পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের শশীই নায়ক।" ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে শশী-চরিত্র বিশ্লেষণ করে এই উক্তির যথার্থ বিচার কর।

শশী 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে প্রধান চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে এই চরিত্র অসামান্য মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস-সাহিত্যমালার শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'। বাস্তবতা ও আধুনিকতার সংযোগে উপন্যাসটি অসাধারণ মর্যাদা লাভ করেছে। শশী একদিক থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পূর্ব উপন্যাস 'দিবারাত্রির কাব্য’-এর নায়ক হেরম্বর মত সে বিচ্ছিন্নতা ও মনোবিকলনের শিকার নয়। তবু তার জীবন-অভিজ্ঞতার স্বরূপসন্ধান উপন্যাসের প্রধান motif শশীর দৃষ্টিতেই উপন্যাসটির প্রতিটি চরিত্রকে দেখা যায় । শশীর চেতনার দর্পণে উপন্যাসের সমগ্র কাহিনী ও অন্যান্য চরিত্রকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় বলে উপন্যাসে শশীই নায়ক নায়ক বলতে বোঝায় ‘central doing or acting এর সঙ্গে যুক্ত চরিত্র। এইজন্য নায়ককে হতে হয় উপন্যাসের সব বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিচরিত্র। শশী এই বৃহৎ উপন্যাসের নানা ঘটনা ও ‘এপিসোড’-এর সঙ্গে যুক্ত বলেই তাকে নায়ক মর্যাদা দেওয়া চলে। এছাড়া, উপন্যাসে তার সর্বক্ষেত্রে প্রভাবই উপন্যাসটির গতিপথকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। উপন্যাসের গতিধারায় ব্যক্তিচরিত্রের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


শশী ‘চতুরঙ্গ’-উপন্যাসের শচীশ নয়, ‘অন্তঃশীলা' উপন্যাসের নায়কের মত প্রখর মননজীবী ব্যক্তিত্বও নয়। ‘গোরা'-র সর্বপরী বিরাটত্বও তার নেই। “তবু বাংলা উপন্যাসে আধুনিক জীবন ভাবনা বিন্যাসের দিক থেকে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র নায়ক এক অনন্য চরিত্র সন্দেহ নেই।” শশী ডাক্তার চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী হবার জন্য সে কলকাতায় এসেছে ডিগ্রী নিতে। গ্রামের ছেলে কলকাতায় এসে বই ও বন্ধুর সাহচর্যে মার্জিত হয়েছে, পরিশীলিত হয়েছে। তার ফলে তার মধ্যে এমন একটি মনের সৃষ্টি হয়েছে, যে মনটি অসাধারণ বিবেকী ও সংবেদী। আধুনিক মন ও মননের অধিকারী হয়েছে বলেই শশীর ভেতরে যে দ্বন্দ্ব, যে সংশয়, যে যন্ত্রণাবিদগ্ধ মনের ছবি পাওয়া যায় তা এই উপন্যাসে চরিত্রটিকে এক বিরল মাহাত্ম্য দান করেছে। তার যুক্তিবাদী মন কোন কিছু অলৌকিককে মানতে চায় নি, তার দরদী মার্জিত মন সব সময় মানুষের দুঃখে কাতর হয়েছে। বিজ্ঞানশিক্ষার ফলে তার যুক্তিবাদী মন বার বার নানা ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে, প্রচলিত সংস্কার আর যুগবাহিত অন্ধ বিশ্বাসকে সে ‘চ্যালে’ জানিয়েছে যুক্তির অনুশাসনে ঐতিনের দশকের নায়কের গুণগুলি এইভাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে শশীর চরিত্রে। যুদ্ধোত্তর কালের জিজ্ঞাসা ও মানবপ্রীতি, অবক্ষয়ধর্ম এই belated Kallolian-এর মধ্যে যে ছাপ ফেলে গেছিল, তাই তাঁর প্রিয় চরিত্র শশীর মধ্যে এই জিজ্ঞাসা ও সচেতনতা, সংশয় ও দ্বন্দ্ব, অতৃপ্তি ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এই দিক থেকে শশীকে নায়ক চরিত্র হিসেবে একটা বিশিষ্টতা দেওয়া যায়।


