'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে বিন্দু-নন্দলাল আখ্যানটির শৈল্পিক উপযোগিতা বিচার করে বিন্দু ও নন্দলাল চরিত্রের বিশ্লেষণ করো।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা' মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একখানি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। প্রকরণ-বিন্যাসের নৈপুণ্যে ও জীবন রহস্য উদ্ভাবনে উপন্যাসটি বাঙালী পাঠক মনে চিরস্থায়ী স্থান গ্রহণ করেছে। উপন্যাসটির মূল ধারা শশী-কুসুম-কাহিনী। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিন্দু-নন্দলাল, মতি-কুমুদ, যামিনী-সেনদিদি প্রভৃতি উপকাহিনী। কিন্তু এই উপকাহিনীকে জৈব ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করার জন্য শিল্পীর যে শিল্পনৈপুণ্য প্রয়োজন, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষ শিল্পী। তিনি উপন্যাসের গঠন সম্পর্কে সচেতন। তাই উপন্যাসের মূল motif কে উপলব্ধি করে উপকাহিনীর সঙ্গে তাকে যুক্ত করেছেন। শশীর দৃষ্টিতে তার চেতনার দর্পণে জীবন-রহস্য, তাৎপর্য প্রতিফলিত হয়েছে। শশীর পরিবারের বাইরে পাড়ার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ, আত্মিক যোগসূত্র হিসেবে নানা কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। গ্রামজীবনের নতুন মাত্রায় এসেছে বিন্দুর জীবন পরিবর্তনের অধ্যায়। মতির প্রেমের সূত্র ধরে নতুন জীবনের পথে অভিযাত্রা সবই চরিত্রগুলির জীবনরহস্য সন্ধান। উপন্যাসের নানা উপবৃত্তে এই জীবনরহস্যসন্ধান নানাভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনের স্বরূপসন্ধানই ঔপন্যাসিকের প্রধান অভিপ্রায়। এই রহস্যসন্ধানই ফুটে উঠেছে নানা আখ্যানে, নানা বৃত্তে। উপন্যাসে বাস্তবতার তাৎপর্য বুঝতে গেলে নানা আখ্যানকে বিশ্লেষণ করতে হবে।


বিন্দু নন্দলাল উপাখ্যানের শৈল্পিক আবেদন নির্ভর করেছে কাহিনীর অপ্রচলিত জীবন চর্চার সুরে। এই জীবন সাধারণ দাম্পত্য নয়। তাই এই অপ্রচলিত আখ্যান তার তীব্রতা ও বৈচিত্র নয়, নরনারী হৃদয়ানুভূতির এক নতুন দিক তুলে ধরেছে, তা করুণ ও ট্র্যাজিক। শশীর পিতা গোপাল দাস ব্যবসায়ী। দুর্নীতির ব্যাপারে তার কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। দালালি-মহাজনি এমনকি জীবন্ত মানুষের কেনাবেচার ব্যাপারে দালালি করে গোপাল নিঃসঙ্কোচে। গোপালের জীবনের স্মরণীয় কীর্তি নন্দলাল-বিন্দুর বিবাহ। নন্দলাল পার্টের কারবার উপলক্ষে গাওদিয়ায় এসে পড়ে। চারিদিক থেকে পাট সংগ্রহ করে জমা করবার ও চালান দেবার সুবিধের জন্য একটা মধ্যবর্তী গ্রাম খুঁজে বার করার উদ্দেশ্যে বছর সাতেক আগে সে একবার এদিকে এসেছিল। গোলাপ দাস তাকে নিজের বাড়ি ডেকে আদরযত্ন করে ঘরের মানুষের মত স্থান দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে কতখানি উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল, তা বোঝা যায় গ্রামবাসীরা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে