'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসে সালী ও পরমী চরিত্র বিশ্লেষণ করে লেখিকার নারী চরিত্র সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করো।

বীরসা মুণ্ডা ইতিহাসের নায়ক। সে অধঃপতিত মুণ্ডা জাতির মুক্তির জন্য এক দেশব্যাপী আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে। দুর্জয় শাসকশক্তির বিরুদ্ধে যারা দলে দলে যোগ দিয়েছে তাদের বলা হয়েছে বীরসাইত। এই উপন্যাসে নারীরা এসেছে বীরসার কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা হিসাবে। কিন্তু তাদের নারীত্বের নানা সমস্যা জর্জরিত হয়েও তারা এই দুঃসাধ্য ব্রতে যোগ দিয়েছে, কেউ অন্তরের গোপন বহ্নিকে জ্বালিয়ে, কেউ উল্টো স্রোতে। সালী ও পরমী এই দুই নারী চরিত্র এইভাবে বীরসার সঙ্গিনী হয়েছে। দু'জনের প্রেরণা স্বতন্ত্র ও পরিণামও স্বতন্ত্র।


সালী: এই উপন্যাসে এক অসামান্য চরিত্র সালী। নারীত্বের নানাদিক উন্মোচনে তার চরিত্র গভীর ও জটিল। আবেগ ও ত্যাগের মাহাত্ম্যে এই চরিত্র এক নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। সালী মানকি ডোনকার পত্নী। মানকি ডোনকা বয়সে পরিণত, তাই দুর্বার যৌবনা সালীর যৌবন-ক্ষুধা অতৃপ্ত থেকে যায় এই ‘আরান্দি'-তে। জীবন শুরু হয় অপূর্ণতা ও বেদনা দিয়ে। এই অপূর্ণতা অনেক বেশী বেড়ে যায় যখন ডোনকা 'বীরসাইত' হয়ে বীরসার 'উলগুলানের' মহৎ যজ্ঞে অংশ নেয়। ডোনকা ভগবানের কাছে’ ডাক পায়, চলে যায় সেই উদ্দেশ্যে। প্রথমে মনে হয়েছিল “পেটে ভাত, পরনে কাপড়, মাথায় তেলের ভরসা বড় ভরসা।” কিন্তু পরে বুঝেছিল এই অন্নবস্ত্রের দাবী ছাড়াও জীবনের অন্য দাবী আছে। জীবনের অভিযোগ জানাতে বীরসার কাছে গিয়ে সেও ‘বীরসাইত’ হয়ে যায়। তার মুগ্ধতা হয় অন্য স্তরের—“আমিও কাপড় হলুদ রঙ করে নিব কুসুম ফুলে।”


সালী বীরসার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়। বীরসার কর্মযজ্ঞ যে অধঃপতিত জাতির লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য শক্তিশালী ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সে যে লড়াইতে নেমেছে একথা সালী বোঝে। বীরসার আন্দোলনের দুর্দিনে অনেকে প্রচার করতে থাকে যে 'বোঙাবুঙি’-র বদলে বীরসাকে ভগবানের পদগৌরব দেওয়ায় মুণ্ডাদের জাতিগত দুর্গতি দেখাদিয়েছে। সিংবোঙার থানে মুর্গি বলি হতে থাকে। অনেকে বীরসার দল থেকে চলে যেতে থাকে। কিন্তু সালী বিরসার আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হয় না। সে বীরসার 'উলগুলানের' সমর্থক হয় ও নীরবে তার জন্য যথাসাধ্য কর্ম করতে থাকে ছদ্মবেশে। সে ধানী মুণ্ডাকে রাতে আশ্রয় দেয়। পাছে পুলিশের চোখে ধরা পড়ে তাই তাকে গুহায় লুকিয়ে রাখে। পুলিশ ধানীর খোঁজ করতে আসে, ধানীকে না পেয়ে ধানের মরাই ভেঙে চুরে চলে যায়। এ সবই সহ্য করে সালী। তাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়। আবার বিরসা বিরোধীদের সঙ্গেও লড়াই চালাতে হয়। বিরসা জেলে বন্দী, তবু বিরসার জন্য সে নানাভাবে কাজ করে চলে।