শশীর মনের চিন্তাধারার প্রতিক্রিয়া উপন্যাসে ধরা পড়েছে। উপন্যাসে নানা ঘটনা, নানা বিচ্ছিন্ন সংঘটন হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গে একটি সঙ্গীত সৃষ্টি করেছে শশী চরিত্র। উপন্যাসটি নানা চরিত্র, নানা ঘটনায় বিস্তৃত। যেহেতু গঠনের দিক থেকে উপন্যাসটি ‘episodical’ তাই উপন্যাসটির বিচ্ছিন্ন ‘episode’-এর মধ্যে ঐক্য এনেছে শশী চরিত্র। শশীর এই ঐক্যসৃজনকারী শক্তি আছে বলেই তাকে নায়ক বলা যায়। শশীর দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে সমস্ত ঘটনা, নানা স্তরের নানা শ্রেণির মানুষের সমস্যা। শশী কেবল যামিনী কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে সেনদিদির সমস্যা সমাধান করে নি, সে কেবল পরানের বাড়িতে গিয়ে মতির জ্বর সারাবার জন্য সচেষ্ট হয় নি, সে কুমুদের প্রস্তাব নিয়ে ভেবেছে, বিন্দুর ঘটনায় সে একাত্ম হয়েছে। এইভাবে দেখা যায়, বিন্দু-নন্দলাল, কুমুদ-মতি, পরান- কসুম মতিও শশীর সম্পর্ক বৃত্ত। সব আখ্যান শশী চরিত্রকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এই দিক থেকে বিচার করলে মনে হয়, উপন্যাসের ঘটনা ও চরিত্রগুলির সব কর্মধারা আসলে 'শশীর জগৎ' বলে প্রতীয়মান হয়। হয়ত এই ‘শশীর জগৎ' শশীর সৃষ্ট নয়, শশীর নিয়ন্ত্রণও তাতে নেই, তবু এই জগৎ যে তার নায়কোচিত প্রভাবের ফল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মধ্যে আছে সৃষ্টির ইচ্ছা, সে এই জগৎকে পরিবর্তন করে দিতে চায়, কিন্তু পারে না। শাওদিয়া গ্রামের ছেলে সে গ্রামের মাটিতে তার জন্ম, সে গাওদিয়ার 'গেঁয়ো মানুষ' 'এইখানে জন্ম শশীর, এইখানে সে বড় হইয়াছে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়ানো তার জীবন।” এই গ্রামজীবনের নানা ঘরে ঘুরে ঘুরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।” গ্রামজীবনে শশীর বিতৃয়া আসিয়াছে।” –বৈচিত্র্যহীন, নিষ্ফল জীবনের প্রতি তার বিতৃয়া বেড়ে ওঠে, "নূতন জগতে নূতন করিয়া জীবন আরম্ভ করিতে চায়।” এইখানে শশীর মধ্যে দুই সত্তা কাজ করে। একটি সত্তা গ্রামের গণ্ডীবদ্ধ জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়—“একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারি শুরু করিয়া ক্রমে ক্রমে এ জীবন শশীর যে ভাল লাগিয়াছে, ইহাই তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ।" নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে গ্রামের জটিল ও গভীর জীবনের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রায়শঃ এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। “শহর ও গ্রামের জীবন সম্পর্কে শশীর মনে এই সামগ্ৰস্যবোধের অভাব—দুয়েরই প্রতি তার ভিন্ন ধরনের আকর্ষণ এবং সে কারণে এই দুই আকর্ষণের মধ্যে সমন্বয় প্রয়াসের দিকটা লেখক হয়তো আরো বাস্তবধর্মী 'ডিটেলস'-এর বিন্যাসে পরিস্ফুট করে তুলতে পারতেন।”


প্রথম থেকেই দেখা যায় শশী কতখানি পরোপকারী, গ্রমের হারু ঘোষের অপঘাতে মৃত্যুর পর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তাকে গ্রামে নিয়ে আসার কর্তব্য সাধন করেছে সে। উপন্যাসের শুরুতেই মৃত্যুর ছবি। “গাওদিয়া গ্রামের ‘ইতিকথা’ নিশ্চয় নিছক মৃত্যুর কাহিনী নয়, সে কাহিনী জীবনেরও—জীবনের প্রতি পিপাসা ও মমতার রসে তা উদ্বেল। কিন্তু এমন এক ‘ইতিকথা'-র গোড়াতেই এক অসহায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঠকের আকস্মিক মুখোমুখি দেখা। এই নিরুপায় মৃত্যুর বিষণ্ণ পথ দিয়েই পাঠককে গাওদিয়ার জীবনের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। নায়ক শশী পাঠকের সেই মৃত্যু-অভিজ্ঞতায় পথের সঙ্গী। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে গ্রামের দিকে।”