যখন বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিবাহ দিয়ে দেয়। বিন্দু-নন্দলালের বিবাহের ব্যাপারে একটা উত্তেজনা ও সামাজিক গণ্ডগোলের ভূমিকা তাকে চিহ্নিত করে। “তারপর বউ লইয়া সেই যে কলিকাতায় গেল—গাওদিয়ার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রহিল না।" গ্রামের লোক ঠিক খবর রাখে না। হয়ত নন্দলাল-বিন্দু দম্পতি সুখেই আছে। ইতিমধ্যে একবার মাত্র বিন্দু তিনদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেছিল—অলঙ্কারাঢ্য তার শরীর দেখে গ্রামের লোকের বিস্ময়ের কোন শেষ ছিল না। “একেবারে যেন বাঈজি, তবু হয়ত বিন্দু সুখে নাই।”—বিন্দুর এই দুঃখ অনুমানাত্মক। নন্দলালের আর একটি স্ত্রী আছে, চরিত্র তাহার ভাল নয়, গ্রামবাসী ভেবে তৃপ্তি পায় যে বিন্দু হয়ত সুখে নাই। গোলাপ শুনে মনে মনে বলে, লক্ষ্মীছাড়ার দল। নন্দলাল সত্যই লক্ষ্মীছাড়া। সে কুমুদ নয়। তার উচ্ছৃঙ্খলতার রূপ স্বতন্ত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বিন্দু-নন্দলাল আখ্যানের মধ্যে দেখেছেন জীবনের আর এক রহস্য, যেখানে পুরুষের অমিতাচারের মধ্যে, নারী সম্ভোগের দুর্নিবার তৃয়ার মধ্যে শেষ পর্যন্ত পরাজয়ের সুর বাজে। বিন্দু শশীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে আছে। বিন্দুকে নন্দলাল ত্যাগ করে নি। কিন্তু বিন্দুর সব স্বাধীনতা নন্দলাল হরণ করেছিল। শশীকে কোন খবর না দিয়ে নন্দলাল গাঁয়ে এসেছে। এতে শশী বিস্মিত হয় নি। কারণ বিবাহের পর থেকে সে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছে। কখনো কোন পত্রযোগে যোগাযোগ করে না। স্বামীকে লুকিয়ে বিন্দু প্রথম প্রথম চিঠি লিখত। নন্দলাল এটা টের পেয়ে বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার আদেশ দেয়। স্বামীকে লুকিয়ে একবার সে বাপের বাড়ি এসেছিল। নন্দলাল তখন বোম্বে গিয়েছিল। কিন্তু এই গোপন ব্যাপার সে গোপন রাখতে পারে নি। বাবার অসুখের কথা শুনে বিন্দু সেখানে গিয়েছিল। সে আদরের সুরে বলে “রাগ করেছ?" প্রত্যুত্তরে তাকে ‘ছোটলোকের বাচ্চা' বলে মুখ ভেঙিয়ে ‘রাগ করেছ' কথাটির বিকৃত প্রতিধ্বনি করে। নন্দলালের এই বৃঢ় ও কর্কশ রূপটি নন্দলালের কাছে হয়ত শেষ পর্যন্ত গলগ্রহ হয়ে উঠেছিল। “গছাইয়া দেওয়া বৌ, প্রাণভয়ে গ্রহণ করা বৌ। লেখাপড়া-নাচ-গান কিছু না জানা বৌ, জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি।” এটা একটা রহস্যজনক ব্যাপার যে বিন্দুকে নন্দলাল ত্যাগ করে নি কেন? বিন্দুকে নন্দলাল গয়না দেয়, কাপড় দেয়। কিন্তু কেন, সে এক রহস্য। বিন্দু ধার করা গয়না নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছিল? "জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে, কলকাতার অনামী রহস্য। কলকাতায় থাকিয়া পড়িবার সময়ও শশী যাহা ভেদ করিতে পারে নাই।” নন্দলাল নানাভাবে অপমানিত করেছে বিন্দুকে। নন্দলালের বাড়িতে বিন্দু বধূজীবন যাপন করেছে কিনা সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন আভাস শশী পায় নি। বিন্দু সে প্রশ্ন এড়িয়ে যেত। শুধু বলেছে, নন্দলাল ঝগড়া করেছে, যে সে চলে এসেছে। ঝি-চাকরের অভাব নেই, প্রাচুর্যও যথেষ্ট। ঘর দামী আসবাবে ভরতি। বিন্দুর জন্য লব্ধ বিলাসিতার আয়োজন যথেষ্টই করেছে। তবু এ রহস্যের শেষ নাই যে, বিন্দু কেন অসুখী, কেন স্ত্রীর মর্যাদা পায় না। শশী বাড়ি গিয়ে দেখে বিন্দুর ভাব অমায়িক, বিন্দু সাদাসিধে। প্রশ্নের পর জেনেছে, নন্দলাল সে বেলা আসবে না। আবার শশী কতদিন গিয়ে দেখেছে "বিন্দু অমায়িক নয়, বিন্দু রহস্যময়ী। বিন্দু মহাসমারোহের সঙ্গে প্রসাধনে ব্যাপৃত হইয়া আছে, কথা বলিবার সময় নাই। এক ঘন্টার মধ্যে নন্দলাল আসিবে।” এসবই জীবনের অজ্ঞাত রহস্যের পরিচয়। নন্দলাল দেশে আসে, কিন্তু তাদের বাড়িতে আসে না। নন্দলাল ত’ অনায়াসে গোপালকে ক্ষমা করতে পারে। জোরজবরদস্তি নয়, সে নিজেই দেখে পছন্দ করে বিন্দুকে বিবাহ করেছিল। এদের অপরাধে শাস্তি পেয়েছে বিন্দু। এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। অবশেষে নন্দলাল এসেছে। সঙ্গে এনেছে একটি চাকর। নন্দলাল অনেক বেশি বুড়ো হয়ে গেছে, বাবু হয়ে গেছে। কলকাতার বাবু কলকাতা ছেড়ে আসবার সময় দশজনের জন্য নৌকা ভাড়া করেছে এসেই নন্দলাল তাকে বলে যে সে এবেলায় ফিরবে। শশী তাকে নৌকা ছেড়ে দিতে বলে, তাদের নৌকায় ফিরে যাবার কথা বলে। নন্দলাল জানায় কাজ শেষ করে তাদের বাড়ি সে যাবার সময় পাবে কিনা সে জানে না। এইভাবে নন্দলাল শশীকে অপমানিত করে তুলল, “শশী এ অপমান হজম করিল।" নন্দ বাজিতপুরের কাজে এসেছে। শীতলবাবুর সঙ্গে দেখা করেই আবার নৌকা খুলবে। শশী আরও মসৃণ ও স্নেহসিক্ত করে তাকে অনুরোধ করল যে তার বাবা হয়ত নিজে আসতেন, শরীরের জন্য আসতে পারলেন না। কিন্তু এত অনুরোধ সত্ত্বেও নন্দর সময় নেই। হাতে অনেক কাজ। শশীর মনে জ্বালা ধরছিল। কিন্তু সে কিছু প্রকাশ করে নি। গাওদিয়ার মোটরগাড়ির দিকে নন্দ থেকে থেকে তাকিয়ে দেখছিল। পরে শীতলবাবুর বাড়ি কতদুর তা জিজ্ঞাসা করল। শশী উত্তর দিল শীতলবাবুর বাড়ি গাঁয়ের শেষপ্রান্তে। নন্দ জিজ্ঞাসা করল যে ঘোড়ার গাড়ি-ট্যাক্সি পাওয়া যায় কিনা। চাকরটা সে পাঠিয়ে দিতে পারে যাতে গাড়ি-ট্যাক্সি সে ডেকে আনতে পারে। শশী তাকে বলল যে এই গাড়ি বাবুদের বাড়ি যাচ্ছে, সে যেতে পারে। তখন নন্দ বলল যে সময় থাকলে তাদের বাড়ি সে যেত। তখন শশী মন্তব্য করে সময় না থাকলে আর কথা কি। নৌকায় গিয়ে সুটকেশ থেকে আয়না চিরুনি বার করে নন্দ চুলটা ঠিকঠাক করে নেয়। পানজর্দা মুখে দিয়ে দামী শাল গায়ে দিয়ে মোটরে উঠল নন্দ। ভাবটা এই যে সেই যেন মোটরের মালিকানা স্বত্ব পেয়েছে। শশী নন্দকে বলল যে সে যাক, তার (শশীর) একটু কাজ আছে। বিন্দুকে নন্দ আলাদা বাড়ি করে দিয়েছে। দাসদাসী-দারোয়ান আর বিলাসিতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিন্দুর বাড়ি যে পাড়ায় সে পাড়াটা ভাল