গেরাসিম লেবেডেফের থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা, অভিনয় অনুষ্ঠান এবং বৈশিষ্ট্যের বিবরণ দাও।

প্রথম বাংলা নাটকাভিনয়ের মঞ্চ কবে কোথায় স্থাপিত হয়েছিল? নির্মাতার ও বেঙ্গলী থিয়েটার রঙ্গালয়ের নাম বল। এখানে অভিনয়ে আয়োজন ও অভিনয়ের বিবরণ দাও।
“ইতিহাসে এই ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে এবং এজন্য লেবেডেফ ও গোলোকনাথ দাস আমাদের নিকট চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।” বেঙ্গলী থিয়েটারের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যাদি আলোচনা করে সমালোচকের এই উক্তির যাথার্থ্য বিচার কর।
দেশের লোকের উৎসাহ ও রুচির সহিত উহার কোন যোগ ছিল না, তাই উহা স্থায়ী হইতে পারিল না।” ‘বেঙ্গলী থিয়েটার' সম্পর্কে সমালোচকের এই মন্তব্য কতখানি যথার্থ, তা’ থিয়েটারটি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন তথ্যাদি জ্ঞাপনে বিচার কর।


ইংরেজদের দ্বারা স্থাপিত নাট্যশালা ও অভিনয় অনুষ্ঠান দেখে এদেশীয় বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রেরণার ফলে প্রথম নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার স্থাপনে। কিন্তু অবাক হওয়ার কথা এই যে, নাট্যশালা নির্মাণ করে প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠান করেছিলেন একজন রুশ দেশবাসী নাম গেরাসিম স্টেপানোভিচ্ লেবেডেফ। লেবেডেফ-এর এই নাট্যশালা এবং অভিনয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিবরণ পাওয়া যায়, এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর বিলাত থেকে প্রকাশিত একখানি হিন্দুস্থানী ব্যাকরণ গ্রন্থের ভূমিকায়।


লেবেডেফ এদেশে এদেশে এসেছিলেন এদেশীয় ভাষা, দর্শন, পুরাণ প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য। তিনি ভারত এসেছিলেন ১৭৮৫ সালের ১৫ই আগস্ট। প্রথম মাদ্রাজ ও পরে কলকাতায় এসে গোলকনাথ দাস নামে একজন এদেশীয় ভাষা পণ্ডিতের কাছে বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। লেবেডেফ নিজে একজন সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন। সম্ভবতঃ কলকাতার ইংরেজদের নাট্যশালা ও অভিনয় অনুষ্ঠান দেখেই তাঁর মনে নাট্যশালা স্থাপন ও বাংলা নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠানের ইচ্ছা জাগে। এই ইচ্ছা ও উৎসাহেই তিনি “The Diguise' এবং 'Love is the Best Doctor" "দুখানি ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ করেন। এই অনুবাদের কাজে তাঁর ভাষাশিক্ষক গোলোকনাথ দাস তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।


লেবেডেফ তাঁর 'A Grammar of the Pure and mixed East Indian Dialects' গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, 'I translated two English dramatic pieces, namely-The Disguise" and Love is the Best Doctor into the Bengali language, and having observed that Indians preferred. mimicry and drollery to plain grave solid sense, however purely expressed - I therefore fixed on those plays and which were most pleasantly filled up with a group of watchman, chokeydars, Savayarels, Canera; thieve, ghoonia, lawyers. gumosty and almost the rest a corps of petty plunderess." নাটক দুইটি অভিনয় অনুষ্ঠানের প্রস্তাবে গোলকনাথ দাস অভিনেতা-অভিনেত্রী সংগ্রহ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অধিকতর উৎসাহিত হয়ে লেবেডেফ কলকাতার ডোমতলাতে (বর্তমান এজরা স্ট্রীট) ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ (Bengali Theatre) নামে একটি নাট্যশালা নির্মাণ করেন এবং সেখানে অভিনয় অনুষ্ঠানের জন্য গভর্নর-জেনারেল স্যার শোরের অনুমতিও সংগ্রহ করেন।


