“আমি এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।”—এটি কোন্ গল্পে কার উক্তি? এই উক্তির তাৎপর্য কী?

উদ্ধৃত পংক্তিটি রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি' গল্পটির নায়কের উক্তি। 'একরাত্রি' গল্পে স্মৃতিচারণ পর্যায়ের শেষ অঙ্কে এসে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে মহামিলনের অলৌকিক আনন্দের অবিস্মরণীয় অনুভবের কথা কাহিনীর নায়কের কথায় ব্যক্ত হয়েছে।


নোয়াখালির একটি ছোট শহরে স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারির চাকরি নিয়ে কাহিনীর নায়ক চলে এসেছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে কলকাতা গিয়েছিল লেখাপড়া করতে। ভবিষ্যৎ জীবনে কোনো কালেক্টর সাহেবের নাজির বা কোনো জজ আদালতের হেডক্লার্ক হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। অবস্থা বিপর্যয়ে পড়াশুনো সে শেষ করতে পারল না। তার উচ্চাশাও পূর্ণ হল না। পিতৃবিয়োগের ফলে সে গ্রামে ফিরে এল। অবশেষে নিল এই সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি।


এদিকে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তার মন যখন নানা সোনালী স্বপ্নে বিভোর, তখনই তার বাল্যকালের খেলুড়ে, তার প্রতিবেশী-কন্যা সুরবালার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব এল। তার বাবা ও সুরবালার বাবা একমত হয়েই প্রস্তাব দিলেন। নিজেকে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত করার এই প্রস্তুতিপর্বে এই কাম্য প্রস্তাবকেও সে খারিজ করে দিল। সুরবালার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল সরকারী উকিল রামলোচনের। ঘটনাচক্রে সেই রামলোচনের বাড়ির পাশেই পুকুরের অপর পাড়ে তার বিদ্যালয়। বিদ্যালয় সংলগ্ন এক জীর্ণগৃহে তার নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রা।


এই নিঃসঙ্গতার অবসরে পার্শ্ববর্তী উকিল রামলোচনের বাড়িতে রামলোচনের সঙ্গে কথাবার্তার অবকাশে পাশের ঘর থেকে অত্যন্ত মৃদু একটু চুড়ির টুং টাং, কাপড়ের একটুখানি খসখস ও পায়ের একটুখানি শব্দ শোনা যেত। বারবার মনে পড়ত সুরবালার কথা। কিন্তু এখন সুরবালা রামলোচনের স্ত্রী। তার কাছে সে অপ্রাপণীয়া। যখন তার জীবনে সুরবালা সহজপ্রাপ্য ছিল তখন তার দিকে সে ফিরেও তাকায় নি। কিন্তু আজ যখন সে শুধু তার আয়ত্তের বাইরে নয়, পরস্ত্রী সুরবালা সম্পর্কে চিন্তাও যখন তার পক্ষে পাপ তখন, বিদ্যালয়ের ঐ নির্জনতায় তার নিঃসঙ্গ জীবনের অবকাশের আকাশখানি হয়ে উঠেছে সুরবালাময়। দুপুরবেলায় ক্লাসঘরের বাইরে যখন সমস্ত ঝাঁ ঝাঁ করত, উত্তপ্ত বাতাসে নিম-মঞ্জুরীর সুগন্ধ বয়ে আসত, সন্ধ্যাবেলায় বৃক্ষসমূহের মধ্যে নির্জনতা যখন তার মনটাকে সম্পূর্ণ ঘিরে ধরত, তখনি তার মনে পড়ত শৈশবপ্রীতিতে ঢলঢল সুরবালার দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টি। কিন্তু সুরবালার সঙ্গে কথা বলার, এমন কি একবার চোখে দেখবারও আর কোন উপায় নেই। উভয়ের মাঝখানে বরাবরের জন্য সৃষ্টি হয়েছে এক নীতি-নিয়ম-বিচ্ছেদের দেওয়াল। এককালে সুরবালা তার সব হতে পারলেও এখন সুরবালা তার কেউ নয়। সুরবালা পরস্ত্রী।


কাহিনীর নায়কের এ-হেন মানসিক অবস্থায় এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুরবালার সঙ্গে তার মিলনের সুযোগ করে দিল। এক বড়ো মোকদ্দমায় রামলোচন গৃহ থেকে অন্যত্র গেছে। আর তেমন দিনে ঘনিয়ে এল এক মহাপ্রলয়। সারাদিনের ঝড় জল বৃষ্টির মধ্যে রাত্রিতে এল সামুদ্রিক প্লাবন। দেখতে দেখতে চারদিক ভাসিয়ে জল বেড়ে চলল। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর ছেড়ে সে চলল সবচেয়ে উঁচু পুকুর পাড়ের দিকে। পাড়ের অপরদিক থেকেও আশ্রয় সন্ধানে উঠে এল আর একজন মানুষ-কেউ কারো পরিচয় না দিলেও সে অন্তর দিয়ে জানল যে ঐ নবাগতা সুরবালা।


আশেপাশে আর সমস্ত জলমগ্ন। কেবল হাত-পাঁচ ছয় দ্বীপের ওপর দুটি প্রাণী। কারো মুখে কথা নেই। কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করে ছুটে চলল। ভোর হল। শেষ হল দুঃস্বপ্নের রাত্রি। ঝড় থামল। জলও নেমে গেল। নিঃশব্দে দুজনে আবার যে যার ঘরে ফিরে গেল।


এককালে শৈশবে তারা কাছাকাছি এসেছিল। কালস্রোতে ভাসতে ভাসতে বহুকাল পরে আবার প্রলয়ের রাতে মরণের মুখোমুখি হয়ে তারা কাছাকাছি হল। সুরবালাকে আবার কাছে পাবার দীর্ঘপোষিত ইচ্ছা এইভাবে পূরণ হলেও, তার সঙ্গলিপ্সা আসঙ্গলিপ্সায় পরিণত না হয়ে সুরবালার কল্যাণ কামনার শুভ ইচ্ছায়, স্বামী-পুত্র গৃহ-ধন-জন নিয়ে চিরদিন সুখে থাকার মঙ্গল কামনায় সে মনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি খুঁজে পেল। নায়কের কাছে এই ক্ষণটুকু হয়ে উঠল চিরকালের অনন্তক্ষণ। মনোমিলনের ক্ষণিক আনন্দ নিয়ে এল অনন্ত আনন্দের আস্বাদ।