কমলকুমারের ভাষা ও রচনাশৈলী স্বতন্ত্র স্বাদের আলোচনা করো।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কমলকুমার মজুমদারের রচনার মধ্যে কাহিনি ও ব্যঞ্জনার চেয়ে অধিক আকর্ষক হল তার ভাষা ও রচনা নৈপুণ্য। অত্যন্ত ছোট একটা কাহিনি বীজকেও তিনি কেবলমাত্র ভাষা ও উপস্থাপন কৌশলে অনবদ্য করে তুলেছেন। বলা বাহুল্য, এই রকম রচনা-শৈলী বাংলা সাহিত্যে বিরল দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে তাঁর মতিলাল পাদরী গল্পটি উপস্থাপনায় তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা অনেকটা পয়েন্টিলিস্টিক ছবির মতো, সোজাসুজি ও পার্শ্ব দৃষ্টিতে একই চিত্রের দুটি রূপ ফুটিয়ে তোলার কৌশল। একটি কাহিনির মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি দুটি চিত্ররূপ। যার ফলে মতিলাল পাদরীর পাশাপাশি ভামরের জীবন বৃত্তান্তের প্রতিও পাঠকের কৌতূহল সমধিক লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী। এ ক্ষেত্রে তারই অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে।


কমলকুমারের ভাষার মধ্যে কবিত্ব যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি দেখা যায়, কাহিনির মধ্যে বাস্তবতা আনার জন্যে চরিত্রগুলির মুখের ভাষায় আঞ্চলিকতার ছায়াপাত ঘটিয়েছেন। যেমন, চমৎকার কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা ভঙ্গি দেখা যায় আলোচ্য গল্পের এই অংশে— “চন্দ্র সূর্য তারকা নেই; শুধু প্রসিদ্ধ রক্তের জোয়ারের উত্তাল অলৌকিক শব্দ। যে রক্ত স্তিমিত আলোয়, বিদ্যুৎ এমন কি, কালোর পরিবর্তে অধিক লাল। মাংসল বীজ বিদীর্ণ করে ফেটে ছিড়ে, অন্ধকারবিরোধী একটি হাতিয়ার আসছে, অথবা ধরা যাক, আর একটি বৃক্ষ; যে বাসা দেবে, ছায়া দেবে, বৃষ্টি আনবে! অথবা শুধু মাত্র সন্দেহের পিণ্ড যা অজস্র আখছার।”


আবার পাওয়া যায়, চমৎকার উপমা সম্ভারও। যেমন, “এইটুকু তিনি বুঝেছিলেন যে মৃত্যুর গোঙানি এ নয়। এ এক অন্য পুরুষ এই বেদনার কাছে নাবালক। তবু হলকর্ষণের শব্দে যেমন আনন্দ থাকে এখানে সেটুকু ছিল।”


কিন্তু এই কাব্যশৈলী গল্পের সংলাপ অংশে নেই। সেখানে যথার্থই মাটির মানুষগুলো কথা বলেছে যেন। যেমন বর্ষার রাত্রে ভুলুয়া এসে পাদরীকে যখন বলছে—“যেমনি বরখা...কি বা ঠাণ্ডা গো...” কিংবা ছেলে প্রসব করানোর পর বীণার কথা, “হে হো বেটা-ছানা গো ছেইলা হে।” কিংবা, “খাড়াও গো, ছানা দেখবে কি গো? এক ঠেকা ছেইলা হে! গতর কি বা রাজপুত্তুল গো, হে হে রাজপুত্তল।”


অন্যদিকে ফুলল, যদু, বদন হিজড়েদের কথার মধ্যেও রয়েছে মাটির গন্ধ—গল্প রচনার খাতিরে তাকে সাহিত্যের মান্য ভাষায় আনার চেষ্টা করেননি কমলকুমার। গির্জা ঘরে ভামরের সন্তান হবার পর ফুলল তাই বিরক্ত হয়ে বলতে পারে, “হে হে বেগোড় কি বললাম গো, ন্যায় কথাই পাড়লাম... কুহক রহস্য নাই…”


সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলের এই সব দরিদ্র শ্রেণির মানসিকতা ও ধর্মভীরু বিশ্বাসের কথাও বেশ সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন কমলকুমার। পাদরীর কথায় বিশ্বাস করে তারা সদ্যোজাত শিশুটিকে ‘দূতঠাকুর' ভাবতে শুরু করেছে। অথচ, দূতঠাকুরের মা ভামরকে তারা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পারেনি। বদন হিজড়ের মতো হাজা মাজা লোকও গান গাইতে গাইতে ভামরকে দেখে কুৎসিত ভাবে চোখ মটকেছে।


অন্যদিকে বিশেষ ভাবে ফুটে উঠেছে মতিলালের ধর্মবিশ্বাস। যে বিশ্বাসের বলে সে অজ্ঞাতকুলশীল ভামরের সন্তানকে ঈশ্বর প্রেরিত দূত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং শিশুপুত্রের সামনে বসে প্রার্থনা করতেন, তার পা দুটি মাথায় ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন। এই বিশ্বাস কিন্তু কোনো মানসিক বিকার নয়। এই বিশ্বাস তাঁর বাইবেলের প্রতি অসন্দিগ্ধ আনুগত্যই প্রকাশ করেছে।