'দাহ' গল্পের ফতিমা চরিত্রটিই ধারণ করে আছে তৎকালীন ইতিহাস ও ভারতাত্মার মর্মবাণী- মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।

'দাহ' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে ফতিমা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।


ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি দীর্ঘ পর্ব এবং তার মধ্যে মিশে থাকা সাম্প্রদায়িকতার ভয়ংকর বীভৎসতা ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'দাহ' গল্পের পটভূমি। আর সমগ্র গল্পের কেন্দ্রভূমিতে স্থাপিত হয়েছে যে চরিত্রটি, তিনি ফতিমা, গল্পকথক অজিতের কাছে যিনি ফতিমাদি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিতরে সম্প্রীতি ও অখণ্ড ভারতের স্বপ্নকামনা রচিত হয়েছে এই অনন্য চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে।


গল্পটিতে ফতিমা চরিত্রটি উপস্থাপিত হয়েছে গল্পকথক অজিতের দৃষ্টিকোণ থেকেই। আসলে অজিতের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে স্বয়ং গল্পলেখক ফণীশ্বরনাথ রেণুর তথা উদারপন্থী আদর্শবাদী অখণ্ড ভারতের জন্য প্রত্যাশী ভারতবাসীরই আত্মার দর্শন। অজিত যে ফতিমাদিকে দেখেছিল, সেই ফতিমাদির মতো মানুষের প্রত্যাশ্যা ছিল জাতীয়তাবাদী সমস্ত ভারতবাসীরই।


ফতিমাদি ছিলেন সোনারপুরের মৌলবিসাহেরের মেয়ে। সোনারপুরের মৌলবিসাহেব গান্ধিজির আদর্শে অনুপ্রাণিত ও চরখা-খাদি আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ শরিক। অতএব ফতিমাও বাবার অনুসরণে হয়ে উঠেছিলেন গান্ধিজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এক সক্রিয় সদস্যা। অজিত লক্ষ করেছিল, ১৯৩০ থেকে ধারাবাহিকভাবে গান্ধিজির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ফতিমার উপস্থিত। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে দীর্ঘ অদর্শনের পর হঠাৎ সে পটনা শহরে ফতিমাদিকে আবিষ্কার করে গোঁড়া রক্ষণশীল মুসলিম নারীর মতো বোরখা ঢাকা অবস্থায়। ফতিমার এই পরিবর্তন বিস্মিত করে অজিতকে। কেননা তার চেনা ফতিমাদি ছিলেন আধুনিক উদার রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্না এক নারী। রক্ষণশীলদের শরিয়তি বিধান তিনি কোনোদিনই মেনে চলতেন না। তাহলে তাঁর এই পরিবর্তন কেন? কেনই বা তিনি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অগোচরে রয়ে গেলেন? কিংবা কেন তিনি রাজনীতির সংস্রব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বোরখা ঢেকে নিজেকে অন্তঃপুরবাসিনী করে তুললেন।


