'পয়োমুখম' গল্পটির আখ্যান গ্রন্থনে ও কেন্দ্রচরিত্রচিত্রণে লেখকের নির্মোহ নিষ্ঠুর বাস্তবতাবোধের প্রকাশ ঘটেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু গল্পটির পরিণতিতে লেখক পাঠকের প্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আলোচনা করো।

কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত সংসার জীবনে প্রতিষ্ঠিত, পুত্রকে জীবিকায় সাহায্যের জন্য স্বয়ং তাকে শিক্ষাদান করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সংস্কৃত ভাষায় রচিত বলে তিনি পুত্র ভূতনাথকে সংস্কৃত শিক্ষা দেন কিন্তু সে কবিরাজীর জন্য ব্যাকরণ পাঠের তাৎপর্য বোঝে না। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়তে পড়তেই ভূতনাথকে বিবাহ করতে হয় এবং কৃষ্ণকান্ত এই বিবাহে সাতশত টাকা পণগ্রহণ করেন। পণের অঙ্কটা যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার জন্য তাঁর মিথ্যাভাষণে কোনো দ্বিধা দেখা যায় না। কৃষ্ণকান্ত চরিত্রের অর্থলোভ ও নীতিহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর আচরণে। অথচ পুত্রের আয়ুর্বেদ শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করবার জন্য তাঁর চেষ্টারও ত্রুটি নেই। পুত্রকে ঔষধ প্রস্তুত করা শেখান, বিবিধ রোগবিকারে শাস্ত্রোক্ত বিবিধ ঔষধের শিক্ষা, রোগী দেখার প্রত্যক্ষ জ্ঞানে সাহায্য—এসবই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত করে থাকেন। তাঁর এরূপ আচরণে সামাজিক জীবনে পিতার পুত্রের প্রতি স্বাভাবিক আচরণ ও দায়িত্বই প্রকাশ পায় বলে মনে হয়, কিন্তু সমগ্র গল্পে কৃষ্ণকান্তের ঐহিক সম্পদের আকাঙ্ক্ষা এবং তা লাভ করবার জন্য অমানবিক ক্রুরতায় তার মনুষ্যত্ব বর্জিত যে রূপটি ফুটিয়ে তোলে তা থেকে বোঝা যায় পুত্রের ব্যবহারিক জীবনে সাফল্য ও অর্থাগম নিশ্চিত করবার জন্যই কৃষ্ণকান্তের এরূপ পরিশ্রম ও পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার সযত্ন প্রচেষ্টা। পুত্রবধূ মাত্র নয় বছরের মণিমালাকে ঔষধ প্রয়োগে হত্যা করতে কৃষ্ণকান্তের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। স্পষ্টতই একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ডে তিনি অগ্রসর হন। কারণ তিনি জানেন ভূতনাথের দ্বিতীয়বার পণলাভে আরো অর্থাগম হবে। আর সমস্ত পণের অর্থ হস্তগত হবে তাঁরই। এই ভয়ঙ্কর চরিত্রটির রূপায়ণে জগদীশ গুপ্ত কোনও দীর্ঘ বর্ণনা দেন নি, কোনও আবেগের প্রশ্রয় দেন নি, সম্পূর্ণ নিরাবেগ মিতভাষণে ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে চরিত্রটিকে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছেন। কৃষ্ণকান্তের অন্তরে যে নির্মমতা রয়েছে, হত্যা করবার উপযোগী যে কঠিন স্নায়ুর তিনি অধিকারী তা বাইরে থেকে তাকে দেখে বোঝা যায় না। তাঁর অনুপস্থিতিকালে বৈবাহিকের কাছ থেকে আসা মণি-অর্ডারের টাকা ভূতনাথের হাতে পড়ায় তাঁর ভয়ঙ্কর শয়তানী ধরা পড়ে যায়। তৃতীয় পুত্রবধূকে হত্যার যে আয়োজন তিনি করেছিলেন তাও পুত্রের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং পুত্রের তীব্র অভিযোগের সামনে তাকে নির্বাক থাকতে হয়।


কৃষ্ণকান্তের জীবনে চরম আঘাত আসে তাঁর পুত্রের কাছ থেকেই। ভূতনাথ তাঁকে শুধু অপমান করে না, নিজের হাতে তাঁরই দেওয়া যন্ত্রণাদায়ক বিষ তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলে, “পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।" কৃষ্ণকান্ত চরিত্রের মূল উপাদান বিষয়-কামনা, বিকট অর্থলিপ্সা—অন্য সবকিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ। তাঁর চাতুরী ও শয়তানী ধরে ফেলে ভূতনাথ যখন তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তখন এই ভয়ঙ্কর হত্যাকারী ভীত হয়ে কাপতে থাকে। স্পষ্টই বোঝা যায় আত্মহননের পথে না গেলে এই ঘৃণা ও তিরস্কারের মধ্যেই বাকি জীবন তাকে বেঁচে থাকতে হবে। পুত্রের কাছে শয়তানী উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ায় কৃষ্ণকান্তের ওপর যে প্রত্যাঘাত এসেছে তা শয়তানের যোগ্য শাস্তি বলেই পাঠকের মনে হয়। এই নিষ্ঠুর ও মানবিক চরিত্রটির চরম শাস্তি লাভ করা উচিত এই বোধ পাঠক গল্পের শুরু থেকেই অনুভব করতে থাকেন। লেখক জগদীশ গুপ্ত গল্পের পরিণতিতে পাঠকের সেই প্রত্যাশাকেই পূরণ করেছেন।