মৃত্যুর পথ দিয়ে নায়ক শশী গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে এসে সে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শশী চিকিৎসক, বিজ্ঞানদৃষ্টি তার সহায়। জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করে। এই দৃষ্টিতে গাওদিয়া গ্রামের আর এক মৃত্যুকে সে তন্ন তন্ন করে বিশ্লেষণ করে। তা হচ্ছে এই গ্রামের আলৌকিক শক্তির অধিকারী, ‘সূর্যবিজ্ঞান’-যোগী যাদব পণ্ডিত ও তদীয় পত্নীর ইচ্ছামৃত্যুর কাহিনী। এই মৃত্যু অলৌকিক লীলা নয়, করুণ আত্মহত্যা। চিকিৎসকের দৃষ্টিতে সে মৃত্যুকে তিল তিল করে দেখেছে। আফিমের ক্রিয়ায় যাদব ও তার সহধর্মিণীর আত্মহত্যার দৃশ্য। কিন্তু এই ঘটনায় উদ্দীপনা ও উত্তেজনা যখন দেশব্যাপী হয়ে পড়ল, তখন শশী সেই অলৌকিকতাকে অস্বীকার করতে পারল না। সে অসহায়ের মত এই উত্তেজনার শিকার হয়ে পড়ল। শশীর সতর্ক বিজ্ঞানবুদ্ধির সজাগ প্রহরা সত্ত্বেও “চিরদিনের জন্য এ ঘটনা মনে গাঁথা হইয়া রহিল, এ এক অপূর্ব অপার্থিব দৃশ্যের স্মৃতি। দুঃখযন্ত্রণার সময় একথা মনে পড়িবে। জীবন রুক্ষ্ম নীরস হইয়া উঠিলে এ আশা করিবার সাহস থাকিবে যে, খুঁজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে, বাঁচিয়া থাকার যা বড়ো।"লৌকিক ও অলৌকিকের দ্বন্দ্ব শশী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।


শশী সম্পর্কে লেখক বলেছেন : “শশীর চরিত্রে দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাহার মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নেই, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাহার যথেষ্ট। তার কল্পনাময় অংশটুকু গোপন ও মূক। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাহার সঙ্গে না মিশিলে একথা কেহ টের পাইবে না যে তার ভিতরেও জীবনের সৌন্দর্য ও শ্রীহীনতায় একটা গভীর সহানুভূতিমূলক বিচারপদ্ধতি আছে। তাহার বুদ্ধি, সংযম ও হিসাবি প্রকৃতির পরিচয়ই সাধারণ মানুষ পায়। সংসারে টিকিবার জন্য দরকারি এই গুণগুলির জন্য শশীকে সকলে ভয় ও খাতির করিয়া চলে।” শশী চরিত্রের এই সব গুণাবলী তাকে দেশবাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং শ্রদ্ধেয় চরিত্রে পরিণত করেছে। এই সব গুণাবলীর দিক থেকে শশী তার বাবা গোপালের বিপরীত মেরুর চরিত্র। এইজন্য দুজনের মনাত্তর উপন্যাসে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। তাদের বিসদৃশ মনোভাব, স্বতন্ত্র রুচি।


শশীর কল্পনাপ্রিয়তার প্রমাণ কুসুমের সঙ্গে তার সম্পর্ক। কুসুমের প্রতি গোপন সম্পর্ক এই উপন্যাসে অবৈধ প্রণয়ের এক নীরব উপকরণ। কুসমের হাস্য লাস্য, কিশোরীসুভ চাঞ্চল্য, নানা ভাবে-রূপে নানা ছদ্ম-ভঙ্গীতে, তার গোপন প্রণয়ের দাবীতে আত্মপ্রকাশ করেছে। তালপুকুরে বার বার শশীর সঙ্গে সে মিলিত হয়, নানা তুচ্ছ কথার অছিলায়। কখনও বিন্দুর খবর নেবার অছিলায়, কখনও মতির প্রতি শশীর স্নেহর অতিরেকের উল্লেখে কুসুম বার বার পীড়িত করে শশীকে। কুসুম মতিকে শশীর কথা বলে প্রায়ই ঝগড়া বাধায়। মতিকে নিয়ে কুসুমের ঝগড়া কুসুমের চরিত্রবৈশিষ্ট্যের পরিচয়। নারীর চিরন্তনী ঈর্শার পরিচয় এই সব ঘটনায় ফুটে ওঠে। শশী কিন্তু এসব শুনেও নির্বিকার। তার এই প্রশান্ত রূপটি তার চরিত্রকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।


