ঐতিহাসিক নাটকের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে যে কোন একজন প্রধান বাঙালি ঐতিহাসিক নাট্যকারের পরিচয় দাও।

কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক যুগের ঐতিহাসিক ঘটনা, বিভিন্ন শক্তির ঘাতপ্রতিঘাত প্রভৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক নাটক রচিত হয়। নাট্যকার ইতিহাস প্রসিদ্ধ চরিত্র অথবা তাঁর কল্পনাসৃষ্ট চরিত্রকে নাটকের প্রধান চরিত্ররূপে গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু তাঁর চরিত্র ও ঘটনা যাতে বিশেষ যুগের ঐতিহাসিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, সেদিকে অবশ্যই তাঁকে দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি কল্পনাদৃষ্টিতে ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলিকে পূর্ণ করে নিয়ে শুধু ঐতিহাসিক নয়, তাঁর কল্পনাসৃজিত ঘটনাপুঞ্জে তাঁর নাটকের অবয়ব গঠন করতে পারেন, সেই স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু ঐতিহাসিক নাট্যকার কোনও প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্যের বিকৃতি সাধন কিংবা তার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না। ইতিহাস ও ব্যক্তিমানুষ ও তার হৃদয়-চিত্রকে সমন্বিত করেই তিনি ঐতিহাসিক নাট্যরস সৃষ্টি করেন। ঐতিহাসিক নাটক তার বিন্যাস অনুযায়ী ট্র্যাজেডি বা কমেডি হতে পারে। শেক্সপিয়ারের Henry the Fourth, Henry the-Fifth, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদ্দৌলা’, শচীন সেনের ‘গৈরিক পতাকা’, মহেন্দ্র গুপ্তের ‘মহারাজ নন্দকুমার’ ঐতিহাসিক নাটকের উদাহরণ।


ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এলিজাবেথীয় যুগে ঐতিহাসিক নাটক রচনার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। শেক্সপিয়ারের পূর্ববর্তী নাট্যকার ক্রিস্টফার মার্লোর Edward the Second-ও এই যুগের প্রথম প্রকৃত ঐতিহাসিক নাটক। নাটকটির ঘটনাপ্রবাহ সুবিন্যস্ত ও সংহত। মার্লোর অন্যান্য নাটকগুলির তুলনায় চরিত্রগুলি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ও বৈচিত্র্যে অনেক বেশী জটিল, ভাষাও সরল ও নিরাভরণ এবং প্রতিটি চরিত্রই সুনিপুণভাবে ও সমান সহানুভূতির সঙ্গে অংকিত। মার্লোর এই নাটকটি শেক্সপিয়ারের Richard the Second-কে প্রভাবিত করেছিল। স্প্যানিশ আর্মাডার পরাজয়ের পর এলিজাবেথীয় যুগে জাতীয়তাবোধ প্রবল হয়ে ওঠে, সেই সূত্রে এই সময় ঐতিহাসিক নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, অবশ্য ইতিহাসের বর্ণাঢ্য পটভূমি, ঘটনাবৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বসংঘাত ইত্যাদির প্রতি এই যুগের নাট্যরসিক জনসাধারণের স্বাভাবিক আকর্ষণও ছিল। শেক্সপিয়ারের ঐতিহাসিক নাটকগুলি দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত। তাঁর Henery the Sixth, Richard the Third এবং Richard the Second, Henry the Fourth, King John Henry the Eighth ইত্যাদি ঐতিহাসিক নাটকগুলির উপজীব্য বিষয় মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে এলিজাবেথীয় যুগ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলী। Julius Caesar ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি, তার স্থান স্বতন্ত্র। শেক্সপিয়ার তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে মূল চরিত্রের প্রধান আবেগ ও তার দ্বন্দ্বের সঙ্গে সংঘাতের ঐতিহাসিক-সামাজিক অন্তঃসারকে আশ্চর্য প্রাণময়তায় সমন্বিত করেছেন। তাদের জীবনে পরিবেশগত দ্বন্দ্ব ও অস্তদ্বন্দ্বকে অন্তলীন ঐক্যসূত্রে বাঁধা পড়তে দেখি।