চরিত্রটির সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয় এই রহস্যাবরণের জন্যই। অজিতের পরিচয়ের মধ্য দিয়েই গল্পে ফতিমা চরিত্রের যে রূপ ফুটে ওঠে, তা আসলে কতকগুলি ঘটনামাত্র। কিন্তু সেই ঘটনাগুলিই প্রমাণ করে তাঁর চরিত্রের দীপ্তি ও বলিষ্ঠতা। ছত্রিশ বছর আগে, ১৯৩০-এ স্কুল মাঠের এক সভায় ফতিমাদিকে প্রথম দেখেছিল অজিত গান্ধিটুপিপরা মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে দশ-এগারো বছরের মেয়ে ফতিমাদি কঁধে তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিল। ১৯৩৪-এ ভূমিকম্পের পর ফতিমাদিকে দ্বিতীয়বার দেখে অজিত। ভূমিকম্পপীড়িত অঞ্চলে পরিক্রমারত গান্ধিজির সভায় তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিল সে। গান্ধির প্রার্থনা সভায় কোরানশরিফের আয়াতগুলি সুর করে পড়ছিল ফতিমাদি। এই বয়সেই পুলিশের লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে দু'বছরের কারাদণ্ডও নাকি ভোগ করে সম্প্রতি বেরিয়েছে সে। ১৯৩৭-এ কংগ্রেসি মিনিস্ট্রির সময় রাজনৈতিক জেলা সম্মেলনে তৃতীয়বার দেখা ফতিমাদির সঙ্গে। এই সভায় মুসলিম নেতারা যখন গোলযোগের চেষ্টা করে, তখন ফতিমাদি লাফ দিয়ে মঞে উঠে সেই আন্দোলন বিনষ্টকারীদের তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেছিল। ১৯৪৩-এ স্বাধীন সেনার বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে অজিত দীর্ঘ পাঁচমাস বেনারস-লখনউ-এলাহাবাদ গোরখপুরে ফতিমাদির পাশে পাশে ছিল। গ্রেপ্তারের সময়েও পুলিশ সার্জেন্টের অকথ্য গালিগালাজের উত্তরে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে ঝলসে উঠতে দেখেছিল অজিত। ১৯৩৭-এও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও তিনি দুর্বৃত্তদের সঙ্গে অসীম দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় মোকাবিলা করতেন। সেই ফতিমাদির মুখ বোরখায় ঢাকা দেখে স্বভাবতই বিস্মিত হয় অজিত।


উপরিউক্ত ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে ফতিমার যে চরিত্রবৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়, সেখানে গান্ধিজির অহিংসার আদর্শে প্রাণিত এক সতেজ, ভয়হীনা, সাম্প্রদায়িক বোধের ঊর্ধ্বে উদার মানবতায় বিশ্বাসী সংগ্রামী নারীকেই আমরা চিনে নিই। ১৯৩০-এ মাত্র দশ-এগারো বছর বয়সেই যে নারী সভায় দাঁড়িয়ে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা কাঁধে বক্তৃতা দিতে পারে, তাঁর রাজনৈতিক পরিণত মানসটিকেও যথার্থই শ্রদ্ধা করতে হয়। তারপর তাঁর অসাম্প্রদায়িক উদার মানবতার মূর্তিটি উন্মোচিত হয় ১৯৩৪-এ ভূমিকম্পবিধ্বস্ত অঞ্চলে গান্ধিজিরই সঙ্গে আর্তদের সেবার মধ্যে। গান্ধির প্রার্থনাসভায় কোরানের আয়াত পড়ার মধ্যেও সেই সংকীর্ণতাহীন উদার মানসেরই প্রকাশ। রামধুন ও কোরানের আয়াত পাঠের মধ্যে দিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জনগণের মধ্যে প্রচার করতে চাইছিলেন গান্ধিজি, ফতিমা যেন ছিলেন তারই চারণী। অথচ পুলিশের অশ্লীল আচরণের বিরুদ্ধে তিনি যখন গ্রেপ্তারির মুখেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন বোঝা যায়, তাঁর মধ্যে ছিল এক তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও সংগ্রামী চেতনা। হিংসার আশ্রয় না নিলেও তাই তিনি সংগ্রামী।


কিন্তু ইতিহাস অনুযায়ী ১৯৩৭-এর পর থেকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠতে থাকে মুসলিম লিগের বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথক রাষ্ট্রের জন্য তখন থেকেই ক্রমে ক্রমে কংগ্রেসের বিক্ষুদ্ধ শক্তি হিসাবে মাথা তোলে লিগ তথা বৃহৎ মুসলমান জনসাধারণ। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে তাই আপাতভাবে এই পৃথক রাষ্ট্রের দাবি সমগ্র মুসলমান সমাজের দাবি বলেই বিচার করা হয়। কিন্তু লিগ পন্থীদের বাইরে ছিলেন যে জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা, তাঁরা অসাম্প্রদায়িকভাবে অখণ্ড ভারতের পক্ষেই প্রচার ও সংগ্রাম চালাচ্ছিলেন। ফতিমা ছিলেন তাঁদেরই একজন। কিন্তু লিগের তুলনায় তাঁদের শক্তি দুর্বল হওয়ায় তাঁরা ভারতবিভাগ ঠেকাতে পারেননি। কিন্তু ১৯৪৭-এও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও যখন ফতিমাকে দেখা যায় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে অসীম দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় মোকাবিলা করতে, তখন বোঝা যায়, অবস্থা প্রতিকূল হলেও আদর্শের প্রতি তাঁর অন্তরের বিশ্বাস অপরিবর্তিতই থেকে গেছে।