শশীর কর্তব্যপরায়ণতা অসামান্য। সে শুধু মতির জন্য নানা মন্তব্য অগ্রাহ্য করে পরানের বাড়ি ছুটে যায় কেবল কর্তব্যসাধন করার জন্য। এই কর্তব্যসাধনের তাগিদে সে সেনদিদিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। “শশী এবার সেনদিদিকে লইয়া বড়ো ব্যস্ত।" পুরনো বন্ধু কুমুদকে দেখে শশী বড় খুশী। তবু “শশীকে যামিনী কবিরাজের বৌ-এর কাছে যাইতে হইবে। এই কর্তব্য অবহেলা করিবার উপায় ছিল না।”—কর্তব্যনিষ্ঠ শশী রোগীর ডাকে কোন কিছুর বাঁধন মানে নি। পরে যাদবের স্মৃতিরক্ষার্থে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে শশীর উৎসাহ ও কর্তব্যপরায়ণতার কোন শেষ নেই। সুচিকিৎসক হিসেবে, নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী হিসেবে শশীর দায়িত্ববোধের প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে। তাই নানা গ্রাম্য হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে শেষে যাদবের কর্তব্যভার সমাপ্ত করে শশী। “যাদব মেমোরিয়াল হসপিট্যাল' নামটি উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হলেও লোকের কাছে এটা শশী ডাক্তারের হাসপাতাল। আর্ত মানুষের জন্য গ্রাম্য দলাদলি ভেদ করে যে এই হাসপাতালটা গড়ে উঠেছে এটা শশীর জীবনের স্মরণীয় কীর্তি। সমাজের কাছে স্বীকৃত হয়ে ওঠে সে নায়ক হিসেবে। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে শশীর ব্যক্তিত্বের আর এক মাত্রা এখানে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। যাদব যে কর্তব্যভার শশীকে চাপিয়ে দিয়েছেন, তা সম্পাদন করতে গিয়ে শশী যে ফললাভ করেছে, তা অভাবনীয়। লেখক এই অংশের ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে ’ ‘‘ফলটা হইয়াছে অচিন্ত্যপূর্ব। নেতার আসনে বসাইয়া সকলে তাহাকে অনেক উঁচুতে তুলিয়া দিয়াছে। কয়েকটি স্থানে বক্তৃতা করিয়া শশীর বলিবার ক্ষমতাটাও খুলিয়া গিয়াছে আশ্চর্যরকম। সভাসমিতিতে এখন তাহাকে প্রায়ই বলিতে হয়, সকলে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শোনে। শশী আবেগের সঙ্গে কথা বলিলে সভায় আবেগের সঞ্চার হয়, হাসির কথা বলিলে আকস্মিক সমবেত হাসির শব্দে সভার আশেপাশের পশুপাখি চমকাইয়া ওঠে।” এইভাবে লেখক শশীকে নায়কোচিত আসনে বসিয়ে তাকে পাদপ্রদীপের আলোকে তুলে ধরেন। শশী হয়ে ওঠেন এক অসামান্য সামাজিক ব্যক্তিত্ব, গাওদিয়ার নবনির্বাচিত নায়ক পুরুষ।


শশী কর্মী মানুষ। গ্রামের মানুষের দুঃখে-ব্যাধিতে সে বিদ্যুৎ গতিতে এসে উপস্থিত হয়। তার অক্লান্ত সেবায় সেনদিদি বেঁচে ওঠে, সে কুমুদকে জীবনের পথ দেখায়, পরানের বাড়িতে সে সুখে দুঃখে সহায় হয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তার হিসেবে তার পসার গ্রামে বেড়ে যায়। সে হয়ে ওঠে জনপ্রিয় চিকিৎসক। “যামিনী কবিরাজের বৌকে ভালো করিয়া শশীর পসার কয়েক দিনেই বাড়িয়া গিয়াছে।” রোগীকে শশী ফিরিয়ে দেয় না, রোগী দেখে পকেটে টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। এক রাত্রি নন্দনপুরে কাটিয়ে দেয়। এই ব্যস্ত চিকিৎসকের জীবনের পাশে আছে ‘ইনটেলেকচুয়াল রোমান্তের পিপাসা “যাহা চায়ের ধোঁয়ার মতো, জলীয়বাষ্প ছাড়া আর কিছু নয়, চাও নয়। জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, অত্যন্ত অসম্পূর্ণ ভাসা-ভাসা ভাবে দেখিতে শিখিয়া, সে অবাক হইয়া দেখিয়াছে যে এইখানে, এই ডোবা আর জঙ্গল, আর মশাভরা গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়।” এই হচ্ছে শশীর মানসপ্রকৃতি।


