রবীন্দ্রনাথের 'ল্যাবরেটরি' নামক গল্পটি ছোটগল্প হিসেবে সার্থক হয়েছে কিনা আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ বরাবরই নিজের ধারাকে নিজে ভেঙে এগিয়ে গেছেন প্রগতির পথে। কবিতার ক্ষেত্রে তাকে আমরা বলেছি 'ঋতু পরিবর্তন', যার ফলে সোনার তরী, ক্ষণিকা, মানসী, পুরবী, বলাকা, পুনশ্চ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে পাই নতুন ভাবের, ছন্দের ও নতুন ধার । কবিতা। সেইরকম গল্পগুচ্ছের মধ্যেও ক্রমশ ভাষা ও ভঙ্গির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে যুগচেতনা। তারই পথ বেয়ে বিশ্বযুদ্ধের আগেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলা ছোটগল্পের জগতে এসেছে নতুনতর ধারা। সেই ধারাতেই রচিত হয়েছে রবিবার, শেষ কথা ও ল্যাবরেটরি গল্পত্রয়।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ল্যাবরেটরি যখন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন তার বিজ্ঞাপনে একে ‘বড়োগল্প' বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বস্তুত আকারে গল্পটি এতই বড়ো যে একে আজকালকার ভাষায় উপন্যাসোপম বড়োগল্প বলা যেতেই পারে। কিন্তু ছোটগল্প মানেই যে স্বল্পায়তনিক গল্প হতে হবে তার কোনো মানে নেই। এমন ছোটগল্পও আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অন্যান্য গল্পকারের রচনার মধ্যেও দেখেছি। কাজেই ছোটগল্পের সংজ্ঞা যে তার আয়তনের উপর নির্ভর করে না এ কথা বলাই বাহুল্য। ছোটগল্প প্রকৃতই ছোটগল্প হয়েছে কিনা তা বিচার করার জন্যে কয়েকটি শর্ত সেখানে পালিত হয়েছে কিনা তা দেখা প্রয়োজন। তার মধ্যে রয়েছে বাস্তবতা, স্বল্পকালের কাহিনি, একটি মাত্র শীর্ষবিন্দু বা ক্লাইম্যেক্স, একমুখীনতা ইত্যাদি।


নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর, নন্দকিশোরের স্বোপার্জিত টাকায় নির্মিত ল্যাবরেটরি, তার স্ত্রী সোহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করছিল। সে ল্যাবরেটরির দায়িত্ব অর্পণ করার মতো যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করে অবশেষে রেবতী ভট্টাচার্য নামে এক অত্যন্ত মেধাবী ও সনিষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষককে খুঁজে বার করেছিল। সকলেই এ ব্যাপারে একমত ছিল যে রেবর্তীই এই ল্যাবরেটরি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে একমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তি।


সোহিনীর মেয়ে নীলা। নীলা সুন্দরী এবং সোহিনীর মতোই স্বেচ্ছাচারী। মায়ের গণ্ডির নির্দেশ অমান্য করাতেই যেন তার প্রধান আনন্দ। সেই জন্যে সে নানা ধরনের বন্ধু জুটিয়ে আনন্দে মগ্ন থাকতে চায়। বাইরের লোকেরাও সোহিনীর ল্যাবরেটরি ও টাকার থলি দেখে নীলার সাহচর্য পেয়ে ধন্য হতে চায়। কিন্তু সোহিনীর পরিষ্কার কথা, সে নীলার হাতে ল্যাবরেটরির ভার বা টাকা কিছুই দিতে রাজি নয়। তাই জাগনী ক্লাব নামে নীলাদের এক সংস্থায় রেবতীকে প্রেসিডেন্ট করে ল্যাবরেটরির টাকা আত্মসাৎ করার জন্যে নীলারা রেবতীকে ছলে ভুলিয়ে নিয়ে আসে। রেবতীও প্রথম নারী সান্নিধ্য পেয়ে মোহের ঘোরে বিবেচনা শক্তি রহিত হয়ে ল্যাবরেটরির খরচের জন্যে টাকা চেয়ে ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয় নীলাদের জন্যে ভোজের ব্যবস্থা করে। সেই রেস্তোরাঁয় সোহিনী এসে বুঝতে পারে যে, রেবতী মেধাবী হলেও তরুণীদের পাশ কাটিয়ে চলার মতো ব্যক্তিত্ব তার নেই, তাই এই পথ বেয়ে তার ল্যাবরেটরির সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে। সেই মুহূর্তে সে রেবতীকে ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষের পদ থেকে বহিষ্কার করে দেয়।


এই গল্পের মধ্যে দেখা যায় কোনো অবাস্তব অনুষঙ্গের আবির্ভাব ঘটেনি। সোহিনী তার মৃত স্বামীর শখের ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং রেবতীর মতো যোগ্য ব্যক্তিকে পেয়েও, তার পক্ষে ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করা সম্ভবপর নয় জেনে তাকে ল্যাবরেটরি থেকে বহিস্কার করে দিয়েছে। এর মধ্যে কোথাও বানিয়ে তোলা গল্প নেই—সর্বত্রই চরম বাস্তবের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আলোচ্য গল্পটিকে এই ধারায় যদি বিচার করা যায়, তা হলে প্রতিটি শর্তই সেখানে পূর্ণ হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই বিচারের নিরিখে এটি যে সার্থক ছোটগল্প রূপে নিজেকে জ্ঞাপিত করতে পারে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।