“পূর্বে গণেশের যাহা কিছু পাওনা ছিল আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন।”— কাদের সম্বন্ধে একথা বলা হয়েছে? সিদ্ধিদাতা গণেশের সঙ্গে তাদের তুলনা করার কারণ কী?

“পূর্বে গণেশের যাহা কিছু পাওনা ছিল আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন।”— কাদের সম্বন্ধে একথা বলা হয়েছে? সিদ্ধিদাতা গণেশের সঙ্গে তাদের তুলনা করার কারণ কী?

জজ-আদালতের কর্মচারী থেকে শুরু করে পেয়াদা পর্যন্ত সকলের উদ্দেশ্যে এই কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেকেই যেন তেত্রিশ কোটি দেবতার এক একটি ছোট ছোট নতুন সংস্করণ। এদের পূজা উপলক্ষে অনেকেই টাকাটা-সিকেটা, মাছটা, তরিতরকারিটা সিধে পাঠিয়ে থাকেন। কারণ এদের খুশি করতে পারলে অনেক সময় নানান কার্যসিদ্ধি হয়ে থাকে।


‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক ছোটবেলা থেকে দেখত চৌধুরী জমিদারের নায়েব—তার বাবা সময়ে অসময়ে এইসব আদালতজীবীদের প্রতি অতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। তার ফলে নায়ক ছোটবেলা থেকেই এঁদেরকে মানুষের পূজ্য জ্ঞান করতো। বস্তুত আদালত ও আদালতজীবীদের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের যে অশ্রদ্ধা ও ভীতি আছে তারই অভিব্যক্তি ঘটাতে এই জাতীয় মন্তব্য করা হয়েছে।


আদালতের রায় সম্পূর্ণ নির্ভর করে সাক্ষী সাবুদের ওপর। বিশেষ করে কাগজ বা প্রমাণের ওপর নির্ভর করে কাজকর্ম এবং বিচার বিবেচনা চলে থাকে। আবার এই সমস্ত প্রমাণাদি ও কাগজপত্র সঞ্চালিত হয়ে থাকে। আদালতী কর্মচারীদের মাধ্যমে। এদেরকে সন্তুষ্ট না করলে হাতের ফল যেমন বাইরে চলে যেতে পারে তেমনি আবার এদের অসন্তুষ্টিতে আদালত শরণাপন্ন বাদী অথবা বিবাদীর ঘর বাড়ি নিলামে চড়তে পারে। উচ্ছেদ হতে পারে ইত্যাদি আরো নানা অশান্তিতে ভোগার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।


দেবদেবীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তাদের তুষ্টি অসন্তুষ্টির পরিণাম—তাঁদের আশীর্বাদ অভিশাপের ধারণা মানুষের মনে বদ্ধপরিকর। তাই মানুষ প্রাণপণে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে রকমারি মানত করে থাকে, যাতে দেবদেবীর সন্তুষ্টি আরাধ্যকে, সংসারকে ঋদ্ধ করে। আদালতের কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও এই একই ধারণা মানুষের মধ্যে কাজ করে। এঁরা দেবদেবীর মতো অদৃশ্য নয়। এরা জীবন্ত, বাস্তব এবং প্রত্যক্ষগোচর। দেবদেবীর মতো আশীর্বাদের অধিকার বা ক্ষমতা এঁদের নেই পরন্ত অভিসম্পাত বা অশান্তিতে দগ্ধ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা এঁরা স্বেচ্ছায় প্রয়োগ করতে পারে। প্রয়োজনে সাক্ষাতে এসেই মানুষের ওপর চড়াও হতে পারে। সেই ভয়েই মানুষ এঁদের যথাসাধ্য পূজা প্রেরণ করে থাকে। এদের পূজায় সন্তুষ্ট রাখতে পারলে, সিদ্ধিদাতা গণেশ যেমন সিদ্ধিদান করে থাকেন, এরাও তেমনি বিত্তশীলদের রকমারি বৈষয়িক সিদ্ধিদান করতে সমর্থ হন। তাই এদের সিদ্ধিদাতা গণেশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।



“নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু মাসীনি গারিবাডি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম” -নায়কের এই স্বগতোক্তির কারণ কী?

‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের পিতা চেয়েছিলেন, ছেলেকে কিছুটা শেখাপড়া শিখিয়ে জমিদারী-সেরেস্তার কাজ শিখিয়ে কোথাও তাকে গোমস্তা-গিরিতে নিযুক্ত করিয়ে দেবেন। কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হল না। নায়ক ছোটোবেলায় দেখেছিল তাদের গ্রামের নীলরতন নামে একটি ছেলে কলকাতায় পালিয়ে লেখাপড়া শিখে কালেক্টার সাহেবের নাজির হয়েছিল। নায়কের কাছে সে আদর্শ। নায়ক তারই মতো পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া শিখে কালেক্টরের নাজির না হলেও জজ-আদালতের হেডক্লার্ক হওয়ার ইচ্ছে। কেননা সে বাল্যাবস্থা থেকেই দেখেছিল জজ-আদালতের হেডক্লার্কদের তার পিতা, চৌধুরী জমিদারের নায়েব, অত্যন্ত শ্রদ্ধা সমীহ করে থাকেন। সময়ে অসময়ে মাছটা-তরকারিটা, টাকাটা-সিকেটা এঁদের ভেট পাঠান। মানুষের কাছে দেবতাতুল্য জজ আদালতের কর্মচারী হবার জন্যে উচ্চশিক্ষা বাসনায় নায়কও একদিন কলকাতায় পালিয়ে চলে এলো। সেখানে কলেজে ভর্তি হল। কিন্তু পড়াশোনার চেয়ে, আঠারো বছরের মনের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল দেশের সেবার কাজ। নিজেরা নিজেদেরকে বড় বড় বিপ্লবীর আদর্শে দীক্ষিত করে ফেলল। পড়াশোনা ফেলে সভাসমিতিতে যোগ দেওয়া শুরু হল। ক্রমে ক্রমে নিজেদের দেশসেবার নিষ্ঠার প্রমাণ দিতে দুপুর রোদে টো টো করে দলের জন্যে চাঁদা ভিক্ষে করত। নেতারা বক্তৃতা দেবার আগে চৌকি বেগ পেতে দিত। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন বিলি করত। দলপতির নামে কেউ একটা কথা বললে কোমর বেঁধে মারামারি করতে যেত। দেশ সেবার আদর্শ এমন তাদের মাথায় বসে গিয়েছিল যে তারা দেশের জন্যে প্রাণবিসর্জন করা যে একান্ত কর্তব্য—এ বিষয়ে সকলেই একমত ছিল। এবং সকলেই প্রাণ বিসর্জন করতে উন্মুখ ছিল কিন্তু কী করে যে সেই দুঃসাধ্য কাজ করা সম্ভব তার দৃষ্টান্ত দেখাতে দলপতিদের কেউই রাজি ছিল না।


প্রকৃতপক্ষে নায়ক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজের জীবনের পূর্বকথা স্মরণ করতে গিয়ে নিজের ওপর এবং তৎকালীন মেকী বিপ্লবীদের ও তাদের কর্মপন্থার প্রতি বিদ্রূপ করেছে। পড়াশোনা না করে ভ্রান্ত পথে দেশসেবক হবার উচ্ছ্বাস আবেগকে কটাক্ষ করেই নায়ক স্বগত মন্তব্য করেছে, যে সে কলকাতায় এসেছিল কালেক্টর অফিসের নাজির বা সেরেস্তাদার হবার জন্যে লেখাপড়া করতে। কিন্তু হঠাৎ নবযৌবনের উৎসাহ উদ্দীপনায় দেশ সেবার ভ্রান্ত পথে পরিভ্রমণ করে অবশেষে স্তব্ধ হয়েছিল। ইচ্ছা ছিল মাসীনি, গারিবাড়ি হবে কিন্তু হল শেষে নেওয়াখালি বিভাগের ছোট এক শহরের স্কুলের সেকেণ্ড মাস্টার।