অনূদিত নাটক দু'টি সামগ্রিকভাবে কেমন হয়েছিল বলা না গেলেও লেবেডেফের বিবরণ থেকে মোটামুটি ধারণা করা যেতে পারে : “ এদেশীয়রা গম্ভীর উপদেশমূলক কথা অপেক্ষা— সে যতই বিশুদ্ধ ভাবে প্রকাশিত হউক না কেন— অনুকরণ ও হাসিতামাশা বেশি পছন্দ করে'— এই ব্যাপারটি লেবেডেফ লক্ষ্য করেছিলেন। আর সেইজন্যই তিনি ‘চোর, চৌকিদার, উকিল, গোমস্তা ইত্যাদি চরিত্রে পরিপূর্ণ’ উক্ত দুখানি নাটক নির্বাচন করেছিলেন। নাট্যশালা নির্মাণ, অভিনেতা-অভিনেত্রী সংগ্রহ এবং তাদের শিক্ষাদান প্রভৃতি The Disguise (বাংলা অনুবাদ— কাল্পনিক সংবদল) নাটকের জন্য সবকিছুই প্রস্তুত হয়েছিল তিনমাসের মধ্যে। অভিনয়ের বাইশ দিন পূর্বে ৫ই নভেম্বর, ১৭৯৫ তারিখে 'ক্যালকাটা গেজেটে’ এই নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠানের প্রচার-বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানা যায় যে (১) নাট্যশালাটি বাঙ্গালী রীতি ও প্রথায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল, (২) পুরুষ এবং মহিলা উভয় সম্প্রদায়ই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিল, (৩) কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত এবং ভারতীয় সারেঙ্গী বাদন, বহু প্রসংশিত কবি ভারতচন্দ্রের কিছু গান এবং বাঙ্গালীদের প্রিয় ইউরোপীয় সঙ্গীত ও সুর এই নাটকে সংযোজিত হয়েছিল,এবং সর্বশেষে (৪) নাটকের অঙ্কগুলির মাঝখানে কৌতুকপ্রদ বিষয়ও দেওয়া হয়েছিল। নাটকটি তিন অঙ্কে সমাপ্ত।


নাটকটির প্রথম অভিনয়ের তারিখ এবং সময় বিজ্ঞাপিত হয়েছিল ক্যালকাটা গেজেটে ২৬ নভেম্বর, ১৭৯৫। এই বিজ্ঞাপনে জানা যায়—

  • (1) 'The disguise'-এর প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২৭ নভেম্বর, ১৭৯৫, রাত্রি ৮টায়। 

  • (২) টিকিটের মূল্য বক্স ও পিট ৮ টাকা এবং গ্যালারি—৪টাকা।


নাটকটির দ্বিতীয়বার অভিনয় হয়েছিল ২১মার্চ, ১৭৯৬। প্রথম অভিনয় সাফল্যমণ্ডিত এবং প্রচুর দর্শক সমাগম হওয়ায় দ্বিতীয়বার অভিনয়ের জন্য টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি করে এক মোহর ধার্য করা হয়েছিল। নাট্যশালার আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০। দ্বিতীয়বার অভিনয়ের পর লেবেডেফ ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে (২৪শে মার্চ, ১৭৯৬) জনসাধারণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় অভিনয় অনুষ্ঠানের পূর্বে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে জানা যায়, এই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যটি ইংরেজিতে অভিনীত হয়। এতে অনুমান করা যেতে পারে যে এই অংশে অভিনয় এদেশীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ নিশ্চয়ই অভিনয় করেননি আরও অনুমান করা যায় যে ইংরেজী অভিনয় নিশ্চয়ই ইংরেজ দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্যই করা হয়েছিল।


