'একেই কি বলে সভ্যতা?' প্রহসনের কালীনাথ চরিত্র আলোচনা করো।

কালীনাথ নবকুমারের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আলোচ্য প্রহসনে ঘটনা সংঘটনে তার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যে কালীনাথ একদা নবকুমারের সহপাঠী ছিল সেই কালীনাথ বর্তমানে নবকুমারের দৈনন্দিন জীবনের আমোদ-ফূর্তির সাথী। সে নিজে যথেষ্ট বিত্তবান পরিবারের সন্তান নয় বলে, আমোদপ্রমোদের জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় বলে সে নবকুমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয়, নবকুমারের সান্নিধ্য তার অত্যন্ত প্রয়োজন। নবকুমারের পিতার আগমনে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ অবলুপ্তি ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিলে সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। নবকে সভায় নিয়ে যাবার জন্য নানা প্রকার মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। তার জীবনের মূল লক্ষ্য আত্মসুখচরিতার্থ করা।


আলোচ্য প্রহসনে কালীনাথ নবকুমারের মত গুরুত্ব না পেলেও নবকুমারের পরই তার স্থান। অন্যান্য চরিত্রের অপেক্ষা আলোচ্য প্রহসনে কালীনাথের গুরুত্ব অনেক বেশি। কালীনাথ আসলে নবকুমারের পরিপূরক এবং সেও নব্যবঙ্গীয় সমাজের বিকৃতির প্রতিনিধি। ইয়ংবেঙ্গলের চরিত্র লক্ষণ তার চরিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সমালোচক মনে করেন, “ত্রিশের দশকের ডিরোজিও পন্থী কালাপাহাড়ী মেজাজের ইয়ংবেঙ্গল না হলেও কালীনাথের মধ্যে সেই সময়কার স্বশ্রেণীভুক্ত গোষ্ঠীর চারিত্র্য লক্ষণ অনেকটাই মিলে যায়। সেদিক থেকে বলা যায় নবকুমারের চেয়ে কালীনাথই তার গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে গোষ্ঠীর স্বরূপ উপস্থাপনে অধিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।” কালীনাথ সুরা আর নারী জাতকেই একমাত্র সত্য মনে করে। তার রসিকতা অত্যন্ত নির্লজ্জ ধরনের। নবকুমারের পিতার কাছে কীভাবে আত্মপরিচয় দেবে এ প্রসঙ্গে রসিকতা করে বলে, বিয়ার নামক পানীয় বংশে তার জন্ম; যদিও অন্যান্য অকুলীন পানীয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে। শহরের অভিজাত সোনাগাছিতে তার নিত্য যাতায়াত। বিদেশি হোটেলের নিষিদ্ধ খাদ্যে তার তৃপ্তি। সে বারাঙ্গনাদের পানালাপে ও রঙ্গরসিকতায় অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে তার গলা শুকিয়ে যায় বলে বন্ধুর বাড়ি পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে দুর্বলতাবোধ করে এবং স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যতটা পারে গলধঃকরণ করে। সে বলে, পান খাওয়া নয়, পান করাই তার বিলাস।


সে কলেজে পড়লেও তার বিদ্যাবুদ্ধি বেশ স্থূল। তার রুচি বিশৃঙ্খল জীবনাচরণে এবং তার মেজাজ বেশ নিম্নগামী। তার সংলাপগুলি তার বিকৃত জীবনরুচির পরিচয় বহন করে। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ কেউ কেউ তাকে পড়াশুনা জানা লোক মনে করে; আবার কেউ কেউ তার লেখাপড়া জানায় সন্দেহ প্রকাশ করে। সে জীবনে ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ ও জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’র নাম শোনেনি। তার স্মরণশক্তিও বেশ দীন। আবার সে বেশ বিশুদ্ধ বাংলায় বলে, 'এই সভাটি সংস্কৃতবিদ্যা আলোচনার জন্য সংস্থাপনা করেছি।' সে মিথ্যাভাষণেও বেশ পটু; কেননা জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার কার্যকলাপ যে সংস্কৃতচর্চা এবং সেখানে সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যাপক কেনারাম বাচস্পতি মহাশয় অধ্যাপনা করেন এমন মিথ্যাকথা অম্লানবদনে জানিয়ে যায়।


কালীনাথ অবশ্য স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ নয়; আর এইখানেই নবর সঙ্গে তার পার্থক্য। বৈষ্ণববাবাজীকে দেখে নবকুমার ভীতিগ্রস্ত হলে কালীনাথ তাকে চপ-কাটলেট খাইয়ে বশীভূত করতে চায়। এমনকি সে নবকুমারকে বলে যে, তার কোনো ‘মরাল ক্যারেজ’ নেই। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কালীনাথ চরিত্রের আন্তঃঅসঙ্গতি ধরা পড়ে। নবকুমার বৈষ্ণববাজীকে উৎকোচে বশীভূত করলে সে বলেছে— “এদিকে মালা ঠকঠক করে আবার ঘুষ খেয়ে মিথ্যা কথা কইতে স্বীকার পেলো? শালা কি হিপক্রীট!” বৈষ্ণববাবাজীর আচরণের বৈপরীত্যে কালীনাথ তাকে হিপক্রীট’ বলেছে অথচ সে নবকুমারের পিতার সামনে দ্বিধাহীনভাবে মিথ্যা কথা বলেছে। কালীনাথ এমনই তথাকথিত ইয়ংবেঙ্গল - সে সংস্কারকামী, স্বাধীনতাকামী যুবসমাজের প্রতিনিধি। প্রহসনে সে পার্শ্বনায়ক।