নয়। এর পর আড়াই বছর পর শশী বিন্দুকে দেখতে যায়। সেই নিন্দিত পাড়ার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। শশীর কাছে বিন্দু গাওদিয়ার খবর নেয়। নন্দ নেই। বিন্দুর খোকাখুকি হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় বিন্দুর উত্তর দেয় “মরে গেল যে”। শশী চমকে উঠল। বিন্দু তার বোন, এক রক্ত দুজনের শরীরে অথচ বিন্দু তার অজানা। বিন্দুকে কাছে ডাকতে বিন্দুর চোখে জল আসে। অনেক দিনের অভিমান চোখের জলের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। তারপর সে সব খুলে বলতে শুরু করে। বিন্দু জানায় যে নন্দ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তাকে স্ত্রীর মতো নয়, রক্ষিতার মতো রাখে। “গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করা কলকাতার অনামী রহস্য শশীর কাছে স্বচ্ছ হইয়া আসে।" তারপর যে ঘরে নন্দ বসেন, সেই রুদ্ধ ঘরে নিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে -সব দেখায়। হারমোনিয়াম, বাঁয়া-তবলা, দেওয়ালে অশ্লীল ছবি, মেঝে জুড়ে ফরাস পাতা। আলমারীতে নানা লেবেলের বোতল। তাকে জোর করে এসব খেতে হয়। বিন্দু হাবভাব দেখিয়ে নন্দকে ভুলিয়েছিল বলে এই তার শাস্তি। অবশ্য অসুখবিসুখ হলে সেবা করে। শশী বিন্দুকে তাদের সঙ্গে দেশে চলে যেতে বলে। এতকাল পরে বিন্দুর প্রত্যাবর্তন দেখে গ্রামের লোক অবাক। কিন্তু মোটর নেই, গয়না নেই, রিক্ত বিন্দু। সকলেই উৎসুক। সেনদিদি এসে বিন্দুকে যন্ত্রণা দেয় বেশী। বিন্দুর খবর নেবার জন্য কুসুমও আসে তালবনে। বিন্দু কাঁদে। শশীর ওষুধ খায়। নন্দর প্রতি বিদ্বেষ বিন্দুকে ভাল করে তুলতে সক্ষম। কিন্তু বিন্দুর মন হাহাকার করে নন্দর জন্য। “সংসারে এরকম অদ্ভুত মেয়ে, দু'চারটে থাকে"। বিন্দু তাদেরই একজন। একদিন বই পড়ার ছল করে শশীর কাছে তার আলমারির চাবিটা চাইল বিন্দু। তারপর একদিন রোগী দেখে ফেরার সময় দেখে বিন্দু বিষ খেয়েছে। গ্রামে বিন্দুর কলঙ্ক রটল। বাড়ির মেয়ে অন্তঃপুরে মদ খেয়ে বীভৎস ব্যাপার করে এ তা কল্পনাতীত। বিন্দুর মাতলামির প্রত্যক্ষদর্শী না হতে পারার জন্য সকলে দুঃখিত। বিন্দুর অন্তর্লোক তৈরী করার বাসনায় শশী তাকে এনেছে, কিন্তু কিছুই করতে পারল না। এদিকে নন্দর সঙ্গে গোপালের দেখা হওয়াতে নন্দ রাগারাগি করেছে. বিন্দুকে রেখে আসতে বলেছে। বিন্দু নন্দর কাছে ফিরে যাবার আগে বুঝল যে নন্দর কাছে চলে যাওয়া ছাড়া তার আর গতি নেই। বাড়িতে বিন্দুকে পৌঁছে দিয়েই চলে আসতে গেল শশী। শেষে নন্দ তাকে বলল যে সে বিন্দুকে বাড়ি নিয়ে যাবে ভেবেছে। এ বাড়িটা বেচে দেবে সে। নন্দ স্বীকার করল যে বিন্দু একবার চলে গেছে, পরের বার যদি জন্মের মতন চলে যায়। এই বাড়িতে স্বাধীনতা ছিল, আরাম ছিল, সে কাজের মানুষ কাজ নিয়ে থাকে। বিন্দুর যদি ভিড় ভাল লাগে ত চলুক। শশীর মনে প্রশ্ন এতকাল পরে বিন্দু ঘোমটা মাথায় টেনে কি করে শাশুড়ী-ননদ-সতীনের সংসার করবে? শেষ পর্যন্ত বিন্দু অবশ্য আসে নি। জেদী মেয়ে বিন্দু নন্দকে চালিয়ে বেড়ায়। তোষামোদ সত্ত্বেও সে শেষ পর্যন্ত আসে নি।


