প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পের পটভূমি এবং মর্মবাণীর সঙ্গে মহানগর কলকাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আলোচনা করো।

‘মহানগর’ গল্পটি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'মহানগর' নামে ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মহানগর কলকাতার বহুবিচিত্র জীবনের একটি খন্ডাংশকে লেখক আলোচ্য গল্পে উপস্থাপিত করেছেন। এ গল্পের বিষয়বস্তু এক ছোট্ট বালকের মহানগরে হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে বের করবার কাহিনি। অন্যদিক থেকে বলা যায়, এক গ্রামের মেয়ে তথা গৃহবধূ কীভাবে তার স্বস্থান থেকে চ্যুত হয়ে মহানগরের এক অন্ধ গলিতে হতভাগ্য রমণীদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল, এ গল্প তারই বৃত্তান্ত। সেই বৃত্তান্তকে তুলে ধরা হয়েছে রতন নামে এক বালকের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। বালকের চোখে দেখানো হলেও আসলে 'মহানগর' নাগরিক জীবনের জটিলতার গল্প। মহানগরের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিকে এ-গল্পে সংহত শিল্পরূপের মধ্য দিয়ে উদ্ঘাটিত করা হয়েছে।


আলোচ্য গল্পের প্রারম্ভিক বাক্য থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত ধ্রুবপদের মতো ‘মহানগর’ শব্দটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। গল্পের সূচনায় লেখক তাঁর সঙ্গে সেই মহানগরে যাওয়ার জন্য পাঠককে আহ্বান করছেন, যে মহানগর আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো ছড়িয়ে আছে, আবার যে মহানগর উঠেছে মিনারে মন্দির চূড়ায় আর অভ্রভেদী প্রাসাদশিখরে তারাদের দিকে মানবাত্মার প্রার্থনার মতো। এই সঙ্গে লেখক মহানগরের জটিল, অন্ধকার পথেও পাঠককে আসতে বলছেন। তিনি মনে করেন—'এ-মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত—ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত'। কঠিন ধাতু ও ইটের ফ্রেমে লক্ষ জীবনের সুতো নিয়ে মহানগর বিশাল সূচিচিত্র নির্মাণ করে চলেছে। সেই চিত্রে কখনো কখনো সুতোর সঙ্গে সুতো জড়িয়ে যাচ্ছে, খেই যাচ্ছে হারিয়ে। আলোচ্য গল্পে মহানগরের বৃহৎ, জটিল ও সামগ্রিক রূপ অঙ্কন করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়। তিনি স্পষ্টভাবে এখানে জানিয়েছেন—'আমি শুধু মহানগরের একটুখানি গল্প বলতে পারি-মহানগরের মহাকাব্যের একটুখানি ভগ্নাংশ, তার কাহিনী সমুদ্রের দু-একটি ঢেউ'।


মহানগর কলকাতার বহুমাত্রিক পরিচয় দেওয়ার পরেই লেখক এ-গল্পের নায়ক রতনকে স্থাপন করেছেন মহানগরের পটভূমিতে। নদী যখন মহানগরের নাগাল পেয়েছে, ভোরের আবছা আলোয় যখন নদীর দুধারে জাহাজ-স্টিমার আর বড় বড় কারখানার জেটিকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তখন নৌকার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে রতন হালের কাছে তার বাবার পাশে বসেছিল। নৌকো যখন মহানগরে পৌঁছল, তখন সবিস্ময়ে রতন লক্ষ্য করে—'রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত সেই শহর'। মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করার আগে গল্পের প্রথমাংশে লেখক কলকারখানা, জাহাজ, স্টিমার এবং লোহালক্কড়ের প্রাচুর্যপূর্ণ মহানগরের এক হৃদয়হীন, কঠিন অবয়ব ও ভিড়ে-ঠাসা জীবনের চিত্র এঁকেছেন। এই মহানগরে মানুষ হারিয়ে যায়, এই ভিড়ের মধ্য থেকে পরিচিত মানুষকে খুঁজে বের করার কাজটি সহজ নয়। রতনদের নৌকো একসময় মহানগর ছাড়িয়ে জীর্ণ শহরতলিতে প্রবেশ করে। এ সময় রতন আশ্বস্ত হয়। কারণ বড় নদীতে মহানগরের রূপ দেখে সে ভয় পেয়েছিল, হতাশ হয়েছিল আরও বেশি। গ্রাম থেকে অল্প বয়সের বালক রতন কেন শহরে এসেছিল, সেটা জানাবার পূর্বে লেখক মহানগর সম্বন্ধে বলেছেন যে, মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ কত কিছুর খোঁজে আসে—কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বা বিস্মৃতি। এরপর লেখক জানিয়েছেন যে, মৃত্তিকার স্নেহের মতো শ্যামল একটি অসহায় ছেলে রতন সেখানে এসেছে তার দিদির খোঁজে। যেখানে মানুষ নিজের আত্মাকে হারিয়ে খুঁজে পায় না, সেই মহানগর থেকে রতন তার দিদিকে খুঁজে বার করবে। শহর এবং দিদি তার কাছে একার্থক।