শেক্সপিয়ারের কালের নাট্যকার ও সমালোচকেরা তার ঐতিহাসিক নাটকগুলির বেশভূষা, পটভূমি, চরিত্রগুলির ভাষাভঙ্গি ও আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে নানা কালানৌচিত্য দোষের উল্লেখ করেছেন। এই অভিযোগ Julius Caesar সম্পর্কেই বেশী শোনা যায়। তাঁর এই ঐতিহাসিক নাটক ও অন্যান্য রোমান নাটকগুলি প্রাচীন যুগের পরিচ্ছেদে ইংল্যান্ডের ঘটনা ও ইংরেজ চরিত্রকেই উপস্থাপিত করেছে, তাতে আমরা এলিজাবেথীয় যুগজীবনের প্রতিচ্ছবিই লক্ষ্য করি, এই জাতীয় অভিমত গ্যেটেও প্রকাশ করেছেন। কোনও ঐতিহাসিক নাটকই তার উপজীব্য কালের নিখুঁত যথাযথ প্রতিচ্ছবি হতে পারে না, তার মধ্যে অনিবার্যভাবেই সমকালীন জীবনের ছাপ পড়বে। আমরা প্রকৃত সৃষ্টিধর্মী ঐতিহাসিক নাটকে ইতিহাসের তথ্যগত যাথার্থ্য পেতে চাই না, জীবনের এমন রূপ ও ভাষ্য পেতে চাই যা সেই অতীত ঐতিহাসিক কাল যেমনি, তেমনি নাট্যকারের সমকাল ও পরবর্তী কালের পক্ষেও সমান সত্য। শেক্সপিয়ার Julius Caesar নাটকের প্রধান চরিত্র ব্রুটাসের মধ্যে রূপায়িত অভিজাত সাধারণতান্ত্রিক মনোভাব, তার কঠোর নৈতিকতা ও গভীর সামাজিক নৈতিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত হতে দেখেছিলেন, তিনি প্লুটার্কের রোমান ইতিহাস থেকে সেই সব বৈশিষ্ট্যকে আহরণ করেছিলেন যা দুটি যুগেই সমধর্মী ছিল। যে সব ঐতিহাসিক ও নৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর কালের আন্তরসাদৃশ্য ছিল, নাট্যকার তাদের ভিত্তিতেই এই নাটকের ট্র্যাজিক ঘটনাগুলিতে জীবন্ত রূপ রচনায় সফল হয়েছেন।


শেক্সপিয়ারের Julius Caesar বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর সমকালীন অথবা তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী নাট্যকার বেন জনসন রোম ইতিহাসের বিষয়বস্তু অবলম্বনে Sejanus ও Catiline নামে দুটি নাটক রচনা করেন। শেক্সপিয়ারের রোমান নাটকে ইতিহাস জ্ঞানের অভাব ও নানা তথ্যগত ভুল বেন জনসনের মত একজন বিদগ্ধ পাণ্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তির কাছে দোষাবহ ও অবজ্ঞেয় মনে হয়েছিল, তিনি এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য রোম-ইতিহাস থেকে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর নাটকে সন্নিবিষ্ট করেছেন। শেক্সপিয়ারের ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞানী ও পন্ডিত না হয়েও তাঁর সর্বজনীন মানবচরিত্রের অন্তর্দৃষ্টি ও নাট্যরস স্ফুরণে অসাধারণ নৈপুণ্যের সাহায্যে তাঁর চরিত্রগুলিকে জীবন্তু ও নাটককে রহস্যময় মানবজীবনের যথার্থ প্রতিচ্ছবি করে তুলেছেন। বেন জনসন ঐতিহাসিক দলিলপত্র ঘেঁটে তথ্যগত সত্য উদ্ধার করেছেন বটে, কিন্তু গভীরতর জীবনসত্যের রূপ রচনা করতে পারেন নি।


