'সে এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়া শুত্রপক্ষ রাজহংসের মতো সাঁতার দিয়া বেড়াইত'—কার কথা বলা হয়েছে? এই মন্তব্যটি উক্ত চরিত্র সম্বন্ধে বলার কারণ কী?

“কোনো শিল্পী যেন বহু যত্নে নিখুঁত নিটোল করিয়া গড়িয়া দিয়াছেন।”—কোন্ প্রসঙ্গে এই মন্তব্য? যার প্রসঙ্গে এই মন্তব্য তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

ছোটোগল্পের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অতিথি’ গল্পের প্রধান চরিত্র কিশোর তারাপদ সম্বন্ধে এই মন্তব্য স্বয়ং লেখকের। কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু যখন স্বদেশে ফিরছিলেন তখন তারাপদ তাদের সহযাত্রী হওয়ার বাসনা জানায়, চরিত্রের বর্ণনা প্রসঙ্গেই লেখক এই প্রকার চিত্র অঙ্কিত করেছেন।


‘অতিথি’ গল্পে তারাপদ’র স্নিগ্ধমধুর অপাপবিদ্ধ চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। তার দেহকান্তির মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে প্রকৃতির সরলতা। তার মধ্যে সহজাত নিঃসঙ্গতা নিয়ন্ত্রিত করেছে তার সত্তাকে। সে আজন্ম ছন্নছাড়া দূরযানী পথিক। 'ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করে, অথচ এমন সহজে করে যে তাহাতে কোনোপ্রকার জেদ বা গোঁ প্রকাশ পায় না।' বাল্যাবস্থাতেই যাত্রাদলের সঙ্গে চলে গিয়েছিল নিজের বন্ধনহীন স্বভাবের জন্যই। সেখান থেকে জিমন্যাস্টিকের দলে, শেষ পর্যন্ত কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবুদের আশ্রয়ে। কিন্তু কোথাও তাকে বেঁধে রাখা যায়নি। তারাপদর কাছে চারপাশের সমস্ত কিছুই তার যথার্থ সঙ্গী হয়ে উঠতে পারেনি। অতুল ঐশ্বর্যও তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। তার নিঃসঙ্গতা মনের গভীর আবাদময় সত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, ‘বহু জনতার মাঝে বিচিত্র একা’ হয়ে বাঁচার যে কৌতূহল তা তারাপদর রক্তমজ্জায় মিশ্রিত হয়েছিল, আর এতেই ছিল তার মনের আনন্দ। পথ চলাতেই তার আনন্দ। পৃথিবীর গতিবেগের সঙ্গে তার চলমানতা বিদ্যমান, সেইজন্যই কোনো কিছুই তাকে বাঁধতে পারে না, সময়-ঋতুকে যেমন বাঁধা যায় না ঠিক সেরকমই তারাপদ চরিত্রের স্বভাব বৈশিষ্ট্য।



“তারাপদর বয়স অল্প, তাহার ইতিহাসও সেই পরিমাণে সংক্ষিপ্ত”—তারাপদর জীবন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত তারাপদর স্বভাব ও চরিত্রটি প্রকৃতির মতনই বৈচিত্র্যে পূর্ণ। কোথাও তার মন বাধা মানে না। পিতৃহীন তারাপদ ছোটবেলাতেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে অজানা আনন্দের হাতছানিতে। অথচ পরিবার ও প্রতিবেশীর স্নেহধন্য ছিল সে, তবু তার মন স্থিতি নয় গতির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিল। একটি বিদেশী যাত্রাদলের সঙ্গে তার প্রথম দূরযানী যাত্রা, তারপর জোর করে ধরে নিয়ে আসা হলেও সে ছিল জন্মগত বিবাগী।‘সে যখনই দেখিত নদী দিয়া বিদেশী নৌকা গুণ টানিয়া চলিয়াছে, গ্রামের বৃহৎ অশ্বত্থগাছের তলে কোন্ দূরদেশ হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে, অথবা বেদেরা নদীতীরের পতিত মাঠে ছোটো ছেটো চাটাই বাঁধিয়া বাঁখারি ছুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে বসিয়াছে, তখন অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত।" পরবর্তীকালে সে গানের দলে, জিমন্যাস্টিকের দলে ঘুরে বেড়িয়েছে, শেষপর্যন্ত কাঁঠালিয়ার জমিদার বাড়িতেও দুবছর কাটানোর পর, অতুল ঐশ্বর্য, নিঃসীম বিলাসিতার আশ্রয় ছেড়ে অক্লেশে আবার পাড়ি দিয়েছে, দুরের অজানা, অচেনা পৃথিবীর কোলে। তারাপদ চরিত্রটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি, Faolin যাকে বলেছেন, 'Special distillation of Personality'। নদীর মত সর্পিল গতিতে এগিয়েছে তার চরিত্র; নদী যেমন কোথাও থামে না, থামলেই তার মৃত্যু, তারাপদও তাই, সেইজন্যই গল্পের শুরু ও শেষ নদীতেই—প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গতিময়।



'সে এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়া শুত্রপক্ষ রাজহংসের মতো সাঁতার দিয়া বেড়াইত'—কার কথা বলা হয়েছে? এই মন্তব্যটি উক্ত চরিত্র সম্বন্ধে বলার কারণ কী?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অতিথি’ গল্পে প্রকৃতিপ্রেমিক উদাসীনচিত্তের কিশোর চরিত্র তারাপদ সম্বন্ধে কথাটি বলা হয়েছে।

সংসারবন্ধনহীন, মুক্তস্বভাব তারাপদ স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসাযুক্ত গৃহপরিবেশ ছেড়ে বারবারই পাড়ি দিয়েছে নিরুদ্দেশ্যের যাত্রী হয়ে। কোনো বন্ধনই তাকে বাঁধতে পারেনি। বহিঃপ্রকৃতির প্রাণচঞ্চল, নিয়ত অগ্রসরমান মর্মসত্তাই তাকে বারবার বহিঃমুখী করেছে। তারাপদ নানাদলের সঙ্গে দূরযানী যাত্রায় বেরিয়েছে, কখনো যাত্রাদল, কখনো গানের দল, কখনো জিমন্যাস্টিকের দল, অজানাকে জানবার অচেনাকে চিনবার দুর্দম অভীপ্সা তাকে গৃহভ্যন্তরে থাকতে দেয়নি। নানা দলের সঙ্গে ঘুরে কবিগান, পাঁচালি গান, বাঁশি বাজানো প্রভৃতি অনেক বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল। বিভিন্ন দলের সঙ্গে মিশলেও সে নিজের স্বাভাবিক কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিপ্রভাবে কোনো দলেরই বিশেষত্ব পায়নি। অন্তরের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও মুক্ত ছিল। সংসারে অনেক কুৎসিত কথা তাকে শুনতে হয়েছে বা কদর্য দৃশ্য দেখতে হয়েছে, কিন্তু তার কোনো ছাপ তারাপদর মনে দাগ কাটেনি। তারাপদর মধ্য দিয়ে জীবনের যে খণ্ড অংশটি লেখক রূপায়িত করেছেন তাতে পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবনের সৌন্দর্য ও মাধুর্যই প্রকাশিত হয়েছে। সমাজের কলুষতা লেখকের অভিপ্রেত ছিল না। তারাপদ নদীর মতোই ক্রমশ চলমান, সমস্ত কলুষতার বিমুক্তিই তার ধর্ম। সমস্ত খারাপের মধ্যে শুধুমাত্র সজীব, চল, প্রকৃতিপ্রেমী মনটিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, সেইজন্যই তাকে রাজহংসের সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক।