না। অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে উঠেছে মানুষ। বাসের কণ্ডাক্টর, ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান কেউই রেয়াৎ করে কথা বলে না। তার চেয়ে বড় কথা কেউই কারো মন বোঝে না


এই অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে লেখক যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। যুগের এই প্রাত্যহিক যন্ত্রণায় কাঞ্চন রেখার মতো সকলেরই অবস্থা একই প্রকার— এই কথাটি বোঝানোর জন্যে তাঁর রচনায় তিনি উত্তমপুরুষ প্রথমপুরুষের বক্তব্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ কাঞ্চন এবং রেখা অথবা ভোক্তা ও দর্শক সকলেই যে এক শ্রেণিভুক্ত সে কথাটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এই ভাবে— “কাঞ্চন সিগারেটে টান দিল। রেখার স্মার্ট উত্তর তাকে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। অথচ, আমি ঠিক জানি না ঠিক কি চাই। কি হলে খুশি হতাম। রেখার অস্বস্তি মিথ্যে নয়, তুচ্ছ নয়। আমি একটা কলেজের শিক্ষক। রেখাকে এনে সংসারে স্ত্রীর মর্যাদা দেবার সাধ্য আমার নেই।"


আবার কাঞ্চনের দ্রুত চিন্তার বিশ্বন তুলে ধরেছেন অসম্পূর্ণ কথার মধ্যে দিয়ে। যেমন, “আশ্চর্য লোভে, রেখা সিঁদুরের প্যাকেটের দিকে তাকিয়েছিল। অথচ, শপথ উচ্চারণের সময়ও তাকে এতটুকুও বিচলিত হতে দেখিনি। সকলের তাড়া খেয়ে আমি রেখার ঠাণ্ডা কপালে মুখের দিকে তাকাতে সাহস— কেন আঙুল দিয়ে সিঁদুর লাগাতে হয় প্রফুল্ল বকেছিল আর রেখা খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল।”


অন্যত্র, অপ্রাসঙ্গিক কথা তুলে ধরে কাঞ্চনের মনের অপ্রস্তুত ভাবকে কিংবা, নির্বেদ সময় কাটানোকে বোঝাতে চেয়েছেন গল্পকার। যেমন, রেজিস্ট্রী বিয়ের দিন বিয়ে সেরে ফেরার পথে রেখার বাবার সঙ্গে বাসে দেখা হয়ে যাওয়ার ফলে দোতলা বাসের দ্বিতলে বসে কাঞ্চন যখন অন্যমনস্কের মতো বাসের যাত্রীদের লক্ষ করছিল, তখন সে বলেছিল “জনৈক বিজ্ঞাপন দেখে যথার্থ মুগ্ধ হয়েছিলাম। সুন্দর করে লেখা ছিল—'ডোন্ট স্মোক ইন দি বাস্, নট উভন নামার টেন।''


আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, সংলাপমুখর গল্পটির মধ্যে উত্তমপুরুষ-প্রথমপুরুষের বিমিশ্র বর্ণনা, ক্ষেত্র বিশেষে অসংলগ্ন উক্তি, মন্তব্য বা প্রসঙ্গের অবতারণা, প্রভৃতি নানা দোষে রচনাটি দুষ্ট। কিন্তু যদি দেখা যায় আলোচ্য গল্পের মধ্যে লেখক যুগযন্ত্রণাকে চিত্রিত করতে চেয়েছেন, তবে এই অসংলগ্নতা, এই বিমিশ্র বর্ণনভঙ্গিমা সমস্তই অর্থবহ হয়ে ওঠে। সে দিক থেকে বিচার করে আধুনিক বাংলা গল্প ভাণ্ডারে এই রচনাশৈলী যে একটি নবতম সংযোজনা সে কথা বলাই বাহুল্য।