ঊনবিংশ শতাব্দীর ইটালির বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাট্যকার এবং সেই কালের পশ্চিম ইয়োরোপের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা মানজোনি ঐতিহাসিক নাটকের স্বরূপবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা বলেছেন, তা সর্বদেশের ও সর্বকালের এই জাতীয় নাটকের সার্থকতা বিচারের মানদগুরূপে গ্রহণীয়। তাঁর বক্তব্য এই : ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং dramatic individualism এই দুয়ের মধ্যে কোনও মৌলিক বিরোধ নেই। ঐতিহাসিক ঐতিহ্য থেকে আমরা তথ্য এবং বিকাশ বা অগ্রগতির সাধারণ প্রবণতা জানতে পারি। তার কোনও কিছু পরিবর্তনের অধিকার নাট্যকারের নেই। তার কোনও কারণ ও নেই, যদি তিনি সত্যই তাঁর চরিত্রগুলিকে individuals রূপে চিত্রিত করতে চান, তবে ঐতিহাসিক তথ্যগুলির মধ্যেই তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলি ও সাহায্য খুঁজে পাবেন এবং ইতিহাসের যত গভীরে প্রবেশ করবেন ততই এই ব্যাপারটা দেখা যাবে )মানুষেরা বাস্তবে যা করেছে, তাঁর থেকে আর কোথায় আরও ভালোভাবে প্রকৃত নাটক পাওয়া যেতে পারে ? একজন কবি ইতিহাসে একটি ব্যক্তিত্বদীপ্ত চরিত্রের দেখা পান, তিনি তাঁর মানসকে অধিকার করে নিয়ে যেন বলেন : আমাকে লক্ষ্য কর। আমি তোমাকে মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছু শিক্ষা দেব; কবি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, তিনি এই চরিত্র চিত্রিত ও বিকশিত করতে চান, এই মানুষটি বাস্তবে যা করেছে, তাদের মধ্যে ছাড়া সেই সব বাইরের কার্যাবলী, যা তিনি মানুষটির যে প্রকৃত ধ্যানধারণা রূপায়িত করতে মনস্থ করেছেন, তার অনুযায়ী, তাদের আর কোথায় খুঁজে পাবেন ? তাহলে কবির কি করণীয় থাকে ? কবিতা, হ্যাঁ, কবিতা কারণ, ইতিহাস আমাদের কি দেয় ? — ঘটনাসমূহ, মানুষের অনুষ্ঠিত ক্রিয়াকলাপ, যা শুধু বাইরের থেকে জানা হয়েছে; কিন্তু লোকেরা কি চিন্তা করেছে, তাদের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনার সাফল্য ও দুর্ভাগ্য প্রভৃতির সঙ্গে কি অনুভূতিগুলি জড়িত ছিল, তাদের কথাবার্তা যার দ্বারা তারা নিজেদের আবেগ ও ইচ্ছার ছাপ অন্যান্যদের ওপর ফেলত, তাদের ক্রোধ দুঃখ প্রকাশ, এক কথায় নিজেদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে উন্মোচিত করতে পারে, এই সবকিছু সম্পর্কেই ইতিহাস নীরব থাকে, আর এ সবই কবিতার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।


অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান মহাকবি গ্যেটে Gotz Von Berlichuigen (১৭৭৩) নামে যে ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন, তা শুধু জার্মান সাহিত্যেই নয়, অন্যান্য ইয়োরোপীয় সাহিত্যেও ঐতিহাসিক নাটক রচনার নতুন বিকাশের ধারা প্রবর্তন করে। এই নাটকটির পটভূমি রিফর্মেশনের সময়ে জার্মান ইতিহাসের সংকট। রচনাটিতে মধ্যযুগীয় ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের আধুনিক রাষ্ট্ররূপের সংঘাত চিত্রিত হয়েছে, এই নাটকে মধ্যযুগের শেষভাগের অবক্ষয়ের পটভূমিতে সমস্ত শ্রেণীর জীবন ও কৃষক বিদ্রোহের চিত্র পাই। নাটকটির নায়ক Gotz রাজতন্ত্রের দুর্নীতি ও সামাজিক কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহী কৃষকদের পক্ষাবলম্বন করে। গ্যেটের নাটকের এই চরিত্রটির মধ্যে গভীর ব্যক্তিগত চরিত্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক যাথার্থ্য ও সত্য সমন্বিত হয়েছে। এই রচনায় সর্বত্র শেক্সপিয়ারের প্রভাব সুস্পষ্ট। গ্যেটের Egmont-ও ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ইতিহাসের Egmont যিনি বিবাহিত ও যাঁর বিরাট সংসার ছিল, গ্যেটে তাঁকে সমস্ত বন্ধনহীন তরুণরূপে উপস্থাপিত করেছেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তাতে নাটকে চরিত্রটির ঐতিহাসিক ও তার ট্র্যাজিক দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়নি। গ্যেটের বন্ধু ও সমকালীন জার্মান কবি ও নাট্যকার শিলারের অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ঐতিহাসিক নাটক Don Carlos সম্বন্ধেও এই অভিযোগ করা হয়েছে। ইটালির নাট্যকার ভিত্তোরিয়ো আলফিয়েরির (১৭৪৯ ১৮০৩) Filippo নাটকে ও শিলারের নাটকে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের চরিত্র উপস্থাপিত। আলফিয়েরির ফিলিপের চরিত্রচিত্রণ ইতিহাসের প্রতি অধিকতর অনুগত সন্দেহ নেই। কিন্তু শিলার ক্ষয়িষ্ণু স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের নৈতিক ও মানবিক অধঃপতনের ঐতিহাসিক-সামাজিক অনিবার্যতার প্রতিফলনরূপে ফিলিপ ও তার পুত্র ডন কার্লোসের সংঘাতকে ঐতিহাসিক সত্যতা দান করেছেন। অবশ্য সমালোচকেরা গ্যেটে ও শিলারের এই ঐতিহাসিক নাটকগুলির মূল্য স্বীকার করে নিয়েই বলেছেন, কাব্যধর্মিতা, পটভূমির বিপুল বিস্তার ও দার্শনিক তত্ত্বের প্রাধান্যের জন্য তাঁদের রচনায় শেক্সপিয়ারের ঐতিহাসিক নাটকের জীবনচিত্রণের তীব্র ও সংহত নাট্যরূপ দেখা যায় না। ম্যানজনি তাঁর ঐতিহাসিক নাটক // Contede Carmagnola ও Adelchi-তে স্থান-কাল-পাত্রের ঐক্যরক্ষার প্রথা মানেন নি, তিনি শেক্সপিয়ার, গ্যেটে ও শিলারের ট্র্যাজেডির ধ্যান-ধারণাকে অনুসরণ করেছেন। ম্যানজনি অবশ্য তাঁর রচনায় ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে তাঁর চিন্তা, অনুভূতি ও কালের সমস্যাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।


আমাদের দেশে ইতিহাসবোধ ও ইতিহাসের চর্চার কোনও ঐতিহ্য ছিল না। ইয়োরোপীয় সাহিত্যের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার নাট্যকারেরা ঐতিহাসিক নাটক রচনায় ব্রতী হয়েছেন, কিন্তু তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ যতটা ছিল, যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক রচনায় সাফল্যের পরিমাণ ততটা নয়। বাঙালি নাট্যকারদের মধ্যে যাঁর নাটক মঞ্চসাফল্যের দিক থেকে যেমন, তেমনি সাহিত্যিক রসোত্তীর্ণ রূপ হিসেবেও উল্লেখযোগ্য, সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় শেক্সপিয়ারের নাটকের দ্বারা বিপুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ নাটক, ঐতিহাসিক নাটকও সাহিত্যিক উচ্ছ্বাসপূর্ণ দৃশ্যমালার সংকলন বলে মনে হয়। অবশ্য শেক্সপিয়ারের প্রাণচঞ্চল, ঐতিহাসিক ঘটনাবর্তে আলোড়িত এলিজাবেথীয় যুগ ও ইতিহাসের কেন্দ্র লন্ডন শহর থেকে আমাদের পরাধীন বাঙলাদেশ ও ঔপনিবেশিক শহর কলকাতার ব্যবধান অনেক। সেই যুগের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই বাঙালি ইতিহাস সন্ধান করেছিল, ঐতিহাসিক নাটক তারই একটা দিক, সেইদিক থেকেই তাঁর নিজস্ব মূল্য স্বীকার করতে হয়।