বিরসার সমর্থন চক্রকে জানার জন্য সালী জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরে। শাক-কচু-কলা বিক্রির আছিলায় সে তার ঝুড়ি ভর্তি রাখে কুচিলা বিষ মাখানো তীরে যা বীরসাইতদের চালান দেয়। এইভাবে পরোক্ষভাবে সে ‘বীরসাইত’-এর কাজ করে। এই কাজে তাকে বিপদে পড়তে হয়। তার যৌবন পুষ্ট শরীরের আকর্ষণ পুলিশের লোককেও বিচলিত করে। উপন্যাসের চতুর্দশ পরিচ্ছেদে এমনই একটা দৃশ্য লেখিকা অঙ্কিত করে দেখিয়েছেন সালীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কিভাবে তাকে ভরতের লোভী দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়েছে। ভরত তাকে বলে ‘ধানীকে ধরা করালে তোর বিশ-পঁচিশ টাকা মিলত রে।” সালী কিন্তু এই প্রলোভনে লুদ্ধ হয় না। উত্তরে সে ভরতকে বলে ‘ধানীরে দেখলে আমি ওর পা ভেঙে দেব তা বাদে তোমারে খবর দিব।” এই অভিনয় ক্ষমতার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন সে পথের মাঝে হঠাৎ প্রসব ব্যথার অভিনয় করে ভরতকে সরিয়ে দেয়।


“হঠাৎ হাত থেকে ঝুড়ি নামাল সালী। পেট খামচে ধরে বসে পড়ল। 

“কি হল রে সালী?'

ওরে দ্বাপোরে। মা রে

হল কি।

সালী শুয়ে পড়ল কাত হয়ে? বলল 'পেটে দরদ উঠলো গো দারোগা, বুঝি কি হয়া পড়ে”।


এই দৃশ্য সালীর উপস্থিত বুদ্ধি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার প্রমাণ। সে ভরতকে বলেছে, “আকালে সব ক্ষেপা হয়া আছে, দারোগা দেখলে মারবে নিশ্চয়।” অন্ধকার রাতে সালীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখে সন্দেহ করে সালী পহানী। বলে “বীরসার তরে তোর এত।” সাধারণ মানুষের চোখে যা স্পষ্ট হয়, সে কথাই মানী তাকে বলেছে— “বীরসাকে শুধু ভগবান বলে এমন করিস? সি দলমনা ছেলে, তু দলমনা মেয়া—সালী গর্জে ওঠে, অমন কথা কারো ভাবতে নাই মানী, মোরও ভাবতে নাই।”


বীরসা সালীর ভগবান। তার স্বপ্ন বীরসা আবার ফিরে আসবে। “সত্যি হয়ে থাকবে শুধু বিরসার ফিরে আসার দিনটা। বিরসা এলে সব পালটে যাবে।” দুবছর বাদে বিরসা ফিরে আসে, ১৮৯৭ সালে নভেম্বরে সে মুক্তি পায়। বীরসাকে পরমীর কথা বলে সালী। তারপর বীরসার উত্তরে “সালীর বুক থেকে যেন পাষাণ নেমে গেল।” বীরসাকে সালী হয়ত ভালোবেসেছে, কিন্তু সেই ভালোবাসার রূপ স্বতন্ত্র। সালীর অন্তরে, মগ্নচৈতন্যের অনুরাগ ভক্তিরূপে ফুটে উঠেছে। লেখিকার বর্ণনায় “সালী বীরসার পায়ে জল ঢেলে দিল। আঁচল দিয়ে জল মোছাল, বসতে নতুন পিঁড়ি দিল।” এই অভ্যর্থনা দেবতার জন্যই মানুষ করে। বীরসা সালীর কাছে দেবতা। সালীর ছেলের নাম রাখল বীরসা। নাম দিল ‘পরিবা'। বীরসা তার হাতে 'হলুদ রাঙানো সুতো' পরিয়ে দিল। বিরসার বিশ্বাস, 'ও হতে মোর নাম থাকবে।' সালী তার শেষ অবলম্বন বিরসাকে দান করে দিল।