মানিকের জীবনরহস্যসন্ধানের যাত্রায় বিন্দু আর একটি অনন্য চরিত্র। বিন্দু-নন্দলাল উপকাহিনী সংযোজনার উপযোগিতা এই, যে অপরিচিত জগতের বার্তা নিয়ে আসে যে সব চরিত্র, পুতুল নাচের ইতিকথায় সেই সব আখ্যানই যুক্ত করা হয়েছে।


বিন্দু চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার জেদ। তার এই অনমনীয়তা ও আসক্তি একই সঙ্গে যেমন তাকে এক অদ্ভুত জীবনের সঙ্গে একাত্ম করেছে, তেমনি তাকে এক অন্তহীন জীবনজ্বালায় জর্জরিত করেছে। প্রেমের বিষামৃত পান করে বিন্দু নিজেকে নিঃশেষ করেছে, নন্দর লম্পট স্বভাবের প্রতিরোধ করতে না পেরে। তার দেওয়া সব শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছে, আবার নন্দকে ছাড়া কোন বিন্দু সে খুঁজে পায় নি। সে কোন আশ্রয় খুঁজে পায় নি। বিন্দু গাওদিয়ায় এসে শশীর কাছে থেকে পূর্বজীবনের স্নিগ্ধ মসৃণতাকে আর ফিরে পায় নি। সে নন্দলালের জীবনের ছায়াকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। বিন্দুর এই পরিবর্তন তাকে চিরকালের মত গাওদিয়ার সংসারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করেছে, নন্দলালের কাছেও ফিরে সে সুখ ও স্বস্তি পায় নি। এই অস্বস্তিকর বিচ্ছিন্নতা তাকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। সে নন্দর সংসারে সকলের সঙ্গে এক হয়ে থাকতে পারে নি।


নন্দলালের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তার অস্বাভাবিক জীবন। সে বিন্দুকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় নি, তাকে রক্ষিতা করে রেখে তাকে শাস্তি দিয়েছে। তাকে সুরা ও আনুষঙ্গিকে ডুবিয়ে রেখে তার মনকে পরিবর্তিত করতে চেষ্টা করেছে। বিন্দুর পরিবর্তিত ব্যক্তিত্বে এই ব্যাপারটা চিরকালের জন্য ছাপ রেখে দিয়েছে। নন্দ কলকাতার বাবু-সম্প্রদায়ের মানুষের মত বিলাসব্যসনে আসক্ত, সে মিথ্য কথা বলে, নানা আড়ম্বর দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চায়। প্রতিহিংসাগ্রহণ তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য, তাই শশীদের সংসারের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কিন্তু সে পরাজয় স্বীকার করে। বিন্দুকে আঘাত করে শেষ পর্যন্ত নিজেই আঘাত পায়। তার এই পরাজয় তাকে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক করে তোলে। আন্তরিকতাহীন ও অসৎ মানুষের পক্ষে যথাযোগ্য পরিণামই সে লাভ করেছে। নন্দলালের জীবনে আছে ছন্নছাড়া রূপ। বড়বাজারের নন্দলাল কোং-র মালিক নন্দলাল আর্থিক স্বচ্ছলতায় যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, তার দুটো সংসারের যন্ত্রণার ছবি তার অস্বাভাবিক জীবনে আছে। তার বাবুগিরির অনিবার্য পরিণাম মানসিক যন্ত্রণা। বিন্দুকে যন্ত্রণা দিয়ে সে নিজেই দুঃখকষ্টে রিক্ত ও অবসিত হয়ে গেছে। তার চরিত্রের ‘radical defect' এর ফলশ্রুতি সে পেয়ে গেছে।