মৌলবী সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

সতীনাথ ভাদুড়ীর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা বিঘ্নিত ‘চরণদাস এম.এল.এ.' গল্পটির মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলবী সাহেবের চরিত্রটি। অল্প সময়ের জন্যে তিনি পাঠকদের সামনে মাত্র দুবার আবির্ভূত হয়েছেন। অথচ এই চরিত্রটিই চিত্রিত হয়েছে গল্পের দ্যোতনার মূল চাবিকাঠি হিসেবে।


মৌলবী সাহেব একজন সরকারী কর্মচারী। এখানে এসেছেন বদলী হয়ে। লোক গণনার কাজে তিনি বাড়ি বাড়ি মানুষের নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত। বেশ ভারিক্কী চেহারা ও ভারিক্কী মেজাজ। কম কথা বলেন। কথায় বার্তায় যথেষ্ট নম্র, ভদ্র এবং কেতা দুরস্ত। কর্মে তাঁর গাফিলতি যেমন নেই, তেমনি কাজের বেলায় তিনি পক্ষপাতহীন। লোকগণনার কাজ করতে তিনি এসেছিলেন পার্টি অফিসে— সেখানে তখন চরণদাস এম.এল.এ. তাঁর দলীয় সহকারীদের সঙ্গে মুড়ি ছোলা ভাজা খেতে খেতে জনসংযোগ বাড়ানোর জন্যে মীটিং করছিলেন। সেখানে এসে সকলকে 'আদাব' বলে অভিবন্দনা করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর আবির্ভাবের কারণ জানিয়ে সেখানে উপস্থিত সকলের নামাদি তথ্য যত্ন সহকারে লিখে নিলেন। বাকি সকলের নামাদি তথ্য জানার পর চরণদাসের নাম এখান তালিকায় তোলা হবে কি না, বিনীত ভাবে জানতে চাইলেন। চরণদাস মনে করলেন তিনি এখানে এখন থাকেন না, থাকেন শহরে, তাই বুঝি তাঁকে অপমান করতে চাইছেন মৌলবী। এমনিতেই সকাল থেকে গ্রামবাসীদের আচরণে হতাশ এবং ভীত হয়েছিলেন চরণদাস। তার ওপর মৌলবীর শান্ত বিনীত কণ্ঠে জবাবদিহি শুনে ধৈর্য হারিয়ে চরণদাস তাঁকে খুবই অপমান করেন। চাকরি খাবার ভয় দেখান। এমনকি মারার ভয়ও দেখাতে থাকেন। তবুও মৌলবী তাঁর কর্তব্যের বিষয়টা বিনয়ের সঙ্গে চরণদাসকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি যে কর্তব্যনিষ্ঠ ও ধৈর্যবান এ কথার প্রমাণ চরিত্রটির সেই সময়ের আচরণের মধ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু শেষকালে যখন চরণদাসের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেবার কথা ঘোষণা করে যান, তখন ফুটে ওঠে তাঁর নির্ভিক ও ঋজু ব্যক্তিত্বের রূপ। সরকারী কর্মচারী হলেও তিনি কোনো প্রভাবশালী নেতার পদলেহন করে নিজের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করেননি তিনি।


মৌলবী সাহেব যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের লোক তা প্রকাশ পেয়েছে পার্টি অফিসে এসে ‘জয়গুরু' না বলে 'আদাব' বলে সকলকে অভিবাদন করার দৃষ্টান্তে। হতে পারে তিনি জাতিতে মুসলমান তাই আদাব বলে অভিবাদন করেছিলেন। এই চরিত্রটিকে মুসলমান করার পশ্চাতে অবশ্য কতকগুলি যুক্তি অনুসন্ধান করা যায়। যেমন, মৌলবী সাহেব যদি হিন্দু হতেন, তা হলে অন্যান্য গ্রামবাসীর মতো তিনিও ‘জয়গুরু’ ধ্বনিতে অভ্যস্থ হতে পারতেন। তা যদি হতো, তা হলে লেখক এই চরিত্রটিকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রূপ দাঁড় করাতে পারতেন না। আবার, চরিত্রটি হিন্দু হলে, জগৎগুরু সহস্রানন্দের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠতো।


সর্বোপরি, চরণদাসদের মতো মায়লেজীদের চোখে আঙুল দিয়ে চেনানো সম্ভব হতো না। যারা শুধুমাত্র জন সমর্থন নিজের দিকে টানবার জন্যে একজন মানুষকে ভগবান করে তোলবার চেষ্টায় এক বিধর্মীর পায়ে ধরতে দ্বিধা করে না। তবে মৌলবী সাহেব যে শিক্ষিত এবং সুবিবেচক এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় গল্পের শেষ দৃশ্যে। চরণদাস যখন মৌলবী সাহেবের পায়ে ধরে কথা আদায় করে নিয়ে তাঁর লোকগণনার তালিকা থেকে স্বামী সহস্রানন্দের নামটি কেটে দেবার আর্জি জানতে গিয়ে বলেন যে – তিনি তো মানুষ নন, তিনি দেবতা, মানুষদের সঙ্গে তাঁর নাম কি করে লেখা হতে পারে! -তখন মৌলভী সাহেবের দাড়ি চুলকানো বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনার মধ্যেই, এই বিস্ময়ের মধ্যেই তাঁর শিক্ষিত মানসিকতার রূপটি স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।