কিন্তু স্বাধীনতার পর ফতিমার আর কোনো সক্রিয়তা প্রকাশ্যে দেখা যায় নি বা তার কোনো সন্ধানও ছিল না অজিতের কাছে। এর কারণ হিসাবে অজিতের গৃহে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ফতিমা। তাঁর ক্ষোভ সেই সমস্ত তথাকথিত কংগ্রেসিদের ওপর, যাঁরা বগলের নীচে বিভেদের ছুরি লুকিয়ে রেখে কংগ্রেস জমানায় কেবল ক্ষমতা ও গদির লোভে মত্ত হয়ে আছে। একদিন যারা গান্ধি-প্যাটেলকে অহিংসা নীতি ও অখণ্ড ভারতসাধনার জন্য গাল দিয়েছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে, তারাই স্বাধীন দেশের সরকারে মর্যাদা লাভ করায় ফতিমা ক্ষুব্ধ হন। শুধু তাই নয়, ফতিমা লক্ষ করেন যে, যারা একদিন দেশের অখণ্ডতার জন্য প্রাণপাত করেছে, তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে স্বাধীন দেশে। বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কথা ও আন্দোলনের জন্য ফতিমাকে পাষণ্ডদের ভয়ংকর উৎপীড়নও সহ্য করতে হয়েছে। কারও কাছে তিনি প্রতিবিধান পাননি। যেসব কবি-গায়ক একদিন সম্প্রীতির কথা বলত, তারা আজাদির পর নীরব হয়ে গেছে বলেও তাঁর ক্ষোভ। বিভেদকামী মানুষেরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠে গোটা দেশটাকে গিলে খাওয়ায় প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে আক্ষেপ ও ক্ষোভে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ফতিমা।


কিন্তু টাউনহলে ন্যাশনালিস্ট মুসলিম কনফারেন্সের দিন লিগপন্থী বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী গালাগালি, ইট পাথরের বর্ষণে প্রবল উত্তেজনার আবহ তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা প্রতিনিধিদের হিংস্রভাবে আক্রমণ করলে হঠাৎ দেখা যায় 'মহাত্মা গান্ধি কী জয়’ ধ্বনি দিয়ে হলের প্রবেশদ্বারে দেখা দিলেন সেই বলিষ্ঠ ফতিমা। এই পরিণত বয়সকালেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও অন্যায় হিংসাকে যে তিনি সহ্য করতে পারেন না, তা প্রমাণিত হয় এই ঘটনায়। বিক্ষোভকারীরা তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাঁকে বিবস্ত্র করে মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। এজন্য অজিত বেদনা অনুভব করলেও ভাঙা হাত, দগ্ধ মুখ নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েও ফতিমাদি যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে হাসেন। এতে বোঝা যায় তাঁর মনোবল ও নিজের আদর্শের প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাস। 'দাহ' গল্পে এই ফতিমা চরিত্রটি তাই হয়ে ওঠে গান্ধির অসাম্প্রদায়িক আদর্শের এক প্রতিমূর্তি। তিনি উদারপন্থী, ভারতীয় অখন্ডতার মন্ত্রে বিশ্বাসী মুসলমানদেরও একজন প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। আর সব থেকে বড় কথা ফতিমা হয়ে ওঠেন যেন প্রতিকূল রাজনীতির বর্বর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত কিন্তু আপন আদর্শে স্থির শান্ত ভারতবর্ষেরই প্রতিমূর্তি।