লেবেডেফের এই নাট্যশালা এই অভিনয়ের পরই বন্ধ হয়ে যায়। সমকালীন ইংরেজি নাট্যশালার উদ্যোক্তাগণ এই নাট্যশালায় অভিনয়ের সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ও বিরুপ মনোভাব গ্রহণ করে এবং এর বিরুদ্ধে শত্রুতা সুরু করে। নানাভাবে এই নাট্যশালার ক্ষতিসাধন করতে চেষ্টা করে। এদেরই চক্রান্তে লেবেডেফের দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ক্রমশ দল ছেড়ে চলে যান এবং সেখানে থেকে পরে নিজের দেশে ফিরে যান।


“দেশের লোকের উৎসাহ ও রুচির সহিত উহার কোন যোগ ছিল না, তাই উহা স্থায়ী হইতে পারিল না'—সমালোচকের (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) এই মন্তব্য যুক্তিপূর্ণ মনে হয় না। লেবেডেফ এদেশে আসেন অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষদিকে। সেই সময় এদেশে যাত্রা, কবিগান, কীর্তন, পাঁচালি এবং ঢপ প্রভৃতি সামাজিক লোককলা পরিবেশিত হত। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পালাগান হিসেবে প্রচলিত ছিল। এইসব যাত্রা, কবি, পাঁচালি প্রভৃতিতে একদিকে যেমন আদিরস, অন্যদিকে তেমনি নাচ-গান ও নিম্নশ্রেণীর কৌতুকরসের বাহুল্য ছিল। লেবেডেফ এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করেছিলেন এবং সেইজন্যই তিনি তাঁর নাটকে কৌতুকরসাত্মক চৌকিদার, চোর, উকিল, গোমস্তা প্রভৃতি নির্বাচন করেছিলেন এবং নাটকে ভারতচন্দ্রের প্রচলিত গান সংযোজিত করেছিলেন। প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠান কলকাতা শহরে করলেও লেবেডেফের ইচ্ছা ছিল গ্রামাঞ্চলে ঐ নাটকের অভিনয় প্রদর্শন করা। কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা ফলবর্তী হয়নি, সমকালীন ইংরেজি নাট্যশালার প্রযোজক কর্তাব্যক্তিদের চক্রান্তের ফলে। গ্রামাঞ্চলে অভিনয় প্রদর্শন করতে পারলে তিনি এই নূতন নাট্যশালা এবং অভিনয়কে এদেশীয় সাধারণ মানুষের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হতেন। তাছাড়া এদেশীয় যাত্রা অন্যান্য প্রচলিত নাট্যকলাতে যে সঙ্গীতের বাহুল্য ছিল, তাও লেবেডেফ লক্ষ্য এবং উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই ভাবেই তাঁর নাটকেও সঙ্গীতের বাহুল্য ছিল।


অনেকে পরবর্তীকালে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মনোমোহন বসু প্রভৃতির নাটকে যে সঙ্গীতের বাহুল্যযুক্ত গীতাভিনয় বা অপেরা নাটকের প্রচলন ঘটে, লেবেডেফের নাটকে তারই পূর্বাভাস দেখা যায়। সমকালীন যাত্রা, কীর্তন, পাঁচালি গান এবং পরবর্তীকালে গীতাভিনয় নাটকের রূপ ও রীতির মধ্যে লেবেডেফের নাটকের সাদৃশ্যের মধ্যেই এদেশীয় লোকের উৎসাহ ও রুচির যোগ ও ধারাবাহিতা লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজদের নাট্যশালার আদর্শে নির্মিত হলেও লেবেডেফ তাঁর নাট্যশালা যে বাঙ্গালীদের প্রচলিত মঞ্চসজ্জায় সজ্জিত করেছিলেন, এতে তাঁর দূরদর্শিতা এবং এদেশীয় জাতীয় চরিত্রের গভীর অনুধাবন শক্তির পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে যে 'নূতন যাত্রা’র উদ্ভব হয়েছিল, তার মধ্যে লেবেডেফের প্রভাব স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গলা নাট্যশালা এবং অভিনয় অনুষ্ঠানের ইতিহাসে একজন বিদেশী হলেও লেবেডেফ ও তার ‘বেঙ্গলী থিয়েটার'-এর নাম অবশ্যই স্বরণীয় হয়ে থাকবে।