ঐতিহাসিক নাটক রচনাতেই দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। নাটকে ঐতিহাসিক পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর দক্ষতা অবিসংবাদিত। 'তারাবাই' (১৯০৩) দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক, এখানে তিনি বিশেষ সফল হতে পারেন নি। এই রচনায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। ‘প্রতাপসিংহই (১৯০৫) দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নাটক। তাঁর বেশির ভাগ নাটকের বিষয়বস্তু মোগল ও রাজপুত ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্রে বাঙলাদেশ স্বাদেশিকতার আন্দোলনে আবেগ-উদ্বেল হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল সেই স্বাদেশিকতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মোগল রাজশক্তির বিরুদ্ধে রাজপুতদের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের কাহিনীকে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ঐতিহাসিক নাটকে বাঙালির স্বদেশচেতনাকে প্রতীক রূপ দিয়েছেন। ‘প্রতাপসিংহ’ নাটকে মেবারের রাণা প্রতাপ সিংহের দেশের জন্য সংগ্রাম, বীরত্ব, দুর্জয় সংকল্প এবং দুঃখকষ্ট বরণ উজ্জলবর্ণে চিত্রিত হয়েছে। প্রতাপের ভাই শক্তসিংহের চরিত্র নাট্যকারের মৌলিক সৃষ্টি। জীবনের প্রতি আসক্তিহীন, সমাজ ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবর্জিত, বীর, উদ্ধত এই চরিত্রটি শেষ পর্যন্ত দৌলৎউন্নিসার প্রেমে নিজেকে ধরা দিয়েছে। মেহেরউন্নিসাও শক্তসিংহের প্রেমপ্রার্থিনী, এই প্রেম এবং অন্যান্য আচরণের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আকবরের চরিত্র দোষগুণে জটিল; তিনি উদার ও গুণগ্রাহী হলেও ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও নারীবিদ্বেষী।


দ্বিজেন্দ্রলালের ‘দুর্গাদাস' (১৯০৬) বহু চরিত্র ও ঘটনার পল্লবিত বিস্তারে শিথিল অবিন্যস্ত। এই নাটকে বীররস অতিমাত্রায় আতিশয্যদুষ্ট, তরল। কাশিম ও দিলীর খাঁর চরিত্র চিত্রণে নাট্যকারের পক্ষপাতহীন, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গাদাসের চরিত্র এত আদর্শায়িত হয়েছে যে তার মধ্যে সজীব মানুষের কোনও বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়ে না। গুলনেয়ার একটি জীবন্ত চরিত্ররূপে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 'নূরজাহান'কে (১৯০৮) কোনও কোনও সমালোচক দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি বলে মনে করেন। এই নাটকটির তীব্র ও গভীর ট্র্যাজেডির উৎস নায়িকা নূরজাহানের চরিত্র। তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত, ট্র্যাজেডি মহিমায় সমুন্নত নূরজাহান বাঙলা নাট্যসাহিত্যের এক অতুলনীয় চরিত্র সৃষ্টি। ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধীশ্বরী এই নারী তার প্রতিহিংসায়, দুর্দমনীয় প্রবৃত্তির তাড়নায়, বিধ্বংসী ঝড়ের মত অপ্রকৃতিস্থ আবেগে আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এক বিচিত্র বর্ণবৈভবে। নূরজাহান শুধু ক্ষমতালোভী, নিষ্ঠুর লালসাপরায়ণ শয়তানী নয়, দুর্দমনীয় আবেগ ও বিবেকের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হৃদয়ের অসহায় নারীও, আমাদের করুণা ও সহানুভূতির পাত্রী।


দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে নিঃসন্দেহে ‘সাজাহান' (১৯০৯) সর্বশ্রেষ্ঠ। নাট্যকার যেভাবে ঐতিহাসিক ঘটনাবস্তুর যাথার্থ্য রক্ষা করে চরিত্রগুলির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এবং বিভিন্ন চরিত্রের পারস্পরিক সম্বন্ধের নিপুণ চিত্রণে, ঘটনাবিন্যাসে নাট্যরস-সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নাটক রচনায় সফল হয়েছেন, বাঙলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা পাওয়া কঠিন। এই নাটকে দেখি, ভারতবর্ষের একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট সাজাহান বৃদ্ধ স্থবির, পুত্রের হাতে বন্দী, অসহায়, স্নেহাতুর; তবু তাঁর সেই শোচনীয় অবস্থারও একটা ট্র্যাজিক ভাবগাম্ভীর্য আছে, তাঁকে দেখে মনে হয় পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ। সাজাহানের বিলাপে, ক্রোধক্ষোভের গর্জনে, হাহাকারে আমরা ট্র্যাজিক সমুন্নতিকে (sublimity) ফুটে উঠতে দেখি। নাটকটির সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রস্থলে যিনি বিরাজ করেছেন, সাজাহানসহ অন্যান্য চরিত্রের অপরিসীম দুঃখকষ্ট ও মৃত্যুর জন্য যিনি দায়ী, সেই ঔরংজেবের চরিত্রটিও বাস্তব ও জীবন্ত : এই মানুষটি কূটচক্রী, নির্মম, নিজের ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য যে কোনও অন্যায় কাজে দ্বিধাশূন্য, কিন্তু তিনি একেবারে দানবেও পরিণত হন নি। তাঁর মধ্যেও কখনও কখনও স্নেহমমতার উদ্ভাস লক্ষ্য করা যায়, তিনিও দুই একটি মুহূর্তে হৃদয়দ্বন্দ্বে, বিবেকবোধে বিচলিত হয়েছেন। সাজাহান কন্যা জাহানারার চরিত্র ব্যক্তিত্বে দীপ্ত। ‘চন্দ্রগুপ্ত' (১৯১১) বহুদূরবর্তী ইতিহাস নিয়ে রচিত বলে নাট্যকারকে বিভিন্ন হিন্দু পুরাণ, কিংবদন্তী ও গ্রীক ইতিহাসের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল, তিনি ঐতিহাসিক বিবরণের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। ঘটনা বিন্যাসে সংহতির অভাব চোখে পড়ে, নাটকে, চন্দ্রগুপ্ত চাণক্য-মুরার মূল কাহিনী এবং সেলুকাস-এন্টিগোনাস-হেলেন গ্রীক উপকাহিনী সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। দুটির মধ্যে যোগসূত্র পরিস্ফুট হয় নি। এই নাটকের সবথেকে বড় ত্রুটি হল, চাণক্য তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ব্রহ্মণ্য-তেজ ও অহংকার, অনির্বাণ প্রতিহিংসার জ্বালা এবং স্নেহবুভুক্ষু হৃদয় নিয়ে যেমনভাবে ব্যক্তিত্বদীপ্ত চরিত্ররূপে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন, চন্দ্রগুপ্ত তেমনি তাঁর কাছে অনুজ্জ্বল ও নিষ্প্রভ।


অন্যান্য নাট্যকারদের তুলনায় ঐতিহাসিক যাথার্থ্য রক্ষা সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল অধিকতর সতর্ক ছিলেন, তাঁর নাটকে ঐতিহাসিক পরিবেশ ইতিহাসসম্মত বাস্তবতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর ঐতিহাসিক নাটকের আর একটি সম্পদ কাব্যধর্মী ও নাট্যগুণসমৃদ্ধ সংলাপের ভাষার ঐশ্বর্য, সাজাহান ও চন্দ্রগুপ্তের উক্তিগুলির অপূর্ব ভাষা তার উদাহরণ।