ইংরেজদের নাট্যশালা

এদেশে বাঙ্গালীদের প্রথম নাট্যশালা স্থাপিত হয় ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুর কর্তৃক। কিন্তু তার পূর্বেও বেশকিছু নাট্যশালা স্থাপিত করেছিল এদেশে বসবাসকারী ইংরেজরা নিজেদের আমোদ প্রমোদের জন্য। ইংরেজদের দ্বারা পরিচালতি, ইংরেজদের দ্বারা অভিনীত ইংরেজি নাটকের অভিনয় দেখেই এদেশেীয় ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালীদের মধ্যে ঐ ধরনের রঙ্গালয়ে অভিনীত নাট্যরসপিপাসা জাগে। এই পিপাসা ও আগ্রহেই এদেশীয় রাঙ্গালীদের মধ্যেও রঙ্গালয় স্থাপনে আগ্রহ এবং উৎসাহ জাগে। তাই বলা যায় এদেশের রঙ্গালয় স্থাপনের ব্যাপারে আমরা ইংরেজদের নিকট যথেষ্ট ঋণী।


ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলেই ইংরেজরা কলিকাতায় রঙ্গালয় স্থাপন করছিল। ইংরেজদের দ্বারা প্রথম রঙ্গমঞ্চ ‘Play House' স্থাপিত হয়েছিল লালবাজার ও মিশন রো’-এর সংযোগস্থলে, ৮নং লালবাজার স্ট্রীটের বাড়ীতে ১৭৫৬ সালে। নবাব সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের ফলে রঙ্গালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজদের দ্বিতীয় নাট্যশালা 'The Calcutta Theatre' স্থাপিত হয় ১৭৭৬ সালে। Writers' Buildingsএর পিছনদিকে এই থিয়েটার অবস্থিত ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস, ইলাইজে ইম্পে প্রভৃতি এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রঙ্গালয়টি কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যপট, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং সর্বোপরি অভিনয় অনুষ্ঠানে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে। এর ফলেই থিয়েটাররটি ‘New Play House' নামে পরিচিত হয়ে উঠে, আর লালবাজারের ‘Play House - এর নাম হয় Old Play House।


এদেশে ক্রমশঃ ইংরেজদের থিয়েটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। একে একে কলিকাতার বাইরে ‘চন্দরনগর থিয়েটার’ (১৮০৮), 'দমদম থিয়েটার' (১৮১৫), 'খিদিরপুর থিয়েটার' প্রভৃতি স্থাপিত হয়।


এই সময়েই ইংরেজদের বিখ্যাত রঙ্গালয় 'চৌরঙ্গী থিয়েটার' স্থাপিত হয় ১৮১৪ সালের ২৫শে নভেম্বর। এখানেও বহু প্রতিভাবান অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় করতেন। আশ্চর্যের কথা, দ্বারকানাথ ঠাকুর এই থিয়েটারটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নানা কারণে রঙ্গালয়টির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৮৩৯ সালের ৩১শে মে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে রগালয়টি সম্পূর্ণ ভষ্মীভূত হয়ে যায়।


চৌরঙ্গী থিয়েটারের পর ১৮৩৯ সালের ২১ শে আগস্ট ডালহৌসি অঞ্চলে উদ্বোধন ঘটে ‘সাঁমুচি থিয়েটার’-এর। কিছুদিনের মধ্যেই এই রঙ্গালয়টির যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই কারণে কিছুদিন পর পার্ক স্ট্রীটে নিজস্ব আরও বড় গৃহনির্মাণ করে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৪৩ পর্যন্ত এখানে অভিনয় চলেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ২রা নভেম্বর এই থিয়েটারের প্রধান মিসেস লীচ্ অভিনয়কালেই মঞ্চের উপর অগ্নিদগ্ধ হন এবং ১৮ই নভেম্বর মারা যান। ১৮৪৮ সালে এই থিয়েটারে বৈষ্ণবচরণ আঢ্য নামে এক বাঙ্গালী যুবক ‘ওথেলো'র ভূমিকায় অভিনয় করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ইংরেজদের রঙ্গালয়ে একজন বাঙ্গালী যুবকের ইংরেজি অভিনয়ে খ্যাতি অর্জন সত্যিই গৌরবের। ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে মে সাঁমুচি থিয়েটারে শেষ অভিনয় হয়।


এইসব ইংরেজদের রঙ্গালয়ে বিশেষ করে চৌরঙ্গী থিয়েটার এবং সাঁমুচি থিয়েটারের অভিনয় দেখে ও শুনেই সমকালীন ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালীদের মধ্যে ঐ জাতীয় আধুনিক রঙ্গালয় স্থাপন এবং অভিনয় অনুষ্ঠানের উৎসাহ ও প্রেরণা দেখা দেয়। এদেশে বাঙ্গালী ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে যে নূতন রঙ্গালয় স্থাপনে উদ্যোগী হতে দেখা যায়, তার পেছনে এইসব ইংরেজী নাট্যশালার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।