এই মানসপ্রকৃতির জন্য শশী জীবনের শেষে মুখোমুখি হয় এক অভাবিত ট্র্যাজেডির। যে কুসুমকে সাত বছর ধরে সে আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু প্রশ্রয় দেয় নি, সেই কুসুম যখন চিরকালের মত বাপের বাড়ি যেতে চাইল, তখন শশী ভেঙে পড়ল। শশীর এই পরিবর্তন শশীরও অজ্ঞাত। সে হঠাৎ আবিষ্কার করে সে কতখানি অসহায়। প্রেমের কাঙালপনা তার মধ্যে দেখা দিল। “কুসুমকে গাঁয়ে রাখিবার জন্য আজও চেষ্টা করিয়াছে শশী, এ শশীকে যেন চেনা যায় না। এমন দীন ভাব সে কোথায় পাইল, কোথায় শিখিল এমন কাঙালপনা? জানে, কুসুম থাকিবে না, থাকিলেও ভালোবাসিবে না, তবু উৎসুকভাবে শশী জবাবের প্রতীক্ষা করে।”এ কোন শশী ? দীন, ভিখারী শশীর এ কী পরিণাম? গ্রাম ছাড়ার কল্পনা শশীর মধ্যে এসেছে, গ্রামে তার অস্তিত্ব হয়েছে বিড়ম্বিত, শূন্য। যে হাসপাতালকে সে গড়ে তুলেছে, সেই হাসপাতালের কাজ ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছে। সে সহজে কুমুদের মত চলে যেতে পারে না, উড়ে যেতে পারে না তাদের সদৃশ হয়ে, সে নিজেকে গ্রামের সঙ্গে অনেক বাঁধনে বেঁধে রেখেছে, তাই সামাজিক বন্ধন এড়ানো তার কাছে দুরূহ। শশীর মধ্যে যে social ego-সেই সমাজসত্তার শক্তিমত্তায় শশীর ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি, ব্যক্তিগত ক্রন্দনধ্বনি চাপা পড়ে গেছে। সেনদিদির মৃত্যু যেমন শশীর কাছে অজানা দেহরহস্যের বার্তা নিয়ে আসে, কুসুমের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া তার মধ্যে অজানা জীবনরহস্যের একটা নতুন অর্থ নিয়ে আসে। সেনদিদির মৃত্যুতে গোপালের চরিত্রের খাপছাড়া ব্যবহার তার কাছে লজ্জা ও দুঃখের। দুই স্বতন্ত্র জগতের মধ্যে যেন এক অজ্ঞাত জীবনরহস্যের অন্ধকার ঘনীভূত হয়। গোপাল শশীর কাছে কোন আশা রাখেন না। পিতা-পুত্র সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেছে। “বাবাকে যে ছেলে ঘৃণা করে, তার কাছে কি প্রত্যাশা থাকে বাপের? ধরিতে গেলে সেই তো মনটা ভাঙিয়া দিয়াছে গোপালের।" ভাঙা মন নিয়ে শশী চলে গেছে। বাবার মনও সেই ভেঙে দিয়েছে—এই ব্যর্থতাবোধে শশীর ট্র্যাজেডি। কিন্তু এই ট্র্যাজেডিকে একান্ত গোপন করে শশী মানুষের মনে যে স্থান পেয়েছিল, সেই জনপ্রিয়তার মূল্যস্বরূপ আবার সে কাজে মন দেয়। গ্রামের প্রতি বিতৃয়া তার আছে, তবু গ্রাম ছাড়বার কথাটা সে ভাবতে পারে না। এই দ্বন্দু শশীকে জীবন্ত করে তোলে আমাদের সামনে। গোপাল সমস্ত জীবনের সঞ্চয় ফেলে রেখে কাশীবাসী হলেন, শশী আবার সব ভার নিজের হাতে গ্রহণ করে গাওয়দিয়ার পথে যাত্রা শুরু করল। শশী তার অভিজ্ঞতার মূল্য দিয়ে বুঝেছে “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অনিবার্য শক্তির ইঙ্গিত। মাধ্যাকর্ষণের মত, যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।” পরিবর্তিত শশী কাজ শুরু করে, দু-চোখ দিয়ে খুঁজে বেড়ায় মানুষ। “তালবনে শশী আর কখনো যায় না। মাটির টিলাটির উপরে উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।” এই ব্যর্থ জীবনের সরণি বেয়ে শশীর নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হয়।