সালীর প্রাণশক্তি ছিল অমিত, নিষ্ঠাও ছিল অতুলনীয়। তাই সে বীরসার 'উলগুলানের' কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছে, কখনও আদর্শ ভ্রষ্ট হয় নি। বীরসার প্রতি তার অনুরাগ কীভাবে ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এক বিরাট কর্মযজ্ঞের সামিল হতে হয় সালীর মহিমান্বিত নারীসত্তায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।


পরমী: এই উপন্যাসে পরমী আর একটি চরিত্র যাকে সালীর পাশে দেখলে অন্য সুরের বলেই মনে হয়। স্বল্প পরিসরে পরমীকে চিত্রিত করতে গিয়ে লেখিকা তাকে সাধারণ মেয়ের ক্ষুধা-তৃষ্মা-স্বপ্ন দিয়ে গড়েছেন। সালী যেমন তার মগ্ন চৈতন্যের অনুরাগকে ভক্তিতে রূপান্তরিত করেছে, পরমীর সে ক্ষমতা ছিল না। পরমী একান্তই সাধারণ।


পরমী 'আরান্দি’ চায়, সংসার-সস্তান চায়। “এমন আরান্দি আমি চাই না রে। সে কোথা রইবে, আমি কোথা রইব। স্ত্রী পুরুষে যেমন থাকে তেমন থাকব না। খালি বীরসাইতদের ভাত রাঁধব, হলুদ বাঁটব, তাদের কাজে ছুটোছুটি করব, এমন আরান্দি আমি চাই না।”


সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও কামনা নিয়ে পরমী পূর্ণ। তাই সে বীরসার মত আদর্শবাদীর ঘরণী হতে চায় নি। সে আরান্দির শর্ত বালা-খাড়ু ফিরিয়ে দেয় ও কনু মুণ্ডাকে বিয়ে করে। তার সুখ-সন্ধান স্বতন্ত্র। তাই সালী তার মনের কথা বীরসাকে বলেছে—“ও ঘর চায়, ছেলা চায়, পাঁচটা বিয়াতির মাথায় তেল সিঁদুর দিতে চায়।” এই হচ্ছে সাধারণীর সুখ বৃত্ত।


কিন্তু ভাগ্যচক্র এমন যে, শেষ পর্যন্ত বীরসার পৃথিবীতে এসে পড়ে। “আশ্চর্য, রোগোত্যের কনু মুণ্ডা মরে যাবার পর থেকে পরমী ভগবানের সঙ্গে ফেরে। বীরসার কোনো কথা অমান্য করে না ও। কিন্তু চাল দেখলে ওর মনে হয় বীরসাকে অমান্য করে এখনি কাঠ জ্বেলে ভাত রাঁধে, ভাত খায়। বীরসা ওকে ভাত রাঁধতে দেয় না বলে মাঝে মাঝে মনে হয় ভাত রাঁধি, ভাত খাই। তাতে ভগবান ধরা পড়ে ত পড়ুক।” পরমী বীরসার কথা না ভেবে ভাতের কথা ভাবে। মুন্ডারাজ হলে সব মুন্ডা একদিন ভাত খেতে পারে। এই খোয়াব দেখে সে 'উলগুলানে’ সামিল হতে চেয়েছিল। পরমী পাথরে চাল গুঁড়ো করে জল দিয়ে খাবে। এই অবস্থা থেকে সে মুক্তি চায়। তাই সে ভাত রাঁধতে চায়। বীরসা জানে অনেকের সাধ সে উলগুলানের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার সব নিয়েছে, শেষে পরমীকেও নিয়েছে। সালীকে বলেছে বীরসা “তোর ছেলা, মরদ, ধান, ঘর সব নিলাম। পরমীরও সব।”


পরমী বীরসার ভাবাদর্শের তাৎপর্যকে বোঝে না। তাই সে উল্টো স্রোতের মানুষ হয়ে যায়। সে বীরসার নিষেধ বাণী অমান্য করে নিয়তির টানে শেষ পর্যন্ত ভাত রাঁধতে গেল। আর সেই ভাতের ধোঁয়া থেকেই জঙ্গলে পুলিশ এল বীরসাকে গ্রেপ্তার করতে।


পরমীর মধ্য দিয়ে 'উলগুলানের' নিয়তি আত্মপ্রকাশ করল। পরমী হল 'অরণ্যের অধিকার’-এ এক নিয়তি প্রেরিত চরিত্র।