এভাবে আলোচ্য গল্পের কেন্দ্রভূমিতে প্রবেশের পূর্বে লেখক সযত্নে ও সচেতনভাবে মহানগরের জটিলতা সম্পর্কে পাঠকের মনে একটা ধারণা সৃজন করতে চেয়েছেন এবং বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি গল্পের মধ্যে উপস্থাপন করতে চলেছেন একটা বিষাদ-করুণ কাহিনিকে। উল্টোডিঙির পথে নেমে রতন যখন তার দিদিকে খুঁজছিল, তখনও এসেছে মহানগরের প্রসঙ্গ। লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নানান অভীষ্ট বস্তু খুঁজতে আসা মানুষেরা মহানগরের পথের অরণ্যে হারিয়ে যায়। মহানগর তাদের চিহ্ন মুছে দেয়। কিন্তু এ গল্পে রতন হারিয়ে যায়নি। সে তার দিদিকে খুঁজে পেয়েছিল। হঠাৎ ভাইকে দেখে রতনের দিদি চপলা যখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিল, তখন লেখক জানালেন যে, মহানগরের পথে ধুলো, আকাশে ধোঁয়া, বাতাসেও মনে হয় বিষ আছে। মানুষের আশা এখানে কখনো কখনো পূর্ণ হয়। খুঁজতে থাকা বস্তুকে পাওয়া যায়। তবু বহুদিনের কামনার ফলও কেমন একটু বিস্বাদ লাগে। মহানগর সবকিছুকে দাগী করে দেয়, সার্থকতাকেও একটু বিষিয়ে দেয়।


‘মহানগর’-এ রতন তার দিদিকে খুঁজে পেলেও রতনের এই সাফল্য তৃপ্তিদায়ক হয়নি। দিদিকে চিনতে তার কষ্ট হয়। সে বুঝতে পারে, তার দিদির মধ্যে অনেক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। রতনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বরূপটিকে বোঝাবার পূর্বে লেখক মহানগরের ক্লেদাক্ত রূপ-সম্বন্ধে পাঠককে আগাম সচেতন করে দিয়েছেন উপরিউক্ত ধুলো-ধোঁয়া-বিষ-সম্পর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে। এরপর লেখকের ইঙ্গিতধর্মী বর্ণনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, একদা গ্রামের বধূ চপলা মহানগর কলকাতার গণিকায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি পাঠক বুঝলেও অল্পবয়সি রতনের বুঝতে একটু সময় লাগে। ক্রমশ রতন তার দিদির জীবনের পরিবর্তন এবং পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার অক্ষমতার কারণটিকে বুঝতে পারে। বড় হয়ে সে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন পোনাঘাটের পথ ধরে, তখন গল্পের একেবারে শেষে লেখক মন্তব্য করেন—'মহানগরের ওপর সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতির মতো গাঢ়।'


স্পষ্টতই বোঝা যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র আলোচ্য গল্পের প্লট নির্মাণে মহানগরের পটভূমির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একটি গ্রামের মেয়ে তার গ্রামীণ পরিবেশ থেকে, তার সহজ-স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে কলকাতার গণিকায় পরিণত হল— এই তথ্যটিকে লেখক অন্যভাবেও উপস্থাপন করতে পারতেন। জীবনের বৃত্ত থেকে বিচ্যুত করে নারীকে দেহপসারিণীতে রূপান্তরিত করবার ইতিহাস নতুন নয় এবং তার দায়িত্ব কেবল নগরায়ণের ওপরেই নির্ভরশীল নয়। অতি আদিমকাল থেকেই দেহ-ব্যাবসা চলে আসছে। সভ্যতার অগ্রগতি এবং মানুষের পাশববৃত্তির অনিবার্য সম্মেলনেই মহানগরের বুকে নানাভাবে গণিকাবৃত্তির প্রসার ঘটে। এ গল্পে লেখক সেই ব্যাপক বিস্তৃত দিকের প্রতি আলোকপাত করতে চাননি। তিনি ছোটগল্পের কাঙ্ক্ষিত সূত্রকে অনুসরণ করে পাঠকের সামনে সেই বিন্দুটিকে উজ্জ্বল-ভাবে দেখাতে চেয়েছেন। মহানগরের বহুবিস্তৃত জীবনের একটা বিশেষ ক্ষতস্থান পতিতাপল্লীকে অঙ্কন করতে চেয়েছেন। রতনের দিদি চপলা সেই ক্ষতস্থানের অধিবাসী হতে বাধ্য হয়েছে অবস্থা বিপাকে পড়ে। একান্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কও মহানগরের জটিল, অমানবিক গোলোকধাঁধায় পড়ে কীভাবে মাটিতে পতিত কদমফুলের মতন থ্যাঁতা হয়ে যায়, 'মহানগর' গল্পে রতন এবং চপলার মধ্য দিয়ে লেখক সে-দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন। এ-গল্পের পটভূমি ও মর্মবাণীর সঙ্গে মহানগর